রাজনীতি সংবাদ প্রতিবেদন, চট্টগ্রাম প্রকাশের সময় :১৬ মার্চ, ২০২৩ ১০:৩০ : পূর্বাহ্ণ
চট্টগ্রাম-৮ (বোয়ালখালী-চান্দগাঁও) আসনে উপনির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর থেকে মনোনয়ন পেতে দৌড়ঝাঁপ শুরু করেছেন আওয়ামী লীগের সম্ভাব্য প্রার্থীরা। অনেকে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ করছেন, অনেকে ক্ষমতাধর মন্ত্রী-এমপির আশীর্বাদ নেওয়ার চেষ্টা করছেন।
মনোনয়ন প্রত্যাশীরা এখন নির্বাচনী প্রচারণায় সরাসরি নামতে না পারলেও কৌশলে মাঠে প্রচার-প্রচারণা ও গণসংয়োগ শুরু করেছেন। অনেকে সামাজিক যোগযোগ মাধ্যমকে ব্যবহার করে মনোনয়ন প্রত্যাশী হিসেবে নিজেদের জানান দিচ্ছেন ।
শহর আর গ্রামের মেলবন্ধনে গঠিত এই আসনে আগামী ২৭ এপ্রিল উপনির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। নির্বাচনে মনোনয়ন প্রত্যাশীর সংখ্যা ১৬ জন। এদের মধ্যে তরুণ-প্রবীণ নেতাদের পাশাপাশি রয়েছেন কয়েকজন শিল্পপতিও। রয়েছেন সাবেক দুই সাংসদের সহধর্মিনীও।
এই আসনটিতে এ নিয়ে দুই দফা উপনির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। ২০১৯ সালের ৭ নভেম্বর সংসদ সদস্য মইন উদ্দীন খান বাদল মারা গেলে প্রথম দফায় আসনটি শূন্য হয়।
এরপর ২০২০ সালের ১৩ জানুয়ারি উপনির্বাচনে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মোছলেম উদ্দিন আহমদ। তিনি গত ৬ ফেব্রুয়ারি মারা যান। এরপর আসনটি দ্বিতীয়বারের মতো শূন্য হয়।
২০২০ সালের ১৩ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত উপনির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী মোছলেম উদ্দিন আহমদের প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন বিএনপির প্রার্থী আবু সুফিয়ান।
কিন্তু এবার এই উপনির্বাচনে অংশ নিচ্ছে না বিএনপি। কোনো শক্ত স্বতন্ত্র প্রার্থীও নেই । ফলে এই উপনির্বাচনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ থেকে যিনি মনোনয়ন পাবেন, তার জয় সুনিশ্চিত।
তাই এই উপনির্বাচনকে সামনে রেখে ‘মনোনয়ন যুদ্ধে’ অবতীর্ণ হয়েছেন আওয়ামী লীগের ১৬ জন মনোনয়নপ্রত্যাশী।
এরা হলেন-চট্টগ্রাম নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক সিটি মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন, নগর আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ ও চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) সাবেক চেয়ারম্যান আবদুচ ছালাম, দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সহসভাপতি ও কুয়েতের সাবেক রাষ্ট্রদূত এস এম আবুল কালাম, বিএনএফ সভাপতি ও ঢাকা-১৭ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য এস এম আবুল কালাম আজাদ, দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক আবদুল কাদের সুজন, সাবেক মন্ত্রী নুরুল ইসলাম বিএসসি’র পুত্র মুজিবুর রহমান, আওয়ামী লীগের কৃষি ও সমবায়বিষয়ক উপকমিটির সদস্য মুহাম্মদ মোস্তাফিজুর রহমান লিটন, প্রয়াত