রাজনীতি সংবাদ ডেস্ক প্রকাশের সময় :১০ মার্চ, ২০২৩ ২:০৩ : অপরাহ্ণ
শুধু চীনের নয়, বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর ব্যক্তি হিসাবেও এখন উচ্চারিত হয় চীনা নেতা শি জিনপিংয়ের নাম। বিশেষ করে বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক পরিমন্ডলে চীনের ঈর্ষণীয় অর্জনের জন্য শি’কে বিবেচনা হয় মূল কারিগর হিসাবে।
তবে এই শি জিনপিং তৈরি একদিনে হয়নি। নানা প্রতিকূলতা পেরিয়ে প্রচণ্ড একাগ্র মানসিকতার জোরে চীনের সর্বোচ্চ নেতা হন শিং জিনপিং।
শি জিনপিং ১৯৫৩ সালের ১৫ জুন চীনের বেইজিংয়ে জন্ম নেন। তার বাবা শি ঝংজুন মাও সে তুং এর অধীনে চায়না কমিউনিস্ট পার্টির ভাইস চেয়ারম্যান ছিলেন।
তিনি চীনের গৃহযুদ্ধের সময় মাওয়ের সঙ্গে যুদ্ধ করেছিলেন। ফলে শি পারিবারিকভাবেই কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। প্রভাবশালী পরিবারে জন্ম নেয়ায় বেইজিংয়ে তার শৈশব ছিলো বর্ণাঢ্য।
তবে সে সুখ বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। মাওয়ের সমালোচনা করে লেখা একটি বইয়ের পক্ষে কথা বলায় শি’র বাবাকে ১৯৬২ সালে জেলে পাঠানো হয়।
এর চার বছর পর শুরু হয় সাংস্কৃতিক বিপ্লব। এটি দীর্ঘ দশ বছর স্থায়ী ছিলো। বাবার জন্য শি’র পরিবারকে অপমানিত হতে হয়।
মাত্র ১৩ বছর বয়সেই জিনপিংয়ের স্কুলে যাওয়াও বন্ধ হয়ে যায়। এদিকে ১৯৬৮ সালে মাও সে তুং ডিক্রি জারি করেন, শহুরে তরুণদের গ্রামে গিয়ে গরিব চাষীদের সাথে থেকে জীবন ধারণের শিক্ষা নিয়ে আসতে হবে। এই নিয়মের খাড়ায় পরে যান শি জিনপিং।
১৫ বছর বয়সী শি তাই বেইজিং ছেড়ে চলে যান চীনের উত্তর-পশ্চিমের শানজি প্রদেশের একটি দরিদ্র গ্রামে। তিনি গ্রামের দরিদ্র লোকদের পরিশ্রমী জীবনের সাথে অভ্যস্ত ছিলেন না। তাই তিন মাস পরেই তিনি বেইজিংয়ে পালিয়ে আসেন। কিন্তু এতে তাকে ছয় মাস জেল খাটতে হয়।
এরপর তাকে আবার পাঠানো হয় ইয়ানা’ন শহরের লিয়াংজিয়াহে গ্রামে। এবার তিনি নতুন জীবন মেনে নেন। সেখানে তাকে ছয় বছর থাকতে হয়। ষাটের দশকে চীনের গ্রামীণ জীবন ছিল খুবই কঠিন। বিদ্যুৎ ছিল না, মোটর চালিত যান ছিল না, কৃষি যন্ত্রপাতিও ছিল না।
জিনপিং তখন সার বহন করতেন, বাঁধ নির্মাণের কাজ করতেন, রাস্তা সংস্কারের কাজ করতেন। তাকে থাকতে হতো একটি গুহার মধ্যে আরো তিনজনের সাথে। তাদের জাউ আর লতাপাতা খেয়ে থাকতে হতো।
অনেক প্রতিকূলতার মধ্যেও শি গুহায় রাতের বেলা কেরোসিনের ল্যাম্পের আলোয় পড়াশোনা করতেন। মুখস্থ করেছিলেন মাওয়ের বিখ্যাত লাল বই।
