রাজনীতি সংবাদ ডেস্ক প্রকাশের সময় :২৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪ ৮:৪৪ : অপরাহ্ণ
সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কাছে ‘নালিশের’ ব্যাপারে সাড়ে ৪ বছর পর মুখ খুলেছেন যুক্তরাষ্ট্রে আশ্রয় নেওয়া বাংলাদেশের হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক ও এনজিওকর্মী প্রিয়া সাহা।
২০১৯ সালের ১৭ জুলাই হোয়াইট হাউসে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সঙ্গে এক সাক্ষাতের সময় তিনি ‘বাংলাদেশ থেকে প্রায় ৩৭ মিলিয়ন হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিস্টান নিখোঁজ হয়ে গেছে’ বলে ‘নালিশ’ করেছিলেন।
যুক্তরাষ্ট্রের স্থানীয় সময় শনিবার (২৪ ফ্রেব্রুয়ারি) নিউইয়র্ক সিটির জ্যাকসন হাইটসের জুইশ সেন্টারে ‘সনাতন ধর্মাবলম্বীদের’ এক সভায় প্রধান অতিথির ভাষণে প্রিয়া সাহা ট্রাম্পের কাছে দেওয়া সেই ‘নালিশের’ ব্যাখ্যা করেন।
হোয়াইট হাউসে ট্রাম্পের কাছে সে সময় প্রিয়া সাহা নিজেকে বাংলাদেশি পরিচয় দিয়ে বলেছিলেন, ‘‘স্যার, আমি বাংলাদেশ থেকে এসেছি। সেখানকার ৩ কোটি ৭০ লাখ সংখ্যালঘু হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিষ্টান ‘নিখোঁজ’ হয়ে গেছে। দয়া করে বাংলাদেশি জনগণকে সাহায্য করুন। আমরা দেশ ছাড়তে চাই না, থাকতে চাই।’’
ট্রাম্প তখন বলেন, ‘বাংলাদেশ?’
হ্যাঁ সূচক জবাব দিয়ে প্রিয়া সাহা বলেন, ‘এখনো সেখানে ১ কোটি ৮০ লাখ সংখ্যালঘু মানুষ থাকে। আমার অনুরোধ, দয়া করে আমাদের সাহায্য করুন। আমরা দেশ ছাড়তে চাই না। সেখানে থাকতে আমাদের সহযোগিতা করুন। আমি আমার বাড়ি হারিয়েছি। তারা বাড়ি পুড়িয়ে দিয়েছে। আমার জমি ছিনিয়ে নিয়েছে। কিন্তু কোনো বিচার হয়নি।’
তখন ট্রাম্প জিজ্ঞাসা করেন, ‘কে জমি নিয়ে গেছে?’ উত্তরে প্রিয়া সাহা বলেন, ‘মুসলিম মৌলবাদী সংগঠনগুলো। তারা সবসময় রাজনৈতিক আশ্রয় পেয়ে আসছে।’
প্রিয়া সাহা কেন এসব কথা ট্রাম্পকে বলেছিলেন তার ব্যাখ্যা দিয়ে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি বলেন, ‘আমার পূর্বপুরুষ মধ্যস্বত্ত্বভোগী বা তালুকদার বা ছোট জমিদার ছিল। তাদের অনেক জমি ছিল। এখনো ৩০০ একর সম্পত্তি রয়েছে আমার বাপ-দাদাদের। আমাদের জমি দখল করে খাচ্ছে রাজনৈতিক প্রভাবশালী ব্যক্তিদের নাম ব্যবহার করে। বিষয়টি রাজনৈতিক নেতারা জানেন।’
তিনি বলেন, ‘একটি গ্রামকে কিভাবে সিস্টেম্যাটিকভাবে উচ্ছেদ করে তার একটা প্রকৃষ্ট উদাহরণ হলো আমাদের গ্রাম। কী কী করা হয় সেখানে- ধরেন, যখন ফসল হয় আমরা রাতে ঘুমাতে পারতাম না। সবাই বলে যে, আজানের ধ্বনি শুনলে তাদের মন ভালো হয়ে যায়, আর আমি আঁতকে উঠি। কারণ, ভোররাতে তারা গরু ছেড়ে দিত, আজানের পর তারা হয় ফসল কেটে নিয়ে যাবে, নয়তো আক্রমণ করবে।’