সংসদ সদস্য মোছলেম উদ্দিন আহমদের স্ত্রী শিরিন আহমদ, প্রয়াত সংসদ সদস্য মইন উদ্দীন খান বাদলের স্ত্রী সেলিনা খান, বিজিএমইএ নেতা ও শিল্পপতি এস এম আবু তৈয়ব, জন্মাষ্টমী উদযাপন পরিষদ বাংলাদেশের সভাপতি ও শিল্পপতি সুকুমার চৌধুরী, নগরীর জামালখান ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর প্রকৌশলী বিজয় কিষাণ চৌধুরী, চট্টগ্রাম নাগরিক ফোরামের চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার মনোয়ার হোসেন, এপিপি কামাল পাশা, ওমর গণি এমইএস কলেজ ছাত্রসংসদের জিএস আরশেদুল আলম বাচ্চু এবং ‘আমরা মুক্তিযোদ্ধার সন্তান’ সংগঠনের চট্টগ্রাম মহানগরের সাধারণ সম্পাদক আশেক রসুল খান (বাবু)।
সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, ১৬ জন মনোনয়নপ্রত্যাশীর মধ্যে আলোচনায় এগিয়ে আছেন দুজন। এরা হলেন-সিডিএ’র সাবেক চেয়ারম্যান আবদুচ ছালাম ও প্রয়াত সংসদ সদস্য মোছলেম উদ্দিন আহমদের স্ত্রী শিরিন আহমদ।
দেশের শীর্ষস্থানীয় শিল্প পরিবার ওয়েল গ্রুপের চেয়ারম্যান আবদুচ ছালাম ওই সংসদীয় এলাকার মোহরায় বসবাস করেন। সিডিএ’র চেয়ারম্যান পদে টানা ১০ বছর দায়িত্ব পালন করেছেন এই আওয়ামী লীগ নেতা। ১০ বছরে ফ্লাইওভার, আউটার রিং রোডসহ বড় বড় মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন করে তিনি নগরবাসীকে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন।
সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্রগুলো জানিয়েছে, চট্টগ্রাম-৮ আসনের প্রধান সমস্যা হলো কালুরঘাট নেতু। যা ওই এলাকার মানুষের দীর্ঘ দিনের দাবি। প্রয়াত দুজন সংসদ সদস্য কালুরঘাট নতুন সেতু বাস্তবায়নের আশ্বাস দিয়েও তা করতে পারেননি। এ নিয়ে সরকারের প্রতি ওই এলাকার মানুষের মধ্যে চরম ক্ষোভ জন্মেছে। সরকারের জন্য এটা এখন চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ অবস্থায় এই সেতু দ্রুত বাস্তবায়নের জন্য উন্নয়নমূলক কাজে দক্ষ ও অভিজ্ঞ একজন জনপ্রতিনিধি প্রয়োজন। সেদিক থেকে চট্টগ্রামে বড় বড় মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন করা আবদুচ ছালাম হলেন সবচেয়ে উপযুক্ত। এ ছাড়া তার রয়েছে ক্লিন ইমেজ।
সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানিয়েছে, চট্টগ্রামের একটি বড় শিল্প গ্রুপের কর্ণধার আবদুচ ছালামের মনোনয়নের জন্য সরকারের উচ্চ পর্যায়ে তদবির করছেন। এ ছাড়া চট্টগ্রামের একজন প্রভাবশালী নেতা, একজন মন্ত্রী ও দুজন এমপি ছালামের মনোনয়নের জন্য তৎপরতা চালাচ্ছেন।
এসব কারণে মনোনয়ন দৌড়ে এগিয়ে আছেন আবদুচ ছালাম।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে আবদুচ ছালাম রাজনীতি সংবাদকে বলেন, ‘একজন রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে আমি মনোনয়ন চাইছি। ২০০৮ ও ২০১৪ সালের সংসদ নির্বাচনেও চট্টগ্রাম-৮ আসন থেকে আমাকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু মহাজোটের প্রার্থীর কারণে আমার নেত্রীর (প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা) সিদ্ধান্ত মেনে সরে দাঁড়িয়েছিলাম। এবার উপনির্বাচনে মহাজোটের কোনো সমীকরণ নেই। এই এলাকার উন্নয়নের জন্য নেত্রী যদি আমাকে উপযুক্ত মনে করেন, তাহলে ইনশাআল্লাহ তিনি নমিনেশন দেবেন।’
