রাজনীতি সংবাদ ডেস্ক প্রকাশের সময় :৬ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ ৭:০৪ : অপরাহ্ণ
২০২৪ সালের জানুয়ারিতে বাংলাদেশে জাতীয় সংসদ নির্বাচন। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার যদি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি মেনে না নেয়, তাহলে নির্বাচন বর্জনের হুমকি দিচ্ছে বিরোধী দলগুলো। এখন পর্যন্ত বিরোধী দলগুলোর প্রতিবাদ এবং বিক্ষোভ কর্মসূচি শান্তিপূর্ণভাবে অনুষ্ঠিত হয়েছে।
কিন্তু পরিস্থিতি যদি অচলাবস্থাতেই আটকে থাকে তাহলে সামনের দিনগুলোতেতে তা পাল্টে যেতে পারে। পরিস্থিতি বেশ জটিল। বাংলাদেশের রাজনীতিতে সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপের বেশ ভালোই ইতিহাস রয়েছে।
এবারও কি তাই ঘটবে? উদ্ভূত পরিস্থিতিতে শেষ পর্যন্ত ভারতের ভূমিকাই বা কেমন হবে?
ওয়াশিংটন ডি.সি. ভিত্তিক খ্যাতনামা ‘দ্য ডিপ্লোম্যাট’ ম্যাগাজিনের দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক সম্পাদক সুধা রামচন্দ্রনকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে এ সংক্রান্ত প্রশ্নের বেশ খোলামেলা জবাব দিয়েছেন ভারতীয় বিশ্লেষক অভিনাষ পালিওয়াল। তিনি লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব ওরিয়েন্টাল অ্যান্ড আফ্রিকান স্টাডিজ-এর সহযোগী অধ্যাপক।
অভিনাষ পালিওয়াল সতর্ক করেছেন যে, বর্তমান অচলাবস্থা চলতে থাকলে, ‘বাংলাদেশের রাজনীতি একাধিক সহিংস পথে যেতে পারে।’
তিনি বলছেন, বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর রাজনীতিতে পুনঃপ্রবেশ … আপাতত অসম্ভাব্য বলে মনে হলেও এই সম্ভাবনা ‘পুরোপুরি’ উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
‘দ্য ডিপ্লোম্যাট’ এ ইংরেজিতে প্রকাশিত সাক্ষাৎকারটির বাংলা অনুবাদ তুলে ধরা হলো-
প্রশ্ন: আওয়ামী লীগ সরকার এবং বিরোধী দলগুলোর মধ্যে সৃষ্ট অবলাবস্থায় বাংলাদেশের সামনে কি আছে?
উত্তর: এখনকার অচলাবস্থা বিদ্যমান থাকলে বাংলাদেশের রাজনীতিতে সহিংসতা বিভিন্ন পথে ধাবিত হতে পারে। প্রাথমিকভাবে, এরই মধ্যে মাঠে ছড়িয়ে পড়া রাজনৈতিক সহিংসতা সারাদেশে ছড়াতে পারে। নির্বাচন সংশ্লিষ্ট বর্তমান সহিংসতা বেশিরভাগই রাষ্ট্রপরিচালিত, যেখানে পুলিশ এবং স্থানীয় গোয়েন্দা ইউনিটগুলো বিরোধীদের টার্গেট করছে। ইসলামপন্থি এবং মূলধারার রাজনৈতিক বিরোধীদের জোরপূর্বক গুমের পর্যায়ক্রমিক ‘ক্যাম্পেইন’ এর প্রেক্ষাপটে শেখ হাসিনা সরকারের অধীনে এসব ঘটছে। এতে ক্ষমতাসীনদের মধ্যেই অসন্তোষ সৃষ্টি হয়েছে। ক্রমাগত অচলাবস্থার কারণে হতাশা বৃদ্ধি থেকে প্রধান বিরোধীদের মধ্যে যারা হার্ডলাইনে আছেন, তারা শক্তি সঞ্চয় করতে পারেন। যেমন: বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপির হার্ডলাইনের নেতাকর্মীরা চায় বর্তমান শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ বিক্ষোভ থেকে বেরিয়ে আসতে। যদি বিএনপি সহিংসতার পথে নামে, তাহলে জামায়াতে ইসলামীও স্বতন্ত্রভাবে একই পদ্ধতি অবলম্বন করতে পারে। এমন বহুপক্ষীয় সহিংসতা (যেগুলো স্থানীয় বিভিন্ন ফ্যাক্টর দ্বারা পরিচালিত হয়) থেকে (স্বল্পমেয়াদি হলেও) আইন শৃঙ্খলা ভেঙে পড়ার ঝুঁকি থাকে, তাতে বাংলাদেশের রাজনীতি গভীর ‘ফল্ট লাইনে’ চলে যেতে পারে। যার ফলে দীর্ঘমেয়াদি অস্থিতিশীলতার জন্ম হতে পারে। নির্বাচন হলেও এবং বিশেষ করে যদি (আবারো) নির্বাচনী সততায় আপোশ করা হয়, তাহলেও এই অস্থিতিশীলতা অব্যাহত থাকতে পারে। আরেকটি সম্ভাবনা হলো রাজনীতিতে ফের প্রবেশ করতে পারে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। প্রতিষ্ঠানটিতে শেখ হাসিনার অনুগতরা যেভাবে গেঁথে বসেছে তা দেখে এটি এখন অসম্ভব বলে মনে হচ্ছে। কিন্তু, শেখ হাসিনা যদি নির্বাচনী সহিংসতা নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম না হন, সেনাবাহিনীর এলিটদের আয়ত্তে আনতে অক্ষম হন, তাহলে এমন হস্তক্ষেপের সুযোগ বৃদ্ধি পাবে। সামরিক অভ্যুত্থানের দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে বাংলাদেশের। পর্যবেক্ষকরা ওইসব অভ্যুত্থানের দিকে নজর দেন, যেগুলো সফল হয়েছিলঃ ১৯৭৫ সাল, ১৯৮১-৮২ সাল এবং ২০০৭ থেকে ২০০৮ সালের অভ্যুত্থান। একই সঙ্গে অভ্যুত্থান চেষ্টার সংখ্যাও অনেক বেশি। ১৯৯৬ এবং ২০১১ সালে সামরিক অভ্যুত্থান ব্যর্থ করে দেয়া এক রকম সফলতা। ১৯৯৬ সালে সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল আবু সালেহ মোহাম্মদ নাসিম চেষ্টা করেছিলেন তখনকার বেসামরিক প্রেসিডেন্ট আবদুর রহমান বিশ্বাসকে উৎখাত করতে। তখনও এখনকার মতো নির্বাচন নিয়ে চরম মাত্রায় অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি হয়েছিল। কিন্তু সাবেক ওই সেনাপ্রধান ব্যর্থ হয়েছিলেন। কারণ, সরকারের প্রতি অনুগত কর্মকর্তারা তার নির্দেশ মানতে অপারগতা জানিয়েছিলেন। ২০১১ সালে হিজবুত তাহরিরের (অভিযোগ রয়েছে) সমর্থন নিয়ে বিদ্রোহী সেনা কর্মকর্তারা একই রকম পরিকল্পনা করেছিলেন। কিন্তু অভ্যুত্থান ঘটানোর আগেই তাদেরকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
প্রশ্ন: আপনি ‘তৃতীয় পক্ষের হস্তক্ষেপের সম্ভাবনা’ নিয়ে লিখেছেন। এ প্রেক্ষিতে আপনি সেনাবাহিনীর দিকে ইঙ্গিত করেছেন। আপনি কি ধরনের হস্তক্ষেপের কথা ভাবেন? তারা কি আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় আওয়ামী লীগ সরকারকে সমর্থন করবে? এই অচলাবস্থা ভাঙতে? নাকি অন্যকিছু?
