শুক্রবার, ২২ নভেম্বর, ২০২৪ | ৭ অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ | ১৯ জমাদিউল আউয়াল, ১৪৪৬

মূলপাতা আঞ্চলিক রাজনীতি

ষড়যন্ত্রের গন্ধ পাচ্ছেন মহিউদ্দিন বাচ্চু, মনজুর আলমের পেছনে কে



রাজনীতি সংবাদ প্রতিবেদক, চট্টগ্রাম প্রকাশের সময় :৬ ডিসেম্বর, ২০২৩ ৫:০১ : অপরাহ্ণ

আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে চট্টগ্রাম-১০ (হালিশহর-পাহাড়তলী-খুলশী) আসনে সাবেক সিটি মেয়র মোহাম্মদ মনজুর আলমের স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়া নিয়ে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের মধ্যে সন্দেহ দানা বেধেছে। তারা মনে করছেন, মনজুর আলমের পেছনে দলের কোনো নেতার ইন্ধন থাকতে পারে, না হয় তিনি নৌকার হেভিওয়েট প্রার্থী মহিউদ্দিন বাচ্চুর সঙ্গে লড়াই করার সাহস পেতেন না। এর পেছনে ষড়যন্ত্রের গন্ধ পাচ্ছেন মহিউদ্দিন বাচ্চু।

সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানিয়েছে, নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগে গণভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে গিয়েছিলেন মনজুর আলম। কিন্তু তিনি প্রায় দুই ঘণ্টা অপেক্ষা করেও প্রধানমন্ত্রীর সাক্ষাৎ পাননি। গণভবন থেকে সাড়া না পাওয়ার কারণে তিনি আওয়ামী লীগের মনোনয়ন ফরম নেননি। এর আগে ২০১৮ সালের নির্বাচনেও তিনি আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন চেয়ে পাননি।

এ বিষয়ে জানতে মনজুর আলমের সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি এই প্রসঙ্গে কথা বলতে রাজি হননি।

চট্টগ্রাম-৪ (সীতাকুণ্ড) আসনে মনজুর আলমের ভাতিজা দিদারুল আলমকেও এবার আওয়ামী লীগের মনোনয়ন দেওয়া হয়নি।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, চট্টগ্রাম-১০ আসনের একজন স্বতন্ত্র প্রার্থীর নিকটাত্মীয় দেশের এক ধনী ব্যবসায়ী মনোনয়নের ব্যাপারে এবার তদবির করার সুযোগ পাননি। ওই নিকটাত্মীয়ের সঙ্গে ‘লন্ডন কানেকশনের’ তথ্য পেয়েছে একটি গোয়েন্দা সংস্থা। যে কারণে ওই পরিবারে এবার নৌকার মনোনয়ন মেলেনি।

চট্টগ্রামের রাজনীতির মাঠে মনজুর আলমকে অনেকে ‘সুযোগ সন্ধানী’ বলে থাকেন। কারণ ২০০৮ সালের সংসদ নির্বাচনের পর তিনি আওয়ামী লীগ ছেড়ে বিএনপিতে যোগ দিয়েছিলেন। ২০১০ সালে বিএনপি থেকে মেয়র হওয়ার পর তিনি দলটির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা হন। কিন্তু ২০১৫ সালের সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়রের চেয়ার হারানোর পর তিনি আবার আওয়ামী লীগের ঘরে ফিরে যান।

আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা বলছেন, মনজুর আলম বিনয়ী ও সজ্জন ব্যক্তি হলেও তিনি অত্যন্ত চালাক-চতুর মানুষ। তিনি সবসময় ক্ষমতার পক্ষে থাকতে চান। তিনি বিএনপি থেকে এসে আবার আওয়ামী লীগের লেবাস ধারণ করেছেন তার ব্যবসায়িক স্বার্থে। তিনি এখন আওয়ামী লীগকে তার পারিবারিক পার্টি দাবি করেন। অথচ তিনি এই পার্টি থেকে বের হয়ে বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা হয়েছেন।

আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা মনে করছেন, ২০১৮ সালের সংসদ নির্বাচনে মনজুর আলমের পেছনে কেউ ছিলেন না বলে তিনি তখন স্বতন্ত্র প্রার্থী হননি। কিন্তু এবার তাকে হয়তো দলের কোনো নেতা ইন্ধন দিয়েছেন। না হয় তিনি আওয়ামী লীগের শক্তিশালী প্রার্থী মহিউদ্দিন বাচ্চুর বিরুদ্ধে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে নির্বাচন করতেন না।

চট্টগ্রাম-১০ আসনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী মহিউদ্দিন বাচ্চুর সঙ্গে মূলত প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে মনজুর আলমের। তবে এ আসনে নৌকার বিপরীতে স্বতন্ত্র প্রার্থী
হতে চেয়েছিলেন প্রভাবশালী কাউন্সিলর আবদুস সবুর লিটন। কিন্তু পরে তিনি সরে দাঁড়িয়েছেন।

২৫ নম্বর রামপুরা ওয়ার্ডের কাউন্সিলর আবদুস সবুর লিটন শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত। অপরদিকে মহিউদ্দিন বাচ্চুর সঙ্গেও নওফেলের সম্পর্ক রয়েছে।

দলীয় সূত্রে জানা গেছে, নৌকার বিপরীতে প্রার্থী হলে শিক্ষা উপমন্ত্রী নওফেল প্রশ্নবিদ্ধ হবেন-এ কারণে লিটন ভোটের মাঠ থেকে সরে যেতে বাধ্য হয়েছেন।

আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা বলছেন, লিটন স্বতন্ত্র প্রার্থী হলে মহিউদ্দিন বাচ্চু বেকায়দায় পড়ে যেতেন। কিন্তু লিটন সরে যাওয়ার পরও মহিউদ্দিন বাচ্চু নির্ভার হতে পারছেন না।

গত ৩০ জুলাই চট্টগ্রাম-১০ আসনের উপনির্বাচনে কোনো শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী না থাকায় অনায়াসে জয়ী হয়েছিলেন মহিউদ্দিন বাচ্চু। কিন্তু এবার দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে তার সামনে পথের কাঁটা হয়ে হয়ে দাঁড়িয়েছেন মনজুর আলম।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে মহিউদ্দিন বাচ্চু রাজনীতি সংবাদকে বলেন, ‘প্রার্থী দুর্বল কিংবা শক্ত হোক তাকে আমি প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে দেখি। সেই সাথে চ্যালেঞ্জও মনে করি। কারণ নির্বাচন মানেই হলো চ্যালেঞ্জ।’

ক্লিন ইমেজের প্রার্থী মনজুর আলম কি আপনার সামনে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছেন-এ প্রশ্নের জবাবে এই আওয়ামী লীগ প্রার্থী বলেন, ‘আওয়ামী লীগ সরকার গত ১৫ বছর দেশের ব্যাপক উন্নয়ন করেছেন। সেই দলের একজন প্রার্থীর বিপক্ষে কারও ব্যক্তি ইমেজ বড় হতে পারে না। কেউ বাধা হয়েও দাঁড়াতে পারবেন না। আর মনজুর আলম মেয়র হিসেবে সফল হননি। সাধারণ মানুষ তার প্রতি অসন্তুষ্ট। তিনি আওয়ামী লীগ ও বিএনপির সঙ্গে বিশ্বাস ভঙ্গ করেছেন। দুই দলের কেউ তাকে আর বিশ্বাস করেন না।’

মনজুর আলমের পেছনে আপনাদের দলের কোনো নেতার ইন্ধন রয়েছে বলে মনে করেন কি-এ প্রশ্নের উত্তরে মহিউদ্দিন বাচ্চু বলেন, ‘এদেশের ইতিহাসে বেঈমান হিসেবে মীর জাফর ও খন্দকার মোস্তাকের নাম লেখা আছে। যুগে যুগে এ ধরনের বেঈমান জন্ম নেয়। মনজুর আলমের পেছনে এরকম কোনো বেঈমান থাকলে তার মুখোশ ধীরে ধীরে উন্মোচিত হবেই।’