আবদুচ ছালামের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মনোনয়ন দৌড়ে এগিয়ে আছেন মোছলেম উদ্দিন আহমদের সহধর্মিনী শিরিন আহমদও। আবদুচ ছালামের সামনে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেন তিনি।
কিন্তু শিরিন আহমদ আছেন সবার আড়ালে। ভোটের মাঠে তার কোনো তৎপরতাও নেই। মনোনয়নের জন্য তিনি কোনো দৌড়ঝাঁপও করছেন না। কিন্তু আড়ালে থেকেও নানা সমীকরণে দলীয় মহলে তিনি আলোচনায় আছেন।
জানা গেছে, শিরিন আহমদকে রাজনীতির মাঠে এখন প্রকাশ্যে দেখা না গেলেও তিনি ১৯৬৯ সালে চট্টগ্রাম নগরীর লালখান বাজার ওয়ার্ড ছাত্রলীগের নেত্রী ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের পর তিনি মহিলা আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গেও যুক্ত হয়েছিলেন। বিয়ের পর তিনি রাজনীতির মাঠ ছেড়ে দিলেও মোছলেম উদ্দিন আহমদের সকল রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে তিনি নেপথ্যে সহযোগিতা করেছেন।
চট্টগ্রাম নগরীর লালখান বাজার হাইলেভেল রোডে বসবাস করেন শিরিন আহমদ।
জানা গেছে, ১৯৯৬ ও ২০০৬ সালে সরকারবিরোধী আন্দোলনের সময় আমির হোসেন আমু, তোফায়েল আহমেদ, ওবায়দুল কাদেরসহ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা চট্টগ্রামে আসলে খাবার খেতে ছুটে যেতেন মোছলেম উদ্দিনের বাসায়। তাদেরকে নিজ হাতে রান্না করে আপ্যায়ন করতেন শিরিন আহমদ। সেই সুবাদে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় অনেক নেতার সঙ্গে শিরিন আহমদের সুসম্পর্ক রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও ব্যক্তিগতভাবে শিরিন আহমদকে চেনেন। ১৯৮০ সালে ভারতের দিল্লিতে একটি হোটেলে শেখ হাসিনাকে দেখতে গিয়েছিলেন শিরিন আহমদ।
সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানিয়েছে, শিরিন আহমদ দৌড়ঝাঁপ না করলেও তিনি আড়ালে থেকে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করছেন। আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের সঙ্গেও তার কথা হয়েছে। তিনি শিরিন আহমদকে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাত করতে পরামর্শ দিয়েছেন। শিরিন আহমদ এখন প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাতের চেষ্টা করছেন।
সূত্রটি জানিয়েছে, দেশের বিভিন্ন উপনির্বাচনে অনেক প্রয়াত সংসদ সদস্যের স্ত্রীকে আওয়ামী লীগ সভাপতি মনোনয়ন দিয়েছেন। মোছলেম উদ্দিন এমপি হওয়ার তিন বছরের মাথায় মারা গেছেন। তিনি তার মেয়াদ শেষ করতে পারেননি। এ অবস্থায় মোছলেম উদ্দিনের বাকি থাকা মেয়াদ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী শিরিন আহমদকে সুযোগ দিতে পারেন।
