রাজনীতি সংবাদ ডেস্ক প্রকাশের সময় :২৪ আগস্ট, ২০২৪ ৬:২২ : অপরাহ্ণ
দেশ ছাড়ার ৭ বছর পর মুখ খুললেন সাবেক আলোচিত প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার (এস কে) সিনহা। তাকে সশস্ত্র বাহিনীর প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা সংস্থা ডিজিএফআই দিয়ে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশত্যাগে বাধ্য করেছিলেন বলে চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়েছেন।
গত ১৪ আগস্ট ডেইলি স্টারকে দেওয়া এক এক্সক্লুসিভ ভিডিও সাক্ষাৎকারে তিনি জানান, কীভাবে তাকে দেশ ছাড়তে বাধ্য করা হয়েছিল এবং সে সময় কী কী ঘটেছিল তার সঙ্গে।
২০১৭ সালের ৩ জুলাই প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার নেতৃত্বাধীন আপিল বেঞ্চ রায় সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করে রায় দেন। এর ফলে সুপ্রিমকোর্টের বিচারকদের অসদাচরণ তদন্ত ও অপসারণের সুপারিশ করার ক্ষমতা সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের হাতেই ফিরে আসে।
বিচারপতিদের অপসারণের সংবিধানের ষোড়ষ সংশোধনী বাতিলের রায় দেওয়ার পর নানা ঘটনার মধ্য দিয়ে তৎকালীন ক্ষমতাসীনদের তোপের মুখে পড়েন বিচারপতি এস কে সিনহা।
এ অবস্থায় ২০১৭ সালের ১৩ অক্টোবর রাতে ঢাকা ত্যাগ করেন বিচারপতি সিনহা। ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় নিয়ে ক্ষমতাসীন দলের তোপের মুখে ছুটি নিয়ে বিদেশ যাওয়ার পর ২০১৭ সালের ১১ নভেম্বর তিনি সেখানে থেকেই পদত্যাগপত্র পাঠিয়ে দেন।
বিচারপতি এস কে সিনহা ২০১৮ সালের ৩১ জানুয়ারি অবসরে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু নজিরবিহীন এক পরিস্থিতির মধ্যে তার কার্যকাল শেষ হয় মেয়াদের ৮১ দিন আগেই।
তিনি ছুটি নিয়ে বিদেশ যাওয়ার পর তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি, অর্থ পাচার, আর্থিক অনিয়ম ও নৈতিক স্খলনসহ সুনির্দিষ্ট ১১টি অভিযোগ পাওয়ার কথা সুপ্রিম কোর্টের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছিল।
তবে অভিযোগ অস্বীকার করে আসা বিচারপতি সিনহা যুক্তরাষ্ট্রে বসেই ২০১৮ সালে একটি বই প্রকাশ করেন। তাতে তিনি দাবি করেন, তাকে ‘পদত্যাগে বাধ্য করে নির্বাসনে’ পাঠানো হয়েছে।
সাবেক এই প্রধান বিচারপতি বলেন, সরকার তার নিরাপত্তা নিশ্চিত করলে তিনি বাংলাদেশে ফিরে এসে তার বিরুদ্ধে দায়ের করা সমস্ত মামলা সম্পূর্ণ মিথ্যা এবং বানোয়াট তা প্রমাণ করতে প্রস্তুত আছেন।
এস কে সিনহা বলেন, ‘আমি বাংলাদেশে ফিরে যাবো, এখন শুধু আমি গ্রিন সিগন্যালের অপেক্ষায় আছি। আমি সংশ্লিষ্ট আদালতে আত্মসমর্পণ করবো এবং প্রমাণ করবো যে আমার বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলাগুলি মিথ্যা।’
সাক্ষাৎকারে এস কে সিনহা বিশদ বর্ণনা করেছেন কীভাবে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাকে প্রচণ্ড চাপের মধ্যে রেখেছিলেন এবং ডিজিএফআই সদস্যদের মাধ্যমে তাকে দেশত্যাগ করতে বাধ্য করেছিলেন। কারণ তিনি শেখ হাসিনার নির্দেশনা ও হস্তক্ষেপ উপেক্ষা করে বিচার বিভাগের স্বাধীনতার জন্য লড়াই করেছিলেন।
