শনিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০২৪ | ১৪ বৈশাখ, ১৪৩১ | ১৭ শাওয়াল, ১৪৪৫

মূলপাতা জাতীয়

মিয়ানমার সীমান্তে সঙ্কট, ক্রসফায়ারের মধ্যে বাংলাদেশ


রাজনীতি সংবাদ ডেস্ক প্রকাশের সময় :৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪ ১২:১৭ : অপরাহ্ণ
Rajnitisangbad Facebook Page

৪ ও ৫ ফেব্রুয়ারি মিয়ানমার বর্ডার গার্ড পুলিশের (বিজিপি) কমপক্ষে ১০০ সদস্য বেআইনিভাবে বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্ত অতিক্রম করে বাংলাদেশে প্রবেশ করে। বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) তাদেরকে নিরস্ত্র করে আটক রাখে। এছাড়া বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল অব্যাহত হামলার মুখে আছে। এর মধ্যে মিয়ানমারের বাহিনী বন্দুকের গুলি ছুড়ছে, মর্টার হামলা করছে। গানশিপ ব্যবহার করে হামলা করছে।

রাখাইন এবং চিন রাজ্যে মিয়ানমার সরকারের বাহিনী এবং বিদ্রোহী আরাকান আর্মির মধ্যে তীব্র যুদ্ধ বাংলাদেশের জন্য মারাত্মক এক নিরাপত্তা হুমকি সৃষ্টি করেছে। ঐতিহাসিকভাবে মিয়ানমারের সঙ্গে একটি জটিল সম্পর্ক রয়েছে বাংলাদেশের।

১৯৭৮ সাল থেকে বাংলাদেশ সীমান্তের ভিতরে রাখাইনের উত্তরাঞ্চল দিয়ে জাতিগত রোহিঙ্গাদের বার বার বের করে দেওয়া হচ্ছে। একই সঙ্গে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী আকাশসীমা লঙ্ঘনের পাশাপাশি বাংলাদেশের স্থল ও সামুদ্রিক সীমা লঙ্ঘন করছে। ভূখণ্ডগত অবস্থান মাঝে মাঝেই ঢাকা ও ন্যাপিডর সম্পর্কে বাধা সৃষ্টি করে।

২০১৭ সালের আগস্ট থেকে কমপক্ষে ১৩ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী অবস্থান করছে বাংলাদেশে।

এসব শরণার্থীর প্রত্যাবাসন প্রত্যাখ্যান করে মিয়ানমার অনড় অবস্থানে। এতে দুই দেশের মধ্যকার সম্পর্কে টান ধরেছে। মিয়ানমারের সেনাবাহিনী নিয়ন্ত্রিত সরকার এবং নির্বাসিত ন্যাশনাল ইউনিটি গভর্নমেন্টের (এনইউজি) মধ্যে পূর্ণমাত্রায় গৃহযুদ্ধ শুরু হয় ২০২১ সালের মে মাসে। এতে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের সম্পর্ককে আরও জটিল করে তুলেছে।

আরাকান আর্মি, মিয়ানমার ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স আর্মি (এমএনডিএএ) এবং তাং ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মির (টিএনএলএ) সমন্বয়ে গড়ে ওঠে থ্রি ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্স। ২০২৩ সালের ২৭ অক্টোবর থ্রি ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্স ও তার মিত্ররা বহুমাত্রিক অভিযান শুরু করে মিয়ানমার সরকারের বিরুদ্ধে। এর নাম দেয়া হয় অপারেশন ১০২৭। তখন থেকেই রাখাইন ও চিন রাজ্যে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী এবং বিজিপির বিরুদ্ধে তীব্র যুদ্ধ শুরু করেছে জাতিগত বিদ্রোহী রাখাইন আরাকান আর্মি।

এখন পর্যন্ত তারা পালেতোয়া এবং পাউকতোয়ার মতো বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য এলাকা তাদের দখলে নিয়েছে। সেনাবাহিনীর বেশ কিছু ব্যাটালিয়ন দখলে নিয়েছে। বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তের প্রায় সব বর্ডার আউটপোস্ট থেকে সদস্যদের তাড়িয়ে দিয়েছে। জব্দ করেছে সেনাবাহিনীর বিপুল পরিমাণ সরঞ্জাম। পরিস্থিতি এতটাই গুরুতর যে, মিয়ানমার সরকার রাখাইন রাজ্যের রাজধানী সিতওয়েতে কারফিউ দিতে বাধ্য হয়েছে।

ক্রসফায়ারের মধ্যে বাংলাদেশ
মিয়ানমারে চলমান যুদ্ধ এবং সর্বশেষ অপারেশন ১০২৭ শুরু থেকেই বাংলাদেশের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। রাখাইন রাজ্যে ক্রমবর্ধমান সহিংসতা মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যকে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমিয়ে দিয়েছে। সীমান্তের কাছে যুদ্ধ তীব্র হয়ে উঠার প্রেক্ষিতে কয়েক সপ্তাহ ধরে মিয়ানমার সীমান্ত বরাবর বাংলাদেশ মারাত্মক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করছে।