দলীয় একটি সূত্র জানিয়েছে, মনজুর আলমের পেছনে কে বা কারা আছেন তা চিহ্নিত করার চেষ্টা করছেন মহিউদ্দিন বাচ্চুর কর্মীরা। তারা মনজুর আলমের নির্বাচনী কর্মকাণ্ড পর্যবেক্ষণ করছেন।

২০০৮ সালের সংসদ নির্বাচনে এই আসনে মনজুর আলম আওয়ামী লীগ প্রার্থী ডা. আফছারুল আমীন ও বিএনপি প্রার্থী আবদুল্লাহ আল নোমানের বিপরীতে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছিলেন। কিন্তু তিনি মাত্র ৯ হাজার ৫৩৫ ভোট পান।

এরপর ২০১০ সালের সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মনজুর আলম বিএনপি থেকে মেয়র প্রার্থী হয়ে চমক দেখান। আওয়ামী লীগের হেভিওয়েট প্রার্থী এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরীকে প্রায় এক লাখ ভোটের ব্যবধানে পরাজিত করেন তিনি।

২০১৫ সালের সিটি করপোরেশন নির্বাচনেও মনজুর আলম বিএনপি থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। কিন্তু তিনি ভোট শুরুর তিন ঘন্টার মাথায় সরে দাঁড়ান। তবে এই তিন ঘণ্টায় তিনি ২ লাখ ৪৫ হাজার ৯৩০ ভোট পেয়েছিলেন।

নগর আওয়ামী লীগের দায়িত্বশীল নেতারা মনে করছেন, ২০১০ সালের সিটি মেয়র নির্বাচনে অপরিচিত মুখ মনজুর আলম বিএনপির প্রার্থী হওয়ার কারণে ভোটের মাঠে বাজিমাত করেছিলেন। কেবল ব্যক্তি ইমেজ দিয়ে মহিউদ্দিন চৌধুরীর মতো বাঘা নেতাকে তিনি কাবু করতে পারতেন না। যার প্রমাণ হলো, ২০০৮ সালের সংসদ নির্বাচন। ওই নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে তিনি প্রতিদ্বন্দ্বিতা তো দূরের কথা, জামানতও রক্ষা করতে পারেননি।

৮ বছর পর আবার ভোটের মাঠে লড়াই করতে নামা মনজুর আলম কি ২০১০ সালের সিটি করপোরেশন নির্বাচনের মতো বাজিমাত করবেন নাকি ২০০৮ সালের সংসদ নির্বাচনের মতো পরিণতি হবে?

রাজনৈতিক মহল মনে করছে, মনজুর আলমের ব্যক্তি ইমেজ থাকলেও তার কোনো কর্মী-সমর্থক নেই। যে কারণে দাপুটে নেতা মহিউদ্দিন বাচ্চুর সামনে তিনি কূল-কিনারা পাবেন না। মনজুর পেছনে ক্ষমতাসীন দলের কারও ছায়া থাকলেও তিনি ভোটের মাঠে তেমন একটা সুবিধা করতে পারবেন না। কারণ দলবদলের কারণে সাধারণ মানুষের কাছেও মনজুর আলমের এখন গ্রহণযোগ্যতা নেই।

তবে আওয়ামী লীগ নেতাদের অনেকের আশঙ্কা করছেন, মনজুর আলম ২০১৫ সালের সিটি করপোরেশন নির্বাচনের মতো পরিস্থিতি প্রতিকূল দেখলে ভোটের মাঠ থেকে সরে দাঁড়াতে পারেন। কারণ পরাজিত হলে তার ভাবমূর্তি একেবারে তলানিতে চলে যাবে।

আরও পড়ুন:

সুমনকে প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করছেন না লতিফ

মনজুর আলমের রাজনীতির ‘টেকনিক’

মন্তব্য করুন
Rajniti Sangbad


আরও খবর