কারও নাম না নিয়ে সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাভেদ বলেছেন, ‘আনোয়ারা-কর্ণফুলীর মানুষের সরাসরি ভোটে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি আমি। কে, কী হয়েছেন, কোন পদ পেয়েছেন-এটা আমার দেখার বিষয় নয়। স্পষ্টভাবে বলতে চাই, সাংবিধানিকভাবে আমি নির্বাচিত প্রতিনিধি। আমার এলাকায় কোনো দ্বৈতশাসন চলবে না।’
আজ শুক্রবার বিকেলে চট্টগ্রামের আনোয়ারা উপজেলা পরিষদের হলরুমে এক অনুষ্ঠানে তিনি এই হুংকার দেন।
সাবেক এই ভূমিমন্ত্রী কড়া ভাষায় আরও বলেন, ‘এলাকার প্রশাসনকে আমি দিকনির্দেশনা দেবো। এলাকায় কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচি করতে হলে এক সপ্তাহ আগে পুলিশ প্রশাসন থেকে অনুমতি নিতে হবে আয়োজকদের। অনুমতি না নিয়ে কোনো সমাবেশ করতে দেওয়া হবে না।’
চট্টগ্রাম-১৩ আসনের (আনোয়ারা-কর্ণফুলী) সংসদ সদস্য সাইফুজ্জামান চৌধুরী কারও নাম মুখে না নিলেও আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতাকর্মীরা বলছেন, তিনি (জাভেদ) সদ্য অর্থ প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পাওয়া ওয়াসিকা আয়েশা খানকে উদ্দেশ করে এই ‘হুংকার’ দিয়েছেন। কারণ গত ২৩ মার্চ আনোয়ারা উপজেলায় আয়োজিত এক সমাবেশে ওয়াসিকা প্রধান অতিথি ছিলেন। এর আগে ৯ মার্চ আনোয়ারা উপজেলায় ওয়াসিকাকে গণসংবর্ধনা দেওয়া হয়। উভয় সমাবেশে স্থানীয় আওয়ামী লীগের বিপুল সংখ্যক নেতাকর্মী উপস্থিত ছিলেন।
গত ১ মার্চ মন্ত্রিসভায় স্থান পান সংরক্ষিত নারী আসনের সংসদ সদস্য ওয়াসিকা আয়েশা খান। তিনি আওয়ামী লীগের প্রয়াত প্রেসিডিয়াম সদস্য আতাউর রহমান খান কায়সারের মেয়ে। তাকে অর্থ প্রতিমন্ত্রীর মতো গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়।
অর্থ প্রতিমন্ত্রী হওয়ার পর ওয়াসিকা গত ২৩ মার্চ চট্টগ্রামে এসে আনোয়ারা উপজেলায় ৫৭৭ কোটি টাকা ব্যয়ে উপকূলীয় বেড়িবাঁধ নির্মাণ ও পারকি সমুদ্র সৈকতে ৭১ কোটি টাকা ব্যয়ে পর্যটন কমপ্লেক্সের কাজ পরিদর্শন করতে আসেন।
এ সময় ওয়াসিকা আয়েশা খান প্রশাসনের কর্মকর্তাদের কাছে জানতে চান, ‘২০১৬ সালে উপকূলীয় বেড়িবাঁধের কাজ শুরু হয়ে এখনও শেষ না হওয়াটা সন্দেহজনক। অর্থ যা ছাড় হয়, সে অনুপাতে কাজ হয় না। পাউবোর ত্রুটি, ঠিকাদারের ত্রুটি এসব অভিযোগ শুনতে হচ্ছে। সরকারি অর্থ উত্তোলন করেছেন, কিন্তু কাজ হয়নি কেন?’