প্রথমত, বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় সীমান্ত এলাকা, বিশেষ করে বান্দরবান জেলার নাইক্ষ্যংছড়ি, কক্সবাজারের টেকনাফ ও উখিয়া মিয়ানমারের চলমান যুদ্ধের গোলাগুলি ও মর্টার হামলার শিকারে পরিণত হচ্ছে। একবার মিয়ানমারের বিমান বাহিনীর হেলিকপ্টার গানশিপ থেকে বাংলাদেশ ভূখণ্ডে হামলা হয়েছে। এসব হামলায় দু’জন বাংলাদেশি নাগরিক নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন অনেকে। বহু বাড়িঘর ও যানবাহন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর ফলে সীমান্ত এলাকা থেকে কমপক্ষে তিন হাজার বাংলাদেশি নাগরিক সরে এসেছেন নাইক্ষ্যংছড়িতে। উপরন্তু স্কুল বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। লোকজন ও যানবাহনের চলাচল সীমিত করা হয়েছে।

দ্বিতীয়ত, পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে, রাখাইন রাজ্যে বিদ্রোহের মূলোৎপাটনের জন্য ‘ফোর কাটস’ কৌশল বাস্তবায়ন করছে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। কমপক্ষে ৮১ জন বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন কয়েক শত। অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত হয়েছেন কমপক্ষে এক লাখ ২০ হাজার মানুষ। এর ফলে ওই অঞ্চলে সৃষ্টি হয়েছে এক মানবিক বিপর্যয়।

একই সঙ্গে নতুন করে বড় আকারে আবার বাংলাদেশে শরণার্থীর ঢল নামতে পারে। এরই মধ্যে রাখাইন রাজ্য থেকে দু’জন বেসামরিক ব্যক্তি বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নিয়েছেন। বিশেষ করে রাখাইন রাজ্যে অব্যাহত সহিংসতা বাংলাদেশে নতুন করে রোহিঙ্গা শরণার্থীর একটি ঢেউ সৃষ্টি করতে পারে। এমনিতেই শরণার্থী সঙ্কট নিয়ে বাংলাদেশ মারাত্মক সঙ্কটে।

মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর ছোড়া গোলায় রাখাইনের মংডুতে হপোন নিও লিইক গ্রামে কমপক্ষে ১২ জন রোহিঙ্গা বেসামরিক মানুষ নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন বেশ কয়েক ডজন। এর ফলে কয়েক হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশ সীমান্তের কাছে অবস্থান নিয়েছেন। দৃশ্যত, তাদের উদ্দেশ্য বাংলাদেশে প্রবেশ করা। একই সঙ্গে মিয়ানমারে এই যুদ্ধ তীব্র হয়ে উঠার কারণে রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তন প্রক্রিয়াকে আরও অচল করে দিয়েছে।

অন্যদিকে বাংলাদেশের জন্য পছন্দের সমাধান হলো এসব শরণার্থী সঙ্কটের সমাধানে তাদের প্রত্যাবর্তন করানো। রাখাইন রাজ্যে চলমান যুদ্ধ রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তনের যে পাইলট প্রকল্প আছে তাকে অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত রাখার একটি অজুহাত হিসেবে দাঁড় করানোর সুযোগ দিয়েছে মিয়ানমার সরকারকে। অন্যদিকে এনইউজি সম্প্রতি বলেছে, ন্যাপিড থেকে সেনা শাসকদের উৎখাত করার পরই তারা রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তনে আগ্রহী। ফলে এনইউজিও পরোক্ষভাবে রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তন স্থগিত করেছে।

শেষ পর্যন্ত, মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সেনা সদস্যদের বাংলাদেশে প্রবেশ বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব ও নিরাপত্তার জন্য একটি প্রত্যক্ষ হুমকি। তাদেরকে মানবিক কারণে আশ্রয় দিয়েছে বাংলাদেশ। কিন্তু এই ধারা বাংলাদেশ ও মিয়ানমার সীমান্তকে আরও অস্থিতিশীল করে তুলবে। সৃষ্টি হবে ঢাকার জন্য মারাত্মক নিরাপত্তা উদ্বেগ।

আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করছে মিয়ানমার
১৯৪৯ সালের জেনেভা কনভেনশনের প্রোটোকল অ্যাডিশনের অনুচ্ছেদ ৩ অনুযায়ী, কোনো রাষ্ট্রের অধিকার নেই আন্তর্জাতিক পর্যায়ের নয় এমন কোনো সংঘাতে অন্য রাষ্ট্রের ভিতরে প্রত্যক্ষভাবে বা পরোক্ষভাবে হস্তক্ষেপ করার। মিয়ানমারে যে গৃহযুদ্ধ চলছে প্রথমত তা আন্তর্জাতিক কোনো সশস্ত্র লড়াই নয়। নিজের দিক থেকে বাংলাদেশ পররাষ্ট্র নীতির ভিত্তিতে মিয়ানমারের যুদ্ধে কঠোর নিরপেক্ষতা বজায় রেখেছে। মিয়ানমারের ভিতরে কোনোরকম হামলা বা পরোক্ষে চলমান যুদ্ধে কোনোভাবে হস্তক্ষেপ করেনি বাংলাদেশ। তাই মিয়ানমার যুদ্ধে আন্তরিকতার সঙ্গে আন্তর্জাতিক আইন মেনে চলছে বাংলাদেশ।

অন্যদিকে প্রায় দায়মুক্তির অধীনে বছরের পর বছর আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে আসছে মিয়ানমার। ১৯৭৮, ১৯৯১-১৯৯২ এবং ২০১৭ সালে মিয়ানমার সরকার জাতিগত রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে নৃশংস জাতিনিধন অভিযান চালিয়েছে। গণহত্যার এই যে ধারা তাতে বাংলাদেশে যে সঙ্কট সৃষ্টি করেছে তা আন্তর্জাতিক আইনের নগ্ন লঙ্ঘন। আর এখন সর্বশেষ ঘটনায় মিয়ানমার বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে আবারও আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করছে। জাতিসংঘের সনদের অনুচ্ছেদ ২(৪) এবং ৫১-এর অধীনে আত্মরক্ষা ছাড়া আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে জাতিসংঘের সদস্য দেশগুলোকে অবশ্যই শক্তিপ্রয়োগ থেকে বিরত থাকতে হবে।

এরই মধ্যে বাংলাদেশ সীমান্তে বেশ কয়েকবার হামলা করেছে মিয়ানমার। তাতে বাংলাদেশের বেসামরিক লোকজন হতাহত হযেছেন। মিয়ানমারের সেনারা বেআইনিভাবে বাংলাদেশের সীমানায় অনুপ্রবেশ করেছে। উপরন্তু মিয়ানমার সরকার রাখাইন রাজ্যে এমন ভয়াবহ অবস্থা সৃষ্টি করেছে, যাতে ওই অঞ্চল থেকে আবার নতুন করে শরণার্থীর ঢল মোকাবিলা করতে হতে পারে বাংলাদেশকে। তাই আন্তর্জাতিক আইনের অধীনে বাংলাদেশের প্রতি মিয়ানমার যে আচরণ করছে তা বেআইনি এবং অন্যায়।

আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দায়িত্ব
মিয়ানমারের ‘অ্যাকশন’কে নিয়ন্ত্রণে আনতে ব্যর্থ হয়েছে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পষিদের নেতৃত্বে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়। নিজেদের ভূ-রাজনৈতিক ও ভূ-অর্থনৈতিক স্বার্থের কারণে, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধের ফলে বাকি বিশ্ব মিয়ানমারের চলমান যুদ্ধ বন্ধে খুব সামান্যই অবদান রেখেছে। তাদেরকে এসব কারণে জবাবদিহিতায় আনতে খুব সামান্যই করেছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের এই নিষ্ক্রিয়তা শুধু আন্তর্জাতিক আইন এবং আন্তর্জাতিক আদর্শের অবক্ষয়েই ভূমিকা রাখে।

যা হোক মিয়ানমারের ভিতরকার ক্রমবর্ধমান অস্থিতিশীলতা এবং বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তের বড় রকমের অস্থিতিশীলতা দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া সহ পুরো অঞ্চলকে অস্থিতিশীল করে তুলতে পারে। মিয়ানমারের এই যুদ্ধ এরই মধ্যে বাংলাদেশ ও ভারতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। চীন এবং থাইল্যান্ডেও অল্প প্রভাব ফেলেছে। আন্তর্জাতিক নিরাপত্তার জন্য গুরুতর প্রভাবসহ বৃহত্তর আঞ্চলিক সঙ্কটে রূপান্তর হওয়ার আশঙ্কা আছে এই ঘটনা। তাই আন্তর্জাতিক আইন সমুন্নত রাখতে এবং আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক নিরাপত্তাকে নিশ্চিত করতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে জাতিসংঘ সনদের অধীনে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। মিয়ানমার থেকে যে সহিংসতার শুরু হচ্ছে তার লাগাম টেনে ধরতে হবে।

(লেখাটি দ্য ডিপ্লোম্যাট ম্যাগাজিন থেকে অনূদিত)

সূত্র: মানবজমিন

মন্তব্য করুন
Rajnitisangbad Youtube


আরও খবর