প্রিয়া সাহা বলেন, ‘আমাদের জমির ওপর একশ চিংড়ির ঘের আছে। চিংড়ির ঘের থেকে অনেক টাকা আয় হয় তা সকলেই জানেন। সেই চিংড়ির ঘেরগুলো তারা দখল করে নিল। ২০০৪ সালে যখন দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীরা ক্ষমতায়, সে সময় আমার বাবার জমির ওপর বিশাল ইটের ভাটা করল। কত মামলা-মোকদ্দমা করা হলো। কেউ শোনে না। এখনো দুটি ইটভাটা আছে, ইট কাটা হয় এবং এই ইট দিয়ে বাগেরহাটে সকল কন্সট্রাকশন কাজ করে। পিরোজপুরে সে বড় কন্ট্রাক্টর এবং আমার বাবার জায়গার ওপরে সেই ইটের ভাটা।’
তিনি বলেন, ‘তারা আমাদের ঘের থেকে মাছ ধরে নিয়ে যাবে। আমাদের বিধবা জেঠিমা ছিলেন, জেঠির একটি গাভী ছিল, স্বামী মারা গেলে সেটি বাবার বাড়ি থেকে দিয়েছিল, গাভীটি প্রসবের কাছাকাছি ছিল। তেমনি অবস্থায় গাভীটি জবাই করে খেয়ে ফেলে এবং বাছুরটা ভাসিয়ে দেয় নদীতে। কিন্তু তার কোনো বিচার হয়নি।’
প্রিয়া সাহা বলেন, ‘আমাদের অঞ্চলে (পিরোজপুর) বানিয়ারি নামে একটি গ্রাম আছে, সেই গ্রামে দুই-তিন বছর পরপরই একজন মানুষকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। সেই পাড়ায় বৈষ্ণব বাড়ির একটি ছেলেকে মেরে ফেলল। হত্যার পর সুপারি গাছে চারদিকে চার হাত-পা বেঁধে ঝুলিয়ে রাখা হয় লাশটি। ছেলেটির চোখ উপড়ে ফেলা হয়েছিল। সেই বৈষ্ণব পাড়ায় দেড় শতাধিক হিন্দু পরিবার ছিল। ওই ছেলেটিকে হত্যার পর ঝুলিয়ে রাখার বীভৎস দৃশ্য দেখে ছয় মাসের মধ্যে পুরো বৈষ্ণব পাড়ার সকলে ভারতে চলে গেল। এর তিন বছর পর আরেকজনকে হত্যা করা হয় পার্শ্ববর্তী পাড়ায়। তারও চোখ উঠিয়ে মধ্যবানিয়ার পাড়ার যে সবচেয়ে ধনী পরিবার, তাদের বাড়ি সংলগ্ন পুকুরে ওই লোকটির লাশ চুবিয়ে রাখল, শুধু মুখটা পানির ওপরে। যারা তাকে হত্যা করেছে তাদের সকলেই চেনে।’
এরকম প্রতিটির হত্যাকাণ্ডে মামলা হয়েছে উল্লেখ করে প্রিয়া সাহা বলেন, ‘আমাদের অঞ্চলের মানুষেরা মামলা করতে খুব জানে। কিন্তু ওই যে, যেই জজ, সেই পুলিশ, সেই উকিল, সরকারি উকিল- ফাইনালি কিছু হয় না। এভাবেই প্রথমত: ফসল কেটে নেওয়া, দ্বিতীয়ত: কিছুদিন পরপরই হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করা, তৃতীয়ত যে কাজটি করে তারা সেটি হলো ফলস মামলা দেওয়া। আমাদের গ্রামে এমন অনেক ব্যক্তি, আত্মীয়-স্বজন, বংশের লোক আছে যাদের বিরুদ্ধে ৫০, ৬০, ৭০টি পর্যন্ত মামলা দেওয়া হয়। সবগুলোই ফলস (মিথ্যা)। এ ধরনের মামলা দিয়ে বছরের পর বছর সহজ-সরল লোকজনকে হয়রানি করা হচ্ছে। অর্থাৎ, বছরের বড় একটি সময় কোর্টে অতিবাহিত করার পরিবর্তে অনেকে ইন্ডিয়ায় চলে গেছেন।’
২০১৯ সালে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্টের কাছে সেই ‘নালিশের’ পর প্রিয়া সাহা আর দেশে ফেরেননি। ওয়াশিংটন ডিসিতে একটি এনজিওর তত্ত্বাবধানে রয়েছেন।
বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে কংগ্রেস ছাড়াও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন মহলে দেনদরবার করেন বলে এই সমাবেশে উল্লেখ করেন প্রিয়া সাহা। তিনি বাংলাদেশের পরিস্থিতির ব্যাপারে সকলকে সজাগ থাকারও আহ্বান জানান।