রাজনীতি সংবাদ ডেস্ক প্রকাশের সময় :২০ জুন, ২০২৪ ১০:১৬ : পূর্বাহ্ণ
ঝিনাইদহ-৪ আসনের এমপি আনোয়ারুল আজিম আনার হত্যাকান্ডে জড়িত সন্দেহে গ্রেপ্তার জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাইদুল করিম মিন্টুর ৮ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন আদালত। কিন্তু রিমান্ডে নেওয়ার তৃতীয় দিনে গত রোববার মিন্টুকে আদালতে হাজির করা হয়।
এরপর মামলার তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত তাকে কারাগারে আটক রাখার আবেদন করেন তদন্ত কর্মকর্তা ডিবি পুলিশের ওয়ারী জোনের সহকারী পুলিশ কমিশনার মাহফুজুর রহমান। তার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকার একটি মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালত তাকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেয়।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের উপকমিশনার (অপরাধ, তথ্য ও প্রসিকিউশন) আনিসুর রহমান গণমাধ্যমকে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
তবে এদিন মিন্টু খুনের দায় স্বীকার করেননি বলে তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্র দাবি করেছে।
এ ঘটনায় কেউ বলছেন, ওপরমহলের চাপে মিন্টুকে আদালতে হাজির করে কারাগারে পাঠানো হয়। কেউ বলছেন, মিন্টুর মুখ থেকে রাঘব বোয়ালের নাম বেরিয়ে আসায় বিব্রত পুলিশ। তবে পুলিশের দাবি, স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় তাকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। প্রয়োজনে তাকে পুনরায় আদালতের মাধ্যেমে আবারও রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।
নাম প্রকাশ না করে ডিএমপির এক কর্মকর্তা বলেন, মিন্টুকে যে দিন গ্রেপ্তার করা হয়, ওই দিন তিনি ধানমন্ডিতে আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী এক নেতার বাসায় ছিলেন। পরে ওই নেতার নির্দেশে মিন্টু বাসার নিচে নেমে এলে তাকে আটক করে গোয়েন্দা কার্যালয়ে আনা হয়। এরপর থেকে ওপরমহল থেকে মিন্টুকে সাবধানতার সঙ্গে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য চাপ ছিল। নিহত আনারের মেয়েও মিন্টুকে ছাড়িয়ে নিতে ওপর থেকে চাপ দেওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ করেন। বিষয়টি নিয়ে দোটানায় পড়েন তদন্তকারী সংস্থার কর্মকর্তরা। তবে রিমান্ডে থাকা অবস্থয় মিন্টুর কাছ থেকে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া গেছে। সেগুলো যাচাই-বাছাই চলছে বলে জানান তিনি।
ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, রিমান্ডে থাকা অবস্থায় মিন্টু কোনোভাবেই মুখ খুলছিলেন না। পরে প্রযুক্তিগত তথ্য-প্রমাণ হাজির করে জিজ্ঞাসাবাদ শুরুর একপর্যায়ে সবকিছু স্বীকার করে গোয়েন্দাদের আদ্যপান্ত জানান। এ ছাড়া আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেওয়া গ্যাসবাবুও মিন্টুর জড়িত থাকার বিষয়ে তথ্য দেন। মূলত ঝিনাইদহ-৪ আসনে এমপি হওয়ার লোভে পড়ে নেপথ্যে থাকা একটি বড় শক্তির ইন্ধনে তিনি এই খুনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন।
গোয়েন্দা পুলিশের অপর এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, খুনের মূল কারণ সোনা চোরাচালান ও হন্ডি ব্যবসা। সাম্প্রতিক সময়ে ঢাকা, যশোর ও ঝিনাইদহের প্রভাবশালী নেতাদের সঙ্গে চোরাচালানের টাকার ভাগ-বাঁটোয়ারার দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েন আনার। আর এ কারণে তারা আনারকে সরিয়ে দেওয়ার পথ খুঁজছিলেন। একপর্যায়ে এই সিন্ডিকেটের নজরে পড়ে আনারের সঙ্গে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মিন্টুর দ্বন্দ্বের বিষয়টি। তারা মিন্টুকে আনারের আসনে এমপি বানানোর লোভ দেখান। মিন্টুও তাদের ফাঁদে পা দেন। দফায় দফায় তাদের সঙ্গে মিন্টুর বৈঠক হয়। একপর্যায়ে খুনের দায়িত্ব নেন মিন্টু।
