রাজনীতি সংবাদ প্রতিবেদন প্রকাশের সময় :১৫ জানুয়ারি, ২০২৩ ৫:০১ : অপরাহ্ণ
চট্টগ্রাম নগরীর নাছিরাবাদ হাউজিং সোসাইটিতে এক শিল্পপতির বাসভবনে প্রতি সপ্তাহেই বসে পরিবারের সদস্যদের অন্যরকম মিলনমেলা। যেখানে গান, কবিতা আবৃত্তি, বক্তৃতা, হামদ-নাত, গজল, কাওয়ালিসহ নানা রকম বিষয় পরিবেশন করেন পরিবারের সদস্যরা।
এই পরিবারের কর্ণধার হলেন দেশের খ্যাতনামা শিল্প গ্রুপ পিএইচপি ফ্যামিলির চেয়ারম্যান সুফি মোহাম্মদ মিজানুর রহমান।
আজকাল পরিবারের মধ্যে সবাই একসঙ্গে বসে আলাপ-আলোচনা, খাওয়াদাওয়া, হইহুল্লোড়-এমন পারিবারিক বন্ধন দেখা যায় না। পারিবারিক বন্ধনে আগের সেই আন্তরিকতার প্রকাশ কমে যাচ্ছে দিনে দিনে।
সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের মূল্যবোধ, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও কৃষ্টি ভেসে যাচ্ছে। সভ্যতা ও প্রগতির সঙ্গে সঙ্গে পাল্টে যাচ্ছে মানুষের মন-মানসিকতা।
কিন্তু দেশের অত্যন্ত একজন নামকরা শিল্পপতি হয়েও পারিবারিক কালচার পরিবর্তন করেননি সুফি মিজানুর রহমান।
৮০ বছর বয়স হলেও পরিবারের সব সদস্যকে এখনো মায়া, মমতা ও ভালোবাসা দিয়ে আগলে রেখেছেন তিনি।
এই পরিবারে সবার মধ্যে রয়েছে সহযোগিতা, সহমর্মিতা, আন্তরিকতা ও শ্রদ্ধার সম্পর্ক, যা ঈর্ষণীয়।
নাছিরাবাদ হাউজিং সোসাইটিতে দুটি ভবনে সাত ছেলে ও তাদের স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে যৌথ বসবাস করেন সুফি মিজানুর রহমান।
সন্তানদের কেউ কেউ জীবনের অর্ধশতক পার করেছেন। যাদের প্রত্যেকেই আমেরিকা-অস্ট্রেলিয়া থেকে উচ্চশিক্ষা অর্জন করেছেন।
সব সন্তানরা তাদের বাবার মতো বিনয়ী। মানবিক গুণাবলী ও সমাজসেবায়ও বাবার মতো।
আমাদের দেশে একসময়ে বাড়ির উঠানে বসে পারিবারিক নানা বিষয়ে আলাপ হতো। কালের স্রোতে পারিবারিক সেই সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য এখন অনেকটা বিলীন হয়ে গেছে।
কিন্তু সুফি মিজানুর রহমানের পরিবারে সেই সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের বিকাশ ঘটছে।
সুফি মিজানুর রহমানের বাসভবনের ঈছাপুরী দরবারে প্রতি বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় পরিবারের সদস্যদের মিলনমেলা বসে। এই আসরে মাঝে মধ্যে বাইরে থেকেও অনেক অতিথি আসেন।
সুফি মিজান সেখানে জীবন সম্পর্কে, দর্শন সম্পর্কে, মূল্যবোধ সম্পর্কে বক্তৃতা করেন। পাশাপাশি তিনি মরমি সংগীত ও কাওয়ালি গানও করেন।
গানের আসরে তার বড় ছেলে মোহাম্মদ মহসিন গিটার বাজান, সেজো ছেলে আনোয়ারুল হক স্যাক্সোফোনে ফুঁ দিয়ে সুর তোলেন অবলীলায়।
পঞ্চম ছেলে আমির হোসেন সোহেল কবিতাপ্রেমী। কবিতাও লেখেন। চতুর্থ ছেলে আলী হোসেন সোহাগ অসম্ভব সুন্দর কবিতা আবৃত্তি করেন।
জানা গেছে, এই মিলনমেলায় সুফি মিজানুর রহমানের পুত্রদের স্ত্রীরা প্রত্যেকে কমপক্ষে একটি আইটেম নিজেরা রান্না করে নিয়ে আসেন এবং সামনে এসে অতিথিদের অভ্যর্থনা জানান।
