শুক্রবার, ২২ নভেম্বর, ২০২৪ | ৭ অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ | ১৯ জমাদিউল আউয়াল, ১৪৪৬

মূলপাতা আন্তর্জাতিক

কনস্টেবলের ছেলে দাউদ ইব্রাহিম যেভাবে আন্ডারওয়ার্ল্ড ডন হলেন


আন্ডারওয়ার্ল্ড ডন দাউদ ইব্রাহিম

রাজনীতি সংবাদ ডেস্ক প্রকাশের সময় :৯ জানুয়ারি, ২০২৩ ৩:২১ : অপরাহ্ণ

মুম্বাই পুলিশের এক কনস্টেবল ছিলেন ইব্রাহিম কাস্কর। ডোঙ্গরি-নাগপাডা এলাকায় কর্তব্যরত কাস্করকে সবাই শ্রদ্ধা করতেন। ইব্রাহিম আর আমিনা কাস্করের ১২ সন্তানের অন্যতম দাউদ ইব্রাহিম। সপ্তম শ্রেণিতে পড়ার সময়েই স্কুল যাওয়া বন্ধ করে দেন দাউদ।

ছোটখাটো চুরি-ছিনতাই করতেন প্রথমে। তার পরে শুরু হয় পকেটমারি, পাড়ার বন্ধুবান্ধবকে সঙ্গে নিয়ে মারপিট এসব।

ভারতের অপরাধ জগতের সবচেয়ে বড় ‘ডন’ দাউদ ইব্রাহিমের শুরুটা হয়েছিল এভাবেই।

বছর কুড়ি বয়সে ওই ছেলে-ছোকরাদের সঙ্গে নিয়েই তিনি চ্যালেঞ্জ জানিয়ে বসেন সেই সময়ের প্রতাপশালী পাঠান গ্যাংকে।

নিজের দলে অন্য ছেলেদের সঙ্গেই ছিল দাউদের ভাই সাব্বিরও। পরে সংবাদমাধ্যম যে গোষ্ঠীকে ‘ডি কোম্পানি’ নামে অভিহিত করতে থাকে।

মনে করা হয়, এখন দাউদের আরেক ভাই আনিস ইব্রাহিