বুধবার, ৪ ডিসেম্বর, ২০২৪ | ১৯ অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ | ১ জমাদিউস সানি, ১৪৪৬

মূলপাতা আঞ্চলিক রাজনীতি

স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা দেবুর কোটি টাকার চাঁদাবাজি: ৫ মাসেও তদন্ত শেষ হয়নি কেন্দ্রের



রাজনীতি সংবাদ প্রতিবেদন, চট্টগ্রাম
প্রকাশের সময় : ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ৯:২২ পূর্বাহ্ণ

চট্টগ্রাম মহানগর স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি দেবাশীষ নাথ দেবুর বিরুদ্ধে কোটি টাকা চাঁদাবাজির ঘটনার তদন্ত পাঁচ মাসেও শেষ করতে পারেনি সংগঠনটির কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ।

দেবুর বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির ঘটনায় গত বছরের ৮ সেপ্টেম্বর দুই সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করে কেন্দ্র। ২১ দিনের মধ্যে এই কমিটি প্রতিবেদন দাখিলের কথা ছিল। কিন্তু প্রায় পাঁচ মাস পেরিয়ে গেলেও এখনো প্রতিবেদন দাখিল করেনি তদন্ত কমিটি।

জানতে চাইলে তদন্ত কমিটির সদস্য স্বেচ্ছাসেবক লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এ কে এম আজিম রাজনীতি সংবাদকে বলেন, ‘চট্টগ্রাম মহানগর স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি দেবুর চাঁদাবাজির ঘটনায় ‌আমাদের তদন্ত এখনো শেষ হয়নি। তবে আমরা এ ঘটনার সব তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করেছি। শিগগিরই আমরা সংগঠনের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের কাছে প্রতিবেদন জমা দিবো।’

চট্টগ্রাম নগর স্বেচ্ছাসেবক লীগের নেতাকর্মীদের অনেকে বলছেন, কোটি টাকা চাঁদাবাজির ঘটনায় দেবুকে অভিযুক্ত করে পাঁচ বছর আগে পুলিশ আদালতে এ মামলার চার্জশিট দাখিল করেছে। চার্জশিটে দেবু চাঁদাবাজির বিষয়টি স্বীকার করার কথাও উল্লেখ আছে। মামলার নথিতে সুনির্দিষ্ট তথ্য-প্রমাণ থাকার পরও কেন্দ্র দীর্ঘ পাঁচ মাসেও তার বিরুদ্ধে তদন্ত শেষ করতে পারেনি। বিষয়টি রহস্যজনক। কোনো মহলের চাপে কেন্দ্র হয়তো ঘটনাটি ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করছে।

নগর স্বেচ্ছাসেবক লীগের সম্পাদক মণ্ডলীর একজন নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে রাজনীতি সংবাদকে জানান, তদন্ত কমিটির নামে হয়তো নাটক করা হচ্ছে। মামলার নথিতে সুনির্দিষ্ট তথ্য-প্রমাণ থাকার পরও ঘটনাটি তদন্ত করতে পাঁচ মাস সময় লাগার কথা না। অথচ দেবুর বিরুদ্ধে কোটি টাকার চাঁদাবাজির মামলাটি নিয়ে নেতাকর্মীদের মধ্যে অস্বস্তি বিরাজ করছে। কারণ ঘটনাটি নিয়ে নগর স্বেচ্ছাসেবক লীগের বিরুদ্ধে নানা সমালোচনা হচ্ছে। এ ঘটনার সঙ্গে সংগঠনের ভাবমূর্তি জড়িত।

নগর স্বেচ্ছাসেবক লীগের নেতাকর্মীদের অনেকে বলছেন, যদি বিচারে দেবাশীষ নাথ দেবু দোষী সাব্যস্ত হয় তাহলে স্বেচ্ছাসেবক লীগকে সাধারণ মানুষ ‘চাঁদাবাজ সংগঠন’ বলবে।

২০১৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি নগরীর পাঁচলাইশ থানায় দেবাশীষ নাথ দেবুসহ ৬ জনের বিরুদ্ধে ১ কোটি টাকা চাঁদাবাজির অভিযোগে মামলা করেছিলেন বন্ধন নাথ নামে এক কুয়েত প্রবাসী। তার গ্রামের বাড়ি চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের ছোট কুমিরায়। দেবাশীষ নাথ দেবু হলেন বন্ধন নাথের ভাগিনা।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ২০০৭ সালে নগরীর ষোলশহর শপিং কমপ্লেক্সের পাশে পুরনো একটি ভবনসহ ১২ কাঠা জায়গা কিনেছিলেন বন্ধন নাথ। এরপর তিনি ওই ভবনটি ভাড়া দেন। আত্মীয়তার সুবাদে দেবাশীষ নাথ দেবুকে ওই ভবনে আশ্রয় দেন বন্ধন নাথ।

কিন্তু সেখানে আশ্রয় পেয়ে রাতারাতি রূপ পাল্টে ভবনটির মালিক বনে যান দেবু! ভবনটির নাম দেন ‘দেব ভবন’। ভবনের ৩০টি কক্ষের ভাড়ার টাকা তিনি নিজের পকেটে ভরতেন।

প্রবাসে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে কষ্টের টাকায় কেনা জায়গাটি নিজের নিকটাত্মীয় ‘দখল করে ফেললে’ মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়ে বন্ধন নাথের।

মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, বন্ধন নাথ সেই জায়গায় বহুতল ভবন নির্মাণের জন্য ২০১৬ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি ‘ডিজাইন সোর্স টিম লিমিটেড’ নামে একটি ডেভেলপার কোম্পানির সঙ্গে চুক্তিপত্র করেন।

পরদিন তিনি ডেভেলপার কোম্পানিকে জায়গাটি বুঝিয়ে দিতে গেলে তাতে বাধ সাধেন দেবুসহ মামলার অন্য আসামিরা। তারা বন্ধন নাথকে ভবনটির ভেতর আটকে রাখেন। এরপর তার কাছে তারা ১ কোটি টাকা চাঁদা দাবি করেন।

কিন্তু তিনি চাঁদা দিতে অপারগতা প্রকাশ করলে দেবুসহ মামলার অন্য আসামিরা তাকে বেধড়ক মারধর করেন। একপর্যায়ে বন্ধন নাথের পিঠের ডান পাশে গুলি করা হয়।

এরপর তারা ব্যবসায়িক লেনদেন বাবদ বন্ধন নাথের কাছ থেকে ৭০ লাখ টাকা পাওনা আছে বলে জোরপূর্বক তিনটি স্ট্যাম্পে স্বাক্ষর নেন।

এ ঘটনার তিনদিন পর বন্ধন নাথ আসামিদের ডেভেলপার প্রতিষ্ঠানটির মাধ্যমে ৭০ লাখ টাকা চাঁদা প্রদান করেন। চাঁদা দেওয়ার পর প্রাণনাশের হুমকির ভয়ে ওই দিন সন্ধ্যায় তিনি দেশ ছেড়ে কুয়েত পালিয়ে যান।

কিন্তু ৭০ লাখ টাকা চাঁদা নিয়েও ক্ষান্ত হননি দেবু ও তার সঙ্গীরা। দুই বছর পর ২০১৮ সালের ২ ফেব্রুয়ারি ডেভেলপার প্রতিষ্ঠানটি যখন ওই জায়গায় বহুতল ভবন নির্মাণের কাজ শুরু করেন, তখন দেবুর নেতৃত্বে অন্য আসামিরা আবার সেখানে গিয়ে হানা দেন। নির্মাণ কাজে বাধা দিয়ে তারা আরও ৩০ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করেন।

এ মামলায় ২০১৮ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি নগরীর সাগরিকা এলাকা থেকে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন দেবাশীষ নাথ দেবু।

২০১৮ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর আদালতে এ মামলার চার্জশিট দাখিল করা হয়। গত বছরের ২১ আগস্ট এই মামলার চার্জ গঠনের মাধ্যমে আসামিদের বিচার শুরু করেছেন আদালত।

নগর স্বেচ্ছাসেবক লীগের নেতাকর্মীদের অনেকে জানিয়েছেন, দেবু চাঁদাবাজির মামলাটি বাদীপক্ষের সঙ্গে মীমাংসা করে ফেলার কথা প্রচার করছেন। কিন্তু রাজনীতি সংবাদ মামলার বাদী প্রবাসী বন্ধন নাথের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি বিষয়টি অস্বীকার করেন। তিনি এ মামলার আসামিদের বিচারের জন্য আইনি লড়াই চালিয়ে যাবেন বলে জানিয়েছেন।

আরও পড়ুন: কোটি টাকার চাঁদাবাজি মামলা: স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা দেবুর বিচার শুরু

গত বছরের ৯ মার্চ দেবাশীষ নাথ দেবুকে সভাপতি করে স্বেচ্ছাসেবক লীগ চট্টগ্রাম মহানগর শাখার ২০ সদস্য বিশিষ্ট আংশিক কমিটি ঘোষণা করা হয়।

এ কমিটি গঠনের আগে দেবাশীষ নাথ দেবুর চাঁদাবাজির ঘটনা নিয়ে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। কিন্তু এরপরও ‘বিতর্কিত’ এ নেতার হাতে স্বেচ্ছাসেবক লীগের নেতৃত্বের ভার তুলে দেয় কেন্দ্র।

দলীয় মহলে প্রচার আছে, সভাপতি নির্বাচিত হওয়ার আগে দেবাশীষ নাথ দেবু বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির মামলাটি দায়ের হলেও স্বেচ্ছাসেবক লীগের তৎকালীন সভাপতি নির্মল রঞ্জন গুহের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকার সুবাদে তিনি পার পেয়ে যান।

সমালোচনা-বিতর্ক উপেক্ষা করে তাকে চট্টগ্রাম মহানগরের সভাপতি নির্বাচিত করার পেছনে নির্মল রঞ্জন গুহ ভূমিকা রেখেছিলেন।

দীর্ঘ ২১ বছর পর সংগঠনকে ঢেলে সাজাতে নগর স্বেচ্ছাসেবক লীগের নতুন কমিটি গঠন করা হয়। কিন্তু নতুন কমিটি গঠনের পর থেকে সংগঠনটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের বিভিন্ন কর্মকাণ্ড নিয়ে নানা সমালোচনা ও বিতর্ক সৃষ্টি হচ্ছে।

থানাভিত্তিক সমন্বয় কমিটি গঠন করা নিয়ে সংগঠনটির মধ্যে এখন চরম বিরোধ সৃষ্টি হয়েছে। নেতাকর্মীরা প্রকাশ্যে দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছেন।

নগর স্বেচ্ছাসেবক লীগের বেশিরভাগ সদস্য নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক সিটি মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীনের অনুসারী। সংগঠনের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের ‘বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের’ জেরে তারা এখন সাংগঠনিক কোনো কর্মসূচিতে অংশ নিচ্ছেন না।

আরও পড়ুন: স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা দেবুর চাঁদাবাজি, গোপন ক্যামেরায় ধরা

মন্তব্য করুন
Rajniti Sangbad


আরও খবর