উত্তর: এমন অবস্থার মধ্যে সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপ আওয়ামী লীগের পক্ষে যাবে বলে মনে হয় না। সর্বোপরি, আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় যদি সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপ প্রয়োজন হয়, তার মানে দাঁড়াবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এরই মধ্যে প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছেন। এ ধরনের হস্তক্ষেপ, যদি সেটা হাসিনার পক্ষেও হয়; তবু সেটা হবে তার ক্ষমতায় একটা আঘাত। দুটি কারণে আমি এমন হস্তক্ষেপকে ‘তৃতীয় পক্ষ’ ধরনের বলে মনে করি এবং একে হাসিনার ‘রিটে’র সম্প্রসারণ মনে করি না। প্রথমত, প্রাতিষ্ঠানিক শৃঙ্খলা রক্ষায় সেনাবাহিনীর আগ্রহ আছে। হাসিনাপন্থি দলাদলি এ ধরনের শৃঙ্খলাকে ক্ষুণ্ন করতে পারে এবং তাতে সেনাবাহিনীর অরাজনৈতিক ভাবমূর্তি কলঙ্কিত হতে পারে। দ্বিতীয়ত, প্রকাশ্যে আওয়ামী লীগপন্থির ঝোঁক দেখালে সেনাপ্রধান একই রকম কর্তৃত্ববাদী এবং দুর্নীতিপরায়ণ বলে সমালোচিত হবেন, যেমনটা হাসিনা হচ্ছেন। হাসিনার ব্যর্থতা এবং তার দলের অপকর্মের দায়ভার সেনাবাহিনী বহন করতে চাইবে না। এমন প্রেক্ষাপটে সেনাবাহিনী যদি হস্তক্ষেপ করে, তাহলে তারা দীর্ঘ সময়ের জন্য ক্ষমতায় থাকতে পারে অথবা দ্রুততার সঙ্গে একটি নির্ভেজাল নির্বাচন দিতে পারে। তাদের জন্য বিচক্ষণ পন্থা হবে নির্বাচন দিয়ে ব্যারাকে ফিরে যাওয়া। তবে এর অনেকটাই নির্ভর করছে বাংলাদেশের জনগণ এবং ভারত, চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মতো শক্তিধররা কিভাবে প্রতিক্রিয়া দেখায় তার ওপর। যদি দেশের ভেতরে এবং আন্তর্জাতিক মহলে সমালোচনা খুব তীব্র না হয় এবং সেনাবাহিনী যদি মনে করে যে তারা নিরাপদে নির্বাচন অনুষ্ঠান করে অবাধ ও সুষ্ঠুভাবে নির্বাচিত দলের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে পারবে, তাহলে তারা সেটা করতে পারে। এ জন্য গণতন্ত্রকে সুদৃঢ় করতে আগ্রহী সব শক্তির তরফে দক্ষ এবং ধৈর্যশীল কূটনীতির প্রয়োজন হবে। কিন্তু যদি দেশের ভেতরে এবং বাইরে থেকে, বিশেষ করে ভারত থেকে চাপ তীব্র হয়, তাহলে কোণঠাসা সেনাবাহিনী ক্ষমতা ধরে রাখার প্রয়োজন অনুভব করতে পারে এবং তারা নিজেদেরকে অনন্যোপায় হিসেবে জাতির কাছে মেলে ধরতে পারে। এটা যদি হয় তাহলে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক অভিজ্ঞতার ঘড়ি উল্টোদিকে ঘুরে যাবে। শুরু হবে এক দীর্ঘমেয়াদি অনিশ্চয়তার, যেমনটা সামরিক জান্তাদের দ্বারা পরিচালিত দেশগুলোতে ঘটে থাকে।
প্রশ্ন: এক দশকেরও বেশি সময় ধরে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ব্যারাকে অবস্থান করছে। রাজনীতির সাথে তারা কতটা জড়িয়েছে বলে মনে করেন? রাজনীতিতে বড় ভূমিকার জন্য তাদের আগ্রহ কতটা?
উত্তর: এর জন্য তিনটি আন্তঃসম্পর্কিত থিম সামনে আনা প্রয়োজন-আওয়ামী লীগের সঙ্গে সেনাবাহিনীর সম্পর্ক, জাতীয় প্রতিষ্ঠান হিসেবে তাদের নিজস্ব ভাবমূর্তি এবং তাদের আগ্রহের প্রেক্ষাপট। সশস্ত্র বাহিনী এবং হাসিনার মধ্যে সম্পর্ক চিহ্নিত হতে পারে ‘ফস্টিয়ান’ দরকষাকষিতে। যেখানে সরকার সেনাবাহিনীর নিজস্ব ইমেজকে সম্মান দেখায়, যে ইমেজ হলো অরাজনৈতিক ও পেশাদার প্রতিষ্ঠান হিসেবে। তাদের প্রতিরক্ষার জন্য উচ্চ মাত্রায় বাজেট বরাদ্দ দেওয়া হয় এবং জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী মিশনে তাদের ভূমিকাকে নিশ্চিত করা হয়। বিনিময়ে সেনাবাহিনী ইসলামপন্থিদের নির্মূল করবে এবং নিজেদের ব্যারাকে রাখবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা উপদেষ্টা তারিক আহমেদ সিদ্দিকীর (যিনি প্রধানমন্ত্রীর পরিবারেরই একজন সদস্য এবং তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে) প্রাথমিক ভূমিকা হলো এই দরকষাকষি করা। এই দরকষাকষি কিভাবে প্রথম স্থানে তাড়িত হলো। সাবেক সেনাপ্রধান মঈন ইউ আহমেদ ২০০৭ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত সেনাবাহিনী পরিচালিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধান ছিলেন। তিনি নির্বাচন অনুষ্ঠান করে বিজয়ী দল আওয়ামী লীগের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন। তবে, তা করার আগে তিনি নয়াদিল্লি থেকে এই নিশ্চয়তা নিয়েছিলেন যে, শেখ হাসিনা পরে তাকে টার্গেট করবেন না। শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হওয়ার এক মাসের মধ্যে ২০০৯ সালে তখনকার বাংলাদেশ রাইফেলসে (বিডিআর) বিদ্রোহ হলে ওই অ্যারেঞ্জমেন্ট পরীক্ষার মুখে পড়ে। বিদ্রোহ যখন চূড়ান্ত রূপে তখন শেখ হাসিনার পক্ষে সামরিক হস্তক্ষেপের হুমকি দিয়েছিল নয়াদিল্লি। ভারতে তখনকার কংগ্রেস নেতৃত্ব আশঙ্কা করেছিলেন যে, যদি জেনারেল মঈন ইউ আহমেদ বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে শক্তি প্রয়োগ করেন, তাহলে তা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ক্ষমতাকে ক্ষুণ্ন করতে পারে এবং অকালে তার ক্ষমতাচ্যুতি বা তার চেয়েও খারাপ কিছু ঘটতে পারে। সেনাবাহিনী বিদ্রোহ নিয়ন্ত্রণ করেছিল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর একেবারে চোখের সামনে। তারপর অফিসারদের দুর্দশার কথা শুনে সফলভাবে তাদেরকে শান্ত করেন প্রধানমন্ত্রী হাসিনা। সাম্প্রতিক রোহিঙ্গা সংকট; প্রতিরক্ষা খাতে উচ্চ বাজেট বরাদ্দ ও আন্তর্জাতিক প্রতিরক্ষা চুক্তি আকর্ষণে হাসিনার ক্ষমতা হ্রাস এবং র্যাবের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার জন্য এমন দরকষাকষি ক্ষতিগ্রস্ত হলেও নির্মূল হয়ে যায়নি। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী দীর্ঘদিন ধরে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর ব্যাপারে সতর্ক এবং তারা প্রত্যাশিতভাবে রোহিঙ্গা সংকটকে নিরাপত্তা সংশ্লিষ্ট দৃষ্টিকোণ থেকেই দেখেছে। রাজনৈতিক কারণে মিয়ানমারের সামনে দাঁড়াতে না পারা এবং সক্ষমতায় ঘাটতির কারণে অফিসার কোর এবং পদস্থ সদস্যদের মধ্যে অস্বস্তিকর অনুভূতির সৃষ্টি করেছে। এই সংকট সমাধানে শেখ হাসিনার ব্যর্থতা নিয়ে বিরোধীদের ক্রমবর্ধমান সমালোচনা সেনাবাহিনীর ভেতরে এবং বাইরে উভয়েই গ্রহণ করেছে। যুক্তরাষ্ট্র নেতৃত্বাধীন নিষেধাজ্ঞার পাশাপাশি এ অবস্থায় গ্যারিসনে একটি ‘আন্ডারকারেন্ট’ রয়েছে, যা দোলাচ্ছেন শেখ হাসিনা; যদি বিপদ না হয়, তাহলে এটা হতে পারে সামরিক-বেসামরিক দরকষাকষির অংশ। রোহিঙ্গা সংকটকে যদি সেনাবাহিনীর সামরিক ক্ষমতার প্রতি অবমাননা হিসেবে দেখা হয়, তাহলে প্রতিরক্ষা তহবিল কমিয়ে দেয়া এবং সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞার ঝুঁকিতে তাদের ভাবমূর্তি এবং আগ্রহ একইভাবে নষ্ট হতে পারে। বাংলাদেশে সামরিক অভ্যুত্থানের ইতিহাস এবং বেসামরিক-সামরিক সম্পর্কের মধ্যে উদ্ভূত কঠোর ‘আন্ডারকারেন্টের’ পরিপ্রেক্ষিতে, তৃতীয় পক্ষের হস্তক্ষেপকে কেউ পুরোপুরি অস্বীকার করতে পারেন না।
প্রশ্ন: আওয়ামী লীগ এই দৃষ্টিভঙ্গি প্রচারের লক্ষ্য নিয়েছে যে, বিএনপি ও তার মিত্ররা যদি বিজয়ী হয় তাহলে বাংলাদেশে ইসলামপন্থি শক্তির উত্থান ঘটবে। তাদের এই দাবি কতটা বিশ্বাসযোগ্য? ইসলামপন্থিরা বাংলাদেশে কতটা শক্তিশালী?