ওই গোয়েন্দা কর্মকর্তার মতে, মূলত চোরাচালানের দ্বন্দ্ব হলেও খুনে ব্যবহার করা হয়েছে রাজনৈতিক শত্রুতা। এতে ফায়দা লুটেছে ওই চোরাচালান সিন্ডিকেট।
ডিবির একটি সূত্র বলছে, আট দিনের রিমান্ডের তৃতীয় দিনে মিন্টুর কাছ থেকে আরও বড় ধরনের রাঘব বোয়ালের নাম বেরিয়ে এসেছে। সেই তথ্যগুলো যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। এ কারণে তাকে মাঝপথে কারাগারে পাঠানো হয়।
১১ জুন জিজ্ঞাসাবাদের জন্য রাজধানীর ধানমন্ডি থেকে মিন্টুকে ডিবি পুলিশ আটক করে। ডিবি কার্যালয়ে জিজ্ঞাসাবাদ শেষে তাকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়। ১৩ জুন আদালতের মাধ্যমে মিন্টুকে আট দিনের রিমান্ডে নেওয়া হয়।
রিমান্ড শুনানিতে আদালতকে মিন্টু বলেন, ‘আমি রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার। এমপি মনোনয়ন চাওয়াই আমার অপরাধ।’
উল্লেখ্য, গত ১২ মে ব্যক্তিগত সফরে ভারতে যান ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজিম আনার। ১৭ মে থেকে পরিবারের সঙ্গে তার যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। পরদিন তার নিখোঁজের বিষয়ে উত্তর কলকাতার বরানগর থানায় একটি জিডি করেন সেখানকার বন্ধু গোপাল বিশ্বাস। এরপর সংসদ সদস্যের মেয়ে মুমতারিন ফেরদৌস ডরিন ঢাকায় গোয়েন্দা সংস্থা ডিবির কাছে বাবার নিখোঁজের অভিযোগ দেন।
নিখোঁজের ১০ দিন পর গত ২২ মে সকালে ভারতীয় গণমাধ্যমে এমপি আনার খুন হওয়ার খবর প্রকাশ করা হয়। খবরে বলা হয়, এমপি আনারকে ১৩ মে রাতে কলকাতার নিউটাউনের সঞ্জীবা গার্ডেন্সের একটি ফ্ল্যাটে খুন করা হয়। এরপর তার মরদেহ টুকরো টুকরো করে গুম করা হয়।
এমপি আনারকে হত্যার ঘটনায় ২২ মে রাজধানীর শেরেবাংলা নগর থানায় অপহরণ মামলা দায়ের করেন তার মেয়ে মুমতারিন ফেরদৌস ডরিন। পাশাপাশি ভারতের কলকাতার নিউ টাউন থানায় সেখানকার পুলিশ একটি মামলা করেছে।
হত্যাকাণ্ডের বেশ কয়েকদিন পেরিয়ে গেলেও কলকাতা পুলিশ মরদেহের কোনো ক্লু পাচ্ছিলো না। পরে নিজেদের গ্রেপ্তার করা সন্দেহভাজনদের কাছ থেকে তথ্য নিয়ে কলকাতায় পা দেন ডিবিপ্রধান হারুন অর রশীদ ও তার প্রতিনিধিদল।
এরপর ডিবিপ্রধান হারুন অর রশীদের অনুরোধে কলকাতার সিআইডি পুলিশ গত ২৮ মে সঞ্জীবা গার্ডেন্সের ওই ফ্ল্যাটের সেপটিক ট্যাংকে তল্লাশি অভিযান চালায়। অভিযানে সেপটিক ট্যাংক থেকে মরদেহের টুকরো টুকরো কিছু মাংস উদ্ধার করা হয়। মরদেহের এসব মাংস এমপি আনারের বলেই ধারণা ডিবি ও পশ্চিমবঙ্গ সিআইডির।
তবে সুস্পষ্টভাবে নিশ্চিত হতে মরদেহের মাংসগুলোর ডিএনএ ও ফরেনসিক টেস্টের প্রক্রিয়া চলছে এখন।
এর মধ্যে গত ৯ জুন এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় গ্রেপ্তার সিয়াম হোসেনকে নিয়ে অভিযান চালিয়ে কিছু হাড়গোড় উদ্ধার করেছে কলকাতার সিআইডি। দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার ভাঙড়ের সাতুলিয়ার বাগজোলা খাল থেকে এসব হাড়গোড় উদ্ধার করা হয়।
তবে হত্যা রহস্যের জট খুলতে আরও গভীর তদন্তের দিকে এগিয়ে চলেছে কলকাতা ও বাংলাদেশের তদন্তকারী সংস্থাগুলো।
আরও পড়ুন: এমপি আনার হত্যা: আ.লীগ নেতা মিন্টু ৮ দিনের রিমান্ডে