খাবার সময় নানা রকম সমস্যা নিয়েও আলাপ হয়। সন্তানেরা যেসব প্রতিষ্ঠানের নেতৃত্ব দিচ্ছেন, সেখানে কোনো সমস্যা থাকলে সবাই মিলে তার সমাধানের পথ খোঁজেন। সুফি মিজান তার জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা দিয়ে সেই সমস্যার সমাধান বাতলে দেন।
জানা যায়, সুফি মিজান গোটা পরিবারকে তার যৌবনকাল থেকেই অসাধারণ শিক্ষা দিয়ে আসছেন।
সন্তানদের মহামনীষীদের জীবনকথা আর বাণী শুনিয়ে বড় করেছেন, শিখিয়েছেন কীভাবে সাধারণ্যের মতো জীবনযাপন করতে হয়। পরবর্তী প্রজন্মকেও তিনি একই শিক্ষা দিচ্ছেন।
বড় শিল্পপতি হলেও সাদামাটা ও অতি সাধারণ জীবনযাপনে অভ্যস্ত সুফি মিজান। কারও সঙ্গে দেখা হলেই উচ্চ স্বরে সালাম দিয়ে কুশল বিনিময় করেন এই হাস্যোজ্জ্বল মানুষটি।
এই শিল্পপতি সুমধুর কণ্ঠে পবিত্র কোরআন তেলাওয়াতও করতে পারেন, আবার মোয়াজ্জিন ও নামাজের জামাতে ইমামতিও করেন।
সুফি মিজান সমাজের নিচু শ্রেণীর মানুষদেরও সহজেই কাছে টেনে নেন, আলিঙ্গন করেন।
আতিথেয়তার ক্ষেত্রে তার জুড়ি মেলা ভার। তিনি খেতে যেমন ভালোবাসেন, খাওয়াতেও সমান ভালোবাসেন।
করলা ভাজি, ইলিশ মাছ, কই মাছ ও ছোট মাছ তার প্রিয় খাবার। তিনি যে কোনো অনুষ্ঠানে গেলে সবাইকে নিয়ে মোনাজাত করে মহান সৃষ্টিকর্তার দরবারে প্রার্থনা করেন।
জানা গেছে, সুফি মিজানুর রহমানকে প্রায় ২৫ বছর আগে সুফি উপাধি দেওয়া হয়। আল্লামা রুমী সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতা সৈয়দ আহমদুল হক তাকে এই উপাধি দেন।
দীর্ঘদিন ধরে সমাজসেবায় কাজ করে আসা সুফি মিজানুর রহমান ২০২০ সালে বাংলাদেশের দ্বিতীয় শিল্পপতি হিসেবে পেয়েছেন একুশে পদক।
এদেশের সফল শিল্প মালিক এবং নতুন উদ্যোক্তাদের প্রেরণার গল্প হিসেবে অনন্য দৃষ্টান্ত সুফি মিজানুর রহমান ।
প্রায় ৫০ বছর আগে সুফি মিজানুর রহমান ব্যবসা শুরু করেছিলেন মাত্র ১ হাজার ৪৮৩ টাকায়।
তার অক্লান্ত পরিশ্রম, মেধা, প্রজ্ঞা ও ইস্পাত দৃঢ় অঙ্গীকারে গড়ে উঠেছে পিএইচপি ফ্যামিলি। এই শিল্পগ্রুপের প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা এখন ৩৪টি। যেখানে কাজ করছেন ১২ হাজার কর্মী।
সুফি মিজানের হাড়খাটুনি পরিশ্রমে গড়া পিএইচপি শিল্প গ্রুপের বার্ষিক লেনদেন এখন ছয় হাজার কোটি টাকা।
সুফি মিজানকে নিয়ে ব্যবসায়ী মহলে একটি প্রবাদ আছে-‘তিনি যেখানে হাত দেন তা সোনা হয়ে যায়।’
মাত্র ১০০টাকা দিয়ে কর্মজীবন শুরু করা সুফি মিজানুর রহমানের এই সফলতার রহস্য জানতে চেয়েছিলেন সাবেক অর্থমন্ত্রী প্রয়াত এম সাইফুর রহমান।
২০০৩ সালে সুফি মিজানুর রহমানকে ‘বেস্ট বিজনেস অ্যাওয়ার্ড’ প্রদানের সময় সাইফুর রহমান জিজ্ঞাসা করেছিলেন-‘তুমি নাকি ১০০ টাকা বেতনের চাকরি করতা? এতো বড় ন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ড নিতেছো। তোমার সাফল্যের গোপন রহস্য কী?’
এর জবাবে সুফি মিজানুর রহমান বলেছিলেন, ‘Divine blessings mixed with hard work backed by good intention can make miracle.’
সুফি মিজানুর রহমান মনে করেন, সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য ও পরিকল্পনা নিয়ে কঠোর পরিশ্রম করলে সফলতা আসবেই।
আরও পড়ুন: ১ হাজার ৪৮৩ টাকায় ব্যবসা শুরু, এখন ৬ হাজার কোটি টাকার শিল্প গ্রুপ