মাওয়ের কিছু বিখ্যাত উক্তি মনের মধ্যে গেঁথে নিয়েছিলেন। সংবাদপত্রও নিয়মিত পড়তেন। জিনপিং মনে করেন লিয়াংজিয়াহ গ্রামের জীবনই তাকে গড়ে তুলতে সাহায্য করেছে। আজকের শি সেখানেই জন্ম নিয়েছে।
গুহাবাস জীবনের সঙ্গীরা জানিয়েছেন, শি জিনপিং মোটেও রসিক মানুষ ছিলেন না। অন্যদের মতো জুয়া খেলতেন না। সমবয়সীদের সঙ্গে আড্ডা দিতেন না। এমনকি মেয়ে বন্ধুদের প্রতিও শি’র কোন আগ্রহী ছিলো না। ১৮ বছর বয়সেই ঠিক করেন রাজনীতিই হবে তার ক্যারিয়ার।
১৯৭৩ সালে তিনি কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেয়ার আবেদন করা শুরু করেন। কিন্তু তার বাবার জেলে যাওয়ার ঘটনার কারণে দশবার আবেদন করেও ব্যর্থ হন। শেষ পর্যন্ত ১৯৭৪ সালে ২১ বছর বয়সে পার্টিতে যোগ দিতে সক্ষম হন শি জিনপিং।
১৯৭৫ সালে তিনি সিংহুয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ভর্তি হন। ১৯৭৯ সালে স্নাতক সম্পন্ন করেন। এরপর তিনি সেন্ট্রাল মিলিটারি কমিশনে কাজ শুরু করেন সাবেক প্রতিরক্ষা মন্ত্রী গেং বিয়াও এর সেক্রেটারি হিসেবে।
১৯৭৬ সালে মাও সে তুং মারা যাবার পর জিনপিংয়ের বাবা জেল থেকে মুক্তি পান। ফেরানো হয় দলে। তাকে হংকং এর কাছে গুয়াংডং প্রদেশ পরিচালনার জন্য পাঠানো হয়। বাবা মুক্তি পাওয়ায় তার পৃষ্ঠপোষকতায় শি’র রাজনৈতিক ক্যারিয়ারে অনেক উন্নতি হয়।
তবে জিনপিং দ্রুতই নিজের অবস্থান তৈরি করা শিখে যান। তিনি বিভিন্ন প্রাদেশিক নেতৃস্থানীয় পদে কাজ করেন এবং পদোন্নতি পেতে থাকেন। শি ছিলেন অন্তর্মুখী প্রকৃতির এবং সবার সাথে দূরত্ব রেখে চলতেন। অন্যদের পর্যবেক্ষণে তার ছিলো সহজাত ক্ষমতা।
এটা তার রাজনৈতিক ক্যারিয়ারে সাহায্য করলেও প্রথম বিয়েটা ভেঙে যায় এ কারণে। তিনি একজন কূটনৈতিকের মেয়েকে বিয়ে করেছিলেন।
এরপর ১৯৮৭ সালে দ্বিতীয় বিয়ে করেন পেং লিউয়ানকে। লিউয়ান চীনের জনপ্রিয় লোক সঙ্গীতশিল্পী। তিনি প্রচারণামূলক গান গেয়ে থাকেন।
শি জিনপিং রাজনীতিতে অনেক উন্নতি করলেও লোকচক্ষুর আড়ালেই থাকতেন। তাকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত সবাই লিউয়ানের স্বামী হিসেবেই চিনত। তাদের একমাত্র মেয়ে শি মিংজের জন্ম হয় ১৯৯২ সালে।
তার সম্পর্কে খুব বেশি জানা যায় না। বলা হয়, নাম লুকিয়ে হার্ভার্ড পড়ছে মিং।
শি জিনপিং তার বাবার ঘটনা খুব ছোটবেলায়ই কাছ থেকে দেখেছেন। এটি থেকে তিনি অনেক কিছু শিখতে পেরেছেন। তিনি চাইতেন পার্টির পদোন্নতিতে কারো সাথে যেন তার শত্রুতা না হয়। ২০০২-০৭ সাল পর্যন্ত তিনি ঝেজিয়াং প্রদেশের পার্টি প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