জানতে চাইলে শিরিন আহমদ রাজনীতি সংবাদকে বলেন, ‘কালুরঘাট সেতু নিয়ে মোছলেম সাহেবের অনেক আক্ষেপ ছিল। তিনি এ নিয়ে ঢাকায় অনেক দৌড়ঝাঁপ করেছেন। কিন্তু তিনি সেটি করে যেতে পারলেন না। আমি মোছলেম সাহেবের এই স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে মনোনয়ন চাইছি। রাজনীতিতে যাদের কোনো অভিজ্ঞতা নেই প্রধানমন্ত্রী এমন অনেক নেতাকে মূল্যায়ন করেছেন। তিনি কাকে কী করেন সেটা কেউ বলতে পারে না। আমিও সেই আশায় আছি। তবে আমার পলিটিক্যাল ক্যারিয়ার ছিল। ১৯৬৯ সালে আমি ছাত্রলীগ ও মহিলা লীগের রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলাম। পরে আমি সংসারের জন্য সক্রিয় রাজনীতি থেকে সরে আসি। তবে স্বামীর সকল রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে নেপথ্যে সহযোগিতা করেছি।’
আবদুচ ছালাম ও শিরিন আহমদ ছাড়া চট্টগ্রামের রাজনৈতিক অঙ্গনে আ জ ম নাছির উদ্দীন ও এস এম আবুল কালামের নামও আলোচনায় আছে। কিন্তু নানা সমীকরণে মনোনয়ন দৌড়ে তারা পিছিয়ে আছেন বলে সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানিয়েছে ।
নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির হলেন নগরীর কোতোয়ালী আসনের বাসিন্দা। আর দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সহসভাপতি আবুল কালাম হলেন বোয়ালখালীর বাসিন্দা।
সংশ্লিষ্ট সূত্রটি জানিয়েছে, চট্টগ্রামে আওয়ামী লীগের মূল কাঠামো হলো মহানগর। আর মহানগর আওয়ামী লীগ এখন কার্যত আ জ ম নাছিরের ওপর নির্ভরশীল। সংগঠনটি এখন তৃণমূলে ইউনিট সম্মেলন করছে। এরপর মহানগরের সম্মেলন হবে। এরমধ্যে বিএনপির আন্দোলন মোকাবেলায় শান্তি সমাবেশ কর্মসূচি পালন করতে হচ্ছে সংগঠনটিকে। এ ছাড়া সামনে জাতীয় নির্বাচন ও বিএনপির আন্দোলন নিয়ে সাংগঠনিকভাবে ব্যাপক প্রস্তুতির বিষয় আছে। এ অবস্থায় আ জ ম নাছিরকে চট্টগ্রাম-৮ আসনে মনোনয়ন দেওয়ার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় একজন নেতা রাজনীতি সংবাদকে বলেন, মহানগর আওয়ামী লীগের কমিটি ভাঙার জন্য দীর্ঘ দিন ধরে সংগঠনটির একটি পক্ষ চেষ্টা চালিয়ে আসছে। চট্টগ্রাম-৮ আসনে মনোনয়ন নিয়ে তারা এখন উৎপেতে আছে। আ জ ম নাছিরকে মনোনয়ন দিলে তারা নগর আওয়ামী লীগে নেতৃত্ব শূন্যতার কথা বলে নতুন কমিটি ঘোষণার জোরালো দাবি তুলবে।
এদিকে কুয়েতের সাবেক রাষ্ট্রদূত এস এম আবুল কালামের নাম আলোচনায় আসলেও নির্বাচনী মাঠে তার কোনো তৎপরতা নেই।
দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগ নেতাদের অনেকে বলছেন, কুয়েতে লক্ষ্মীপুরের এমপি কাজী শহিদ ইসলাম পাপুলের ঘুষ কেলেঙ্কারির ঘটনায় আবুল কালামের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ। যে কারণে পাপুলের কেলেঙ্কারির ঘটনার পর কুয়েত থেকে সরকার রাষ্ট্রদূত এস এম আবুল কালামকে দেশে ফিরিয়ে আনেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের একজন নেতা রাজনীতি সংবাদকে বলেন, যিনি রাষ্ট্রদূত হিসেবে ব্যর্থ হয়েছেন, তাকে কি প্রধানমন্ত্রী এমপি পদে নমিনেশন দেবেন?