শুক্রবার, ২২ নভেম্বর, ২০২৪ | ৭ অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ | ১৯ জমাদিউল আউয়াল, ১৪৪৬

মূলপাতা দেশজুড়ে

পাগলা মসজিদের কে সেই ‘পাগলা সাহেব’


কিশোরগঞ্জের ঐতিহাসিক পাগলা মসজিদ

রাজনীতি সংবাদ ডেস্ক প্রকাশের সময় :৭ মে, ২০২৩ ১২:০২ : অপরাহ্ণ

কিশোরগঞ্জের ঐতিহাসিক পাগলা মসজিদের দানবাক্স খুললেই মেলে কোটি টাকা। প্রতি তিন মাস পর পর মসজিদের আটটি দানবাক্স খোলা হয়। বিপুল পরিমাণ টাকা ছাড়াও দানবাক্সে পাওয়া যায় বৈদেশিক মুদ্রা ও স্বর্ণালংকার।

দানবাক্সে কী পরিমাণ টাকা জমা পড়লো সে হিসাবের অপেক্ষায় থাকেন অনেকে। টাকা গণনা দেখতে দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে ছুটে আসেন উৎসাহী মানুষ। ঠিক এ কারণেই পর্যটকদেরও পছন্দের জায়গায় পরিণত হয়েছে এই ঐতিহাসিক মসজিদটি।

শহরের পশ্চিমে নরসুন্দা নদীর তীরে অবস্থিত প্রায় আড়াইশ বছরের পুরোনো ঐতিহাসিক এই পাগলা মসজিদ। এর ইমরাত খুবই সুন্দর এবং নির্মাণশৈলীও বেশ চমৎকার।

তিন তলা বিশিষ্ট পাগলা মসজিদের ছাদে তিনটি বড় গম্বুজ এবং ৫ তলা ভবনের সমান একটি মিনার বহুদূর থেকে সহজেই দৃষ্টি কাড়ে।

এই মসজিদ সম্পর্কে বেশ কিছু জনশ্রুতি প্রচলিত আছে।

জনশ্রুতি আছে, কিশোরগঞ্জের ঐতিহাসিক হয়বতনগর জমিদার বাড়ির ঈসা খান-এর বংশধর দেওয়ান জিলকদর খান ওরফে জিল কদর ‘পাগলা সাহেব’ নামক একজন আধ্যাতিক ব্যক্তি নরসুন্দা নদীর তীরে বসে নামাজ পড়তেন। পরবর্তীতে স্থানটিতে মসজিদটি নির্মত হয়। জিল কদর পাগলার নামানুসারে মসজিদটি ‘পাগলা মসজিদ’ হিসেবে পরিচিতি পায়।

আরেকটি জনশ্রুতি প্রচলিত আছে। সেটা হলো-এক দিন দেখা গেল নদীর প্রবল স্রোতধারার মধ্যে মাদুরে আসন পেতে এক সাধক পুরুষ ভেসে আসছেন। তিনি প্রায় মাঝ নদীতে স্থির হয়ে যান। এভাবেই কয়েক দিন কেটে যায়। এরপর কয়েক দিনের মধ্যে সে স্থানটি শুকিয়ে চরে পরিণত হয়। কিন্তু সাধক তখনও ধ্যানে মগ্ন। স্থানীয় জেলেরা নদীতে মাছ ধরতে এসে এই দৃশ্য দেখে বিস্মিত হয়ে যান। তার পরের ঘটনা আরও চমকপ্রদ। পাশের রাখুয়াইল এলাকার জনৈক গোয়ালার একটি গাভী দুধ দিচ্ছিল না। গোয়ালা শত চেষ্টা করেও গাভীর বাঁট (ওলান) থেকে বের করতে পারছিলেন না এক ফোঁটা দুধও। গাভীটিকে নজরে রাখা হলো পুরো একটা দিন। দেখা গেল পাল থেকে হঠাৎ গাভীটি বিচ্ছিন্ন হয়ে পালাচ্ছে। তারপর নদী সাঁতরে সেই সাধকের চরায় উঠে আসে। সাধকের কাছে একটা পাত্র ছিল। গাভিটি সেই পাত্রে ওলানের সব দুধ ঢেলে দেয়। তারপর নদী সাঁতরে আবার ফিরে আসে পালে। কয়েকদিন এই ঘটনার পুনরাবৃত্তি লক্ষ করেন গোয়ালা। তিনি নিশ্চিত হন, এ সাধক সত্যিকারের একজন কামেল পুরুষ। গোয়ালা পরম ভক্তি নিয়ে এক দিন সেই সাধক পুরুষের শিষ্যত্ব গ্রহণ করলেন। কিছুদিনের মধ্যে গোয়ালার অবস্থা। অভাবনীয় উন্নতি হলো। তার এই উন্নতি অন্যদেরও মধ্যেও সাড়া ফেলে দেয়। রাখুয়াইলসহ আশপাশের এলাকার তাঁতি, জেলেসহ বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষ দলে দলে শিষ্যত্ব গ্রহণ করতে লাগল। সাধক পুরুষের অলৌকিকতার খ্যাতি চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে দিকিবিদিক। সেই শিষ্যরা সাধকের সেই চরাভূমিতে একটি হুজরাখানা তৈরি করে দেন। মৃত্যুর পর সাধককে হুজরাখানার পাশেই সমাহিত করা হয় এবং সেখানেই নির্মাণ করা হয় মসজিদ। সেটাই পরে পাগলা মসজিদ নামে পরিচিতি পায়। এই কাহিনি পুরোটাই জনশ্রুতিনির্ভর। এর পক্ষে কোনো ঐতিহাসিক প্রমাণ নেই।