শি জিনপিং প্রদেশটির অর্থনৈতিক পূনর্গঠনে মনোযোগ দেন। বেসরকারি খাতেকে সুযোগ দেন। এতে এতে ওই প্রদেশে আর্থিকভাবে অনেক উন্নত হয়। ঝেজিয়াংয়ে তার অর্জন প্রভাবশালী নেতাদের সুনজরে আসতে সাহায্য করে। শি’র নেতৃত্বের প্রতি আস্থা বাড়তে থাকে।
২০০৬ সালে দুর্নীতির দায়ে সাংহাইয়ের পার্টি প্রধান চেন লিয়াংইউকে পদচ্যুত করা হয়। তার জায়গায় ক্ষমতায় আসেন শি জিনপিং। যদিও তাকে এই পদে বসানো নিয়ে অনেক বিতর্ক ছিল শীর্ষ নেতাদের। জিনপিং সাংহাইয়েও কোনো শত্রুতা সৃষ্টি করা থেকে বিরত থাকেন।
কয়েক মাসের মধ্যে ফলও পান তিনি। কমিউনিস্ট পার্টির এলিট কমিটি ‘পলিটবুরো স্ট্যান্ডিং কমিটি’তে পদোন্নতি পেয়ে যান জিনপিং। তখন তিনি এলিট কমিটিতে নিজের সমর্থনে খুবই সতর্কতার সঙ্গে একটি শক্তিশালী নেটওয়ার্ক গড়ে তোলেন।
২০০৮ সালের ১৫ মার্চ নতুন ভাইস প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংকে অভিনন্দন জানাচ্ছেন সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট জেং কুইংহং
তখনকার প্রেসিডেন্ট হু জিনতাওয়ের উত্তরসূরী হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছিল শি জিনপিং এবং বর্তমান চাইনিজ প্রিমিয়ার লি কেকিয়াংকে।
কিন্তু ২০০৮ সালের মার্চ মাসে যখন শি জিনপিং ভাইস প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পান, তখনই বোঝা যাচ্ছিল তিনিই হতে যাচ্ছেন চীনের ভবিষ্যৎ প্রেসিডেন্ট। এটা এখনো স্পষ্ট নয় জিনপিংকেই কেন দেয়া হলো এই দায়িত্ব।
ধারণা করা হয়, এর পেছনে রয়েছে তার বাবার অবদান। বাবা ত্রিশের দশক থেকেই কমিউনিস্ট পার্টির নেতা ছিলেন। একই সাথে সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সময় তার বাবার এবং তার নিজেরও অনেক ত্যাগ স্বীকার করতে হয়।
চীনের জনগণ এখন সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সময় ভুক্তভোগীদের প্রতি খুব সহানুভূতিশীল। এসব বিষয়ই শি’কে বড় পদে আসতে সাহায্য করেছে মনে করা হয়।
এছাড়া তিনি নিজেকে যে কোনো নেতৃস্থানীয় ব্যক্তির সাথে কাজ করার উপযোগী হিসেবে উপস্থাপন করেন পলিটবুরোর সাবেক ও বর্তমান সদস্যদের কাছে।
২০১২ সালের ১৫ নভেম্বর কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব নেন শি। একই সাথে সেন্ট্রাল মিলিটারি কমিশনের চেয়ারম্যানও হন। তখনই ক্ষমতাধর হয়ে ওঠার যাত্রা শুরু হয় শি জিনপিংয়ের। ডিসেম্বরে তিনি শুরু করেন দেশব্যাপী দুর্নীতি বিরোধী অভিযান।
২০১৩ সালের ১৪ মার্চ চীনের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এতে চীনের কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক, সেন্ট্রাল মিলিটারি কমিশনের চেয়ারম্যান, চীনের প্রেসিডেন্ট- এই তিনটি গুরুত্বপূর্ণ পদেরই অধিকারী হয়ে যান শি জিনপিং, যা আগে কেউ হতে পারেননি।