অর্থ প্রতিমন্ত্রী প্রশাসনের কর্মকর্তাদের হুঁশিয়ার করে বলেন, ‘আনোয়ারার উপকূলে বেড়িবাঁধ নির্মাণে কোনো ধরনের অনিয়ম ও দুর্নীতি সহ্য করা হবে না। সরকারি বরাদ্দের অর্থ জনগণের কল্যাণে কাজে আসতে হবে। সরকারের প্রতিটি বরাদ্দের সঠিক বাস্তবায়ন যেন হয়।’
আনোয়ারা-কর্ণফুলী আসনের আওয়ামী লীগ নেতারা মনে করছেন, এলাকায় ওয়াসিকার ‘কর্তৃত্ব’ হয়তো মেনে নিতে পারছেন না সাবেক ভূমিমন্ত্রী জাভেদ। তাই তিনি ক্ষুব্ধ হয়ে ওয়াসিকাকে হুংকার দিয়েছেন।
আওয়ামী লীগের প্রয়াত প্রেসিডিয়াম সদস্য আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবুর সন্তান জাভেদ এবার এমপি হিসেবে পুনর্নির্বাচিত হলেও মন্ত্রিসভায় স্থান পাননি।
গত সংসদ নির্বাচনে আনোয়ারা-কর্ণফুলী আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চেয়ে পাননি ওয়াসিকা। পরে তিনি সংরক্ষিত নারী আসনের এমপি নির্বাচিত হন।
দলীয় সূত্রে জানা গেছে, ওয়াসিকা আনোয়ারা-কর্ণফুলী আসনের এমপি হতে না পারলেও প্রতিমন্ত্রী হওয়ার পর এলাকায় তার ‘প্রভাব’ বেড়েছে। অন্যদিকে এমপি নির্বাচিত হলেও মন্ত্রিসভায় স্থান না পাওয়ায় এলাকায় জাভেদের ‘প্রভাব’ কমে গেছে।
দলীয় সূত্রগুলো জানিয়েছে, ওয়াসিকা অর্থ প্রতিমন্ত্রী হওয়াতে তার কর্মী-সর্মথকরা উজ্জীবিত হয়ে উঠেছেন। অপরদিকে জাভেদের কর্মী-সমর্থকরা কোণঠাসা হয়ে পড়েছেন। এ কারণে ওয়াসিকার দিকে আক্রমণের তীর ছুঁড়তে শুরু করেছেন জাভেদ।
জাভেদ ও ওয়াসিকার মধ্যে দ্বন্দ্ব কেন?
দলীয় সূত্রে জানা গেছে, ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে আনোয়ারা-পশ্চিম পটিয়া থেকে প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য নির্বাচিত হন আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু আর আনোয়ারা-বাঁশখালী আসনে জাতীয় পরিষদ সদস্য হন আতাউর রহমান খান কায়সার। তখন থেকে দুই নেতার মধ্যে আঞ্চলিক কর্তৃত্ব নিয়ে দ্বন্দ্ব দেখা দেয়।
এরপর ১৯৮৬ সালে চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলনে আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু ও আতাউর রহমান খান কায়সার সভাপতি প্রার্থী ছিলেন। সেই সম্মেলনে আতাউর রহমান কায়সারকে টেক্কা দিয়ে সভাপতি নির্বাচিত হন আখতারুজ্জামান চৌধুরী।
এরপর থেকেই দুই নেতার মধ্যে দূরত্ব বাড়তে থাকে। ১০ বছর পর জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দুই নেতার দ্বন্দ্ব আরও তীব্র হয়। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন পেয়েও বিএনপি প্রার্থী সরোয়ার জামাল নিজামের কাছে পরাজিত হন আতাউর রহমান কায়সার। সরোয়ার জামালের কাছে পরাজয়ের পেছনে সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাভেদের ‘হাত ছিল’ বলে মনে করেন আতাউর রহমান কায়সারের পরিবার।
১৯৯৬ সালের সংসদ নির্বাচনের পর থেকে আখতারুজ্জামান চৌধুরীর সঙ্গে আতাউর রহমান কায়সারের দ্বন্দ্ব প্রকট রূপ নেয়। আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু ও আতাউর রহমান খান কায়সারের মৃত্যুর পর দুই নেতার দুই সন্তান জাভেদ-ওয়াসিকার মধ্যে সেই দ্বন্দ্ব আবার চাঙা হয়েছে।
আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবুর মৃত্যুর পর ২০১৩ সালে রাজনীতিতে প্রবেশ করেন সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাভেদ। এরপর তিনি ২০১৪ সালের সংসদ নির্বাচনে এমপি নির্বাচিত হয়ে ভূমি মন্ত্রণালয়ে প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পান। এরপর পূর্ণমন্ত্রী হন। এ নিয়ে টানা তিনবার এমপি নির্বাচিত হয়েছেন তিনি। কিন্তু রাজনীতিতে আসার পর জাভেদ কখনো প্রকাশ্যে কোনো সভা-সমাবেশে প্রতিপক্ষ ওয়াসিকাকে উদ্দেশ করে এমন আক্রমণ করেননি। এই প্রথম তিনি ওয়াসিকার বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছেন।
ওয়াসিকা আয়শা খান ২০১৪ সাল থেকে সংরক্ষিত নারী আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে এ পর্যন্ত তিনবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। পাশাপাশি তিনি আওয়ামী লীগের অর্থ ও পরিকল্পনা বিষয়ক সম্পাদক পদে দায়িত্ব পালন করছেন।
আরও পড়ুন:
বৃটেনে সাইফুজ্জামান চৌধুরীর ২০০ মিলিয়ন পাউন্ডের সাম্রাজ্য
সাইফুজ্জামান চৌধুরীর বিদেশে সম্পদের তদন্ত চাইলো টিআইবি