অপর জনশ্রুতি অনুসারে, তৎকালীন কিশোরগঞ্জের হয়বতনগর জমিদার পরিবারের এক নিঃসন্তান বেগমকে জনগণ ‘পাগলা বিবি’ বলে ডাকত। দেওয়ানবাড়ির এ বেগম নরসুন্দার তীরে স্বপ্নাদিষ্ট হয়ে একটি মসজিদ নির্মাণ করলে ‘পাগলা বিবির মসজিদ’ নামে পরিচিতি পায়।

আধুনিক স্থাপত্যশৈলীতে নির্মিত এই মসজিদটির বর্তমান জমির পরিমাণ ৩ একর ৮৮ শতাংশ। যা নির্মাণ কালে ছিলো কেবল ১০ শতাংশ জমির উপর।

পাগলা মসজিদটি শুধু ইসলাম ধর্মাবলম্বীর কাছে নয়, বৃহত্তর ময়মনসিংহ ও এর আশেপাশের অঞ্চলে সব ধর্মাবলম্বীর কাছে অত্যন্ত পবিত্র ধর্মীয় স্থান হিসেবে পরিগণিত। এই মসজিদে মানত কিংবা দান খয়রাত করলে মনোবাসনা পূর্ণ হয়- এমন বিশ্বাস থেকে বিভিন্ন বয়সী হিন্দু-মুসলিমসহ নানা ধর্ম-বর্ণের নারী-পুরুষ মানত নিয়ে এখানে আসেন।

ফলে সাধারণ মানুষ এমন বিশ্বাসের আলোকে পাগলা মসজিদে প্রচুর দান-খয়রাত করে থাকেন। নগদ টাকা-পয়সা, স্বর্ণ ও রুপার অলংকারের পাশাপাশি গরু, ছাগল, হাঁস-মুরগি দান করেন।

বিশেষ করে প্রতি শুক্রবার এ মসজিদে মানত নিয়ে আসা বিভিন্ন বয়সী নারী-পুরুষের ঢল নামে। (প্রসঙ্গত এই ধরনের বিশ্বাস ও চিন্তা কুসংস্কারের অংশ ও শরিয়তবিরোধী।)

অধিক দান-খয়রাতের কারণে পাগলা মসজিদ ইতিমধ্যেই দেশের অন্যতম আয়কারী ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে। জানা যায় সাধারণত প্রতি চারমাস পরপর মসজিদের দানবাক্স খোলা হয়।

প্রতিবার দানবাক্স খোলার পর কোটি কোটি টাকা পাওয়া যায়। এছাড়াও আরো পাওয়া যায় ডলার, ইউরো, সৌদি রিয়েল, ইয়েন, দিনারসহ ইত্যাদি বিদেশি মুদ্রা। এমনকি বিভিন্ন সময়ে স্বর্ণালংকার পাওয়া গেছে দান বাক্স থেকে।

গত ৬ মে পাগলা মসজিদের আটটি দানবাক্স খোলা হয়। এতে রেকর্ড ৫ কোটি ৫৯ লাখ ৭ হাজার ৬৮৯ টাকা পাওয়া গেছে। এ ছাড়া একটি ডায়মন্ডের নাকফুলসহ বৈদেশিক মুদ্রা ও স্বর্ণালঙ্কার পাওয়া গেছে।

আরও পড়ুন: পাগলা মসজিদের দানবাক্সে এবার মিললো রেকর্ড ৫ কোটি ৫৯ লাখ টাকা

তার আগে গত ৭ জানুয়ারি দানবাক্স খোলা হয়েছিল। ২০টি বস্তায় তখন ৪ কোটি ১৮ লাখ ১৬ হাজার ৭৪৪ টাকা এবং বৈদেশিক মুদ্রা ও স্বর্ণালঙ্কার পাওয়া গিয়েছিল।

এই মসজিদের আয়ের একটা অংশ আশেপাশের অন্যান্য মসজিদ, মাদ্রাসা, এতিমখানা সহ বিভিন্ন উন্নয়ন ও সেবামূলক খাতে ব্যয় করা হয়। এছাড়া ২০০২ সালে মসজিদের পাশে একটি হাফেজিয়া মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। ক্যান্সার, কিডনি রোগে আক্রান্ত দরিদ্র ব্যক্তিদেরও এই তহবিল থেকে সাহায্য দেয়া হয়।

বর্তমানে লেকসিটি প্রকল্পের আওতায় পাগলা মসজিদের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া নরসুন্দা নদী খনন, দৃষ্টিনন্দন সেতু নির্মাণ, মসজিদের শোভাবর্ধন এবং রঙিন আলোকসজ্জার জন্য দিনে ও রাতে মসজিদটি দেখতে চমৎকার লাগে।

দেশের দূরদূরান্ত থেকে নানা শ্রেণী পেশার মানুষ মসজিদটি দেখতে ভিড় জমান। বিশেষত জুমার নামাজের সময় অত্যাধিক মানুষের সমাগমে মসজিদ পরিপূর্ণ হয়ে যায়।

মুসল্লিদের সুবিধার্থে মসজিদের পরিসর আরও বিস্তৃত করতে মসজিদ ও ইসলামিক কমপ্লেক্সের জন্য ১০০ কোটি টাকা ব্যয়ে প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। যা বাস্তবায়ন হলে ৫০ হাজার মুসল্লি একসাথে নামাজ আদায় করতে পারবেন।

মন্তব্য করুন
Rajniti Sangbad


আরও খবর