দায়িত্ব গ্রহণের প্রথম বছরেই দুর্নীতির অভিযোগে প্রায় দুই লাখ ৬৬ হাজার পার্টি সদস্যকে জেলে পাঠান শিং জিনপিং। এদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন পার্টির প্রভাবশালী নেতা। শি জিনপিংয়ের দুর্নীতি বিরোধী অভিযান চীনের জনগণের মাঝে খুব জনপ্রিয়তা পায়।
২০১৩ সালে দায়িত্ব নিয়ে উচ্চাভিলাষী ‘বেল্ট এন্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’ প্রকল্প শুরু করেন। এছাড়া দক্ষিণ চীন সাগরে চীনের বিস্তৃতি বাড়াতে শুরু করেন শি। ২০১৭ সালে চীনের সংবিধানে তার নাম লেখা হয়।
২০১৮ সালে চীনের সংসদে প্রেসিডেন্টের মেয়াদের নির্দিষ্ট সময়সীমা উঠিয়ে দেয়া হয়। ফলে শি জিনপিং আজীবন প্রেসিডেন্ট থাকতে পারবেন।
শি জিনপিং দুর্নীতি বিরোধী অভিযানের মাধ্যমে জনগণের কাছে জনপ্রিয়তা অর্জন করলেও এতে তার অনেক শত্রু সৃষ্টি হয়। ফলে তিনি ক্ষমতাহীন হয়ে পড়লে বাকি জীবন জেলেই কাটাতে হবে।
এছাড়া আন্তর্জাতিক অঙ্গনে চীনের আধিপত্য বিস্তার করতে হলে তার দীর্ঘ সময়ের জন্য ক্ষমতায় থাকার প্রয়োজন। এসব কারণেই হয়তো প্রেসিডেন্টের মেয়াদের সময়সীমা উঠিয়ে দেয়া হয়েছে।
তিনি অনলাইন মাধ্যম খুব কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করছেন। তার নামে কোনো সমালোচনামূলক কথা লেখা বা বলা অনলাইন-অফলাইন উভয় ক্ষেত্রেই নিষিদ্ধ।
আন্তর্জাতিক পত্রিকাগুলোর অনলাইন ভার্সন, সামাজিক মাধ্যম ফেসবুক, টুইটারসহ গুগল, ইউটিউব চীনে নিষিদ্ধ করে রেখেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের সাথে জড়িয়েছেন বাণিজ্যিক যুদ্ধে।
তবে কোনো অভিযোগই গায়ে মাখেন না শি। বলা হচ্ছে, ২০৪৯ সালে কমিউনিস্ট পার্টির ক্ষমতা গ্রহণের শতবার্ষিকীতে চীনের অর্থনীতি যুক্তরাষ্ট্রের তিন গুণ ছাড়িয়ে যাবে। সেটা পারবে কি না সময়ই বলে দেবে। আর যদি সত্যিই চীন সুপার পাওয়ার হয়ে যায়, সেটা হবে শি’র কারণেই।
তবে আমেরিকারসহ পশ্চিমা দুনিয়ার আশঙ্কা, একক ক্ষমতার কারণে জিনপিং আন্তর্জাতিক মঞ্চে আরও বেপরোয়া হয়ে উঠতে পারেন। তার ক্ষমতা যত একচেটিয়া হবে, আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে চীনের ঝুঁকি নেয়ার প্রবণতা তত বাড়বে। যা তাদের জন্য একটি স্থায়ী মাথা ব্যাথার কারণ।
এ অবস্থায় ইউক্রেন যুদ্ধ এবং তাইওয়ান সঙ্কটের আবহে চীনের মতো শক্তিশালী রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ নেতা ইতিমধ্যেই বার্তা দিয়েছেন, দেশের কূটনীতি ও রণনীতিকে আরও আগ্রাসী করতে তিনি বদ্ধপরিকর। ফলে আগামী দিনে চীনের সঙ্গে বাকি বিশ্বের সংঘাত নতুন মাত্রা পেতে পারে।