সাবেক এই প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘বাংলাদেশে আমার শেষ দিনগুলো খুবই ভয়ংকর ছিল, যা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। কারণ এটি উপলব্ধির প্রশ্ন। একজন বর্তমান প্রধান বিচারপতি হিসেবে আমাকে গৃহবন্দী করে রাখা হয়েছিল। আমাকে কারও সাথে যোগাযোগ করতে দেওয়া হয়নি। আমার ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন ছিল, আমার বাড়িতে নিরাপত্তা বাহিনী (গোয়েন্দারা) স্ট্যান্ড গার্ড হিসেবে ছিল। তারা আমার বাড়িতে ঢোকার সময় আমার এক কর্মীকে মারধর করে। ডিজিএফআইয়ের তৎকালীন প্রধান সাইফুল আবেদীন মধ্যরাতে আমাকে বিরক্ত করতেন এবং পদত্যাগ করে দেশ ছাড়ার জন্য চাপ দিতেন।’
এস কে সিনহা বলেন, ‘সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের তার সহকর্মীরা (বিচারক) সরকারের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে আদালতে তার সঙ্গে বসতে অস্বীকৃতি জানান। প্রচণ্ড মানসিক চাপে ফেলে তাকে জানানো হয়, হাইকোর্টের বিচারকরা তাকে সহযোগিতা করবেন না। তখন ভেবেছিলাম দেশে থাকার আমার কোনো অধিকার নেই।’
সাবেক এই প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘তখন আমি ভেবেছিলাম সরকার হয়তো আমাকে দেশে থাকতে দেবে না। আমি তাড়াহুড়ো করে অন্যান্য প্রাসঙ্গিক কাজ শেষ করেছিলাম (রায়ের সম্পূর্ণ পাঠ্য প্রকাশসহ)। সে সময় আমি এশিয়া প্যাসিফিক দেশগুলোর প্রধান বিচারপতিদের একটি সম্মেলনে যোগ দিতে জাপান গিয়েছিলাম। কনফারেন্স রুম থেকে বের হওয়ার পর ডিজিএফআই থেকে কল আসে এবং একদিন পর আমি সিঙ্গাপুর হয়ে বাংলাদেশে ফিরে আসি। তখন ডিজিএফআই সদস্যরা আমাকে সেখানে উপস্থিত আমার কর্মকর্তাদের কাছে যেতে দিচ্ছিল না। আমার নিরাপত্তা নিশ্চিত করার অজুহাতে তারা আমার সঙ্গে আমার গাড়িতে যেতে চেয়েছিল। তখন আমি তাদের বলেছিলাম আমার গাড়ির প্রয়োজন নেই। আমি ভাবছিলাম এটি আরেকটি অশনি সংকেত।’
এস কে সিনহা বলেন, ‘‘একদিন আদালতে আমি সবেমাত্র আমার কাজ শেষ করেছি। তখন ডিজিএফআই প্রধান (সাইফুল আবেদীন) আমার অফিসে আসেন। তিনি জানান, প্রধানমন্ত্রী নিজেই তাকে পাঠিয়েছেন এবং তিনি আমাকে পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে চলে যেতে বলেছেন। আমি চিৎকার করে বললাম, ‘আপনি কে এবং আপনি কী বলছেন?’ তখন ডিজিএফআই প্রধান বলেন, তারা শুধু প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ বাস্তবায়ন করেন, আইনমন্ত্রী বা অ্যাটর্নি জেনারেলের নয়… আমি তাকে বেরিয়ে যেতে বলেছিলাম এবং এরপর থেকেই আমাকে গৃহবন্দি করে রাখা হয়।’’
এস কে সিনহাই প্রথম প্রধান বিচারপতি, ২০১৭ সালের নভেম্বরে যার দায়িত্বের অবসান হয়েছিল পদত্যাগের মধ্য দিয়ে। বাংলাদেশের ইতিহাসে তিনিই প্রথম সাবেক প্রধান বিচারপতি, দুর্নীতির দায়ে যার সাজার রায় এসেছে আদালতে।
২০২১ সালের ৯ নভেম্বর এস কে সিনহাকে ঋণ জালিয়াতির মামলায় চার বছর এবং অর্থ পাচারের মামলায় সাত বছরের কারাদণ্ড দেয় ঢাকার ৪ নম্বর বিশেষ জজ আদালত। বিচারক শেখ নাজমুল আলম তার রায়ে বলেছেন, কেউ আইনের ঊর্ধ্বে নয়।
২০১৫ সালের ১৭ জানুয়ারি দেশের ২১তম প্রধান বিচারপতি হিসেবে শপথ নেন এস কে সিনহা। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলাদেশে তিনিই একমাত্র অমুসলিম ও আদিবাসী বিচারক, যিনি বিচারাঙ্গণের শীর্ষ পদে পৌঁছেছিলেন।
প্রধান বিচারপতি হওয়ার আগে থেকেই নানা কারণে আলোচিত এস কে সিনহা তার ১০৩০ দিনের দায়িত্বে বার বার সংবাদ শিরোনামে এসেছেন নানা ঘটনায়।
আরও পড়ুন: আদালত প্রাঙ্গণে সাবেক বিচারপতি মানিকের ওপর ডিম-জুতা নিক্ষেপ