উত্তর: কোনো সন্দেহ নেই যে, বাংলাদেশে ইসলামপন্থিরা, বিশেষ করে জামায়াতে ইসলামী ‘রাজনৈতিকভাবে মৃতের’ কাছাকাছি থেকে অনেক দূরে। কিন্তু তাদের আর আগের মতো তীব্র শক্তি নেই। এর কারণ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জামায়াতে ইসলামীর নেতৃত্বকে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের মাধ্যমে সফলভাবে দমন করেছেন। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় জামায়াতের যেসব সহযোগী পাকিস্তানের সঙ্গে ছিল তাদের বিচার করার জন্য অভ্যন্তরীণভাবে আওয়ামী লীগ সরকার এই আদালত গঠন করেছিল। এর সঙ্গে হেফাজতে ইসলামীর কিছু অংশের সক্রিয় সহযোগিতার ফলে হাসিনা ইসলামপন্থিদের রাজনৈতিক শক্তিকে ভোঁতা করে দিয়েছেন। যদি কিছু থেকে থাকে, তা হলো- তার নিজের রক্ষণশীলতা যা বাংলাদেশে ও ভারতে ধর্মনিরপেক্ষদের মধ্যে অস্বস্তি সৃষ্টি করেছে। এখানে বিএনপির বিজয়ে ইসলামপন্থিদের উত্থান ঘটবে বলে আওয়ামী লীগ যে দাবি করছে, তা আসলে সত্যকে অতিরঞ্জিত করা। এ থেকে মুক্তি পেতে বিএনপি জামায়াতের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করেছে। ২০০১ থেকে ২০০৬ সালের বিএনপি-জামায়াতের জোট সরকারের সময়ে ইসলামপন্থিদের যে সহিংসতা দেখা গেছে, তা থেকে বেরিয়ে আসার জন্য এমনটা করছে তারা। ওই সময় বিরোধী দলে থাকা শেখ হাসিনার ওপর বোমা হামলা হয়েছিল, এতে তিনি মৃত্যুর খুব কাছে থেকে ফিরে এসেছেন। বিএনপি বর্তমান পরিস্থিতিতে একটি ধর্মনিরপেক্ষ শক্তি হিসেবে নিজের স্বাধীন রাজনৈতিক জায়গা তৈরি করতে চায় এবং আপাতত তারা দূরত্ব বজায় রেখেছে জামায়াতে ইসলামী থেকে। ফলে, বিএনপি বিজয়ী হলে রক্ষণশীলরা শক্তিশালী হলেও হতে পারে; কিন্তু, সেটা ইসলামপন্থিদের আন্তঃসীমান্ত সহিংসতা অথবা বাংলাদেশের ভিতরে হিন্দু ও বৌদ্ধদের বিরুদ্ধে সহিংসতায় পরিণত হবে কিনা তা এখনও অনিশ্চিত।
প্রশ্ন: চীনের সঙ্গে বিএনপির উষ্ণ সম্পর্ক ছিল। আওয়ামী লীগের সময়ে বাংলাদেশে পদচিহ্ন সম্প্রসারণ করেছে চীন। বাংলাদেশে উদ্ভূত এই সংকটের সমাধান কি?
উত্তর: চীন দৃঢ়ভাবে আওয়ামী লীগকে সমর্থন করছে। বহু বিবৃতিতে তারা তাদের এই অবস্থান পরিষ্কার করেছে। দক্ষিণ আফ্রিকায় অনুষ্ঠিত সাম্প্রতিক ব্রিকস সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সাক্ষাৎ করেন চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সঙ্গে। সেখানে এমনই বার্তা দেয়া হয়েছে। এর বিপরীতে, বিএনপির সঙ্গে চীনের উষ্ণ সম্পর্ক রয়েছে বলা হলেও দলটি যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের কাছ থেকে চীনের তুলনায় দৃঢ় সমর্থন পাচ্ছে। পশ্চিমা দেশগুলোকে বিএনপি এই ইঙ্গিত দিচ্ছে যে, চীনের কাছ থেকে বাংলাদেশকে পুরোপুরি ফিরিয়ে আনা না গেলেও তাদের প্রভাব কমিয়ে আনা হবে। তার মানে, আমরা দেখছি এমন এক পরিস্থিতি, যেখানে শেখ হাসিনাকে চীন এবং ভারত উভয়ই সমর্থন করছে। যদিও দেশ দুটি একে অন্যকে ছাড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। এখন ভারতের জন্য সবচেয়ে বড় ঝুঁকি হলো চীনের প্রভাবে হাসিনাকে রাজনৈতিকভাবে হারিয়ে ফেলা; বিএনপির মধ্যে নিজের জায়গা তৈরি কিংবা জাতীয় পার্টির মতো ছোট দলগুলোর (যাদের জনসমর্থনে ঘাটতি আছে) সাথে কাজ করতে ব্যর্থ হওয়া। নয়াদিল্লি এবং বিএনপির মধ্যে কৌশলগত কথোপকথনের অভাব বাংলাদেশে ব্যাপক কৌশলগত সমতা নিয়ে ভারতকে পীড়া দেয়। কিন্তু বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালীন ভারত প্রশ্রয় দিলেও সে সময় ভারতের উদ্বেগের বিষয়ে সত্যিকার অর্থে সমাধান দেয়া থেকে দূরে ছিল বিএনপি। ফলাফল হিসেবে সৃষ্টি হয়েছে অবিশ্বাস। এর ফলে বন্ধনের সেতু নির্মাণের যেকোনো প্রচেষ্টা (সাম্প্রতিক সময়েও বেশকিছু) তেমন কোনো ফল দেয়নি। আমি মনে করি, যুক্তরাষ্ট্র এবং ভারতের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ কথোপকথন অনেকদূর এগিয়ে নিতে পারে। ওয়াশিংটন যদি ভারতকে আশ্বস্ত করতে পারে যে, তারা বিএনপিকে ভারতের কৌশলগত স্বার্থবিরোধী কোনো কিছু করা থেকে বিরত রাখবে, ইসলামপন্থিদের প্রভাব সীমিত করবে এবং চীনের স্বার্থকে নিয়ন্ত্রণ করবে; তাহলে হয়ত সম্মতির একটি সম্ভাবনা থাকতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের তরফ থেকে এমন গ্যারান্টি ছাড়া, ভারত বিএনপির ক্ষমতায় যাওয়া মানবে বলে মনে হয় না। বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক সততার বিনিময়ে হলেও সেই সম্ভাবনা নেই।
প্রশ্ন: বাংলাদেশে আগের নির্বাচনগুলোর তুলনায় এবার ভারত অনেকটাই নীরব। কেন?
উত্তর: বাংলাদেশ সম্পর্কে সেভাবে ভারতীয় বিবৃতি আসছে না। বর্তমান অচলাবস্থার বিষয়ে স্পষ্ট অবস্থানও দেখা যাচ্ছে না ভারত। এর অর্থ এই নয় যে, ভারত নীরবতা রক্ষা করে চলেছে। এমনটা যদি হয়েও থাকে তার মানে, ভারতীয় কর্মকর্তারা মাঠ পর্যায়ের পরিস্থিতি নিয়ে ওভারটাইম কাজ করছেন, একাধিক পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন, তারা এমন একটি ফলাফল বের করার চেষ্টা করছেন, যাতে ভারতের স্বার্থ থাকে এবং একই সঙ্গে বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের দৃষ্টিতে বৈধতা থাকে। উদাহরণ হিসেবে জাতীয় পার্টির শীর্ষ নেতৃত্ব সম্প্রতি নয়াদিল্লি সফর করেছেন। যুক্তরাষ্ট্র এবং ভারতের মধ্যে বাংলাদেশ ইস্যুতে যোগযোগও বৃদ্ধি পেয়েছে। পরিষ্কার কথা হলো, অন্য প্রার্থীদের তুলনায় শেখ হাসিনাকে পছন্দ করে ভারত। কিন্তু, আওয়ামী লীগের নির্বাচনী অনিয়মের যে কূটনৈতিক ক্ষতি তা চিরতরে (ভারত) বহন করতে চায় কিনা, সেটাই এখন প্রশ্ন। ওই সিদ্ধান্ত এখনো নেওয়া হয়নি। বলা হয় যে, (ভারত ও বাংলাদেশ) এই দুটি দেশের ভূগোল এবং ইতিহাস এমন যে তারা সবসময়ই একে অন্যের সঙ্গে বাঁধা থাকবে। আয়তনে অসমতার কারণে, ভারতের বেশিরভাগ মানুষের চেয়ে এ বিষয়টি বাংলাদেশিরা তীব্রভাবে বোঝেন।
সূত্র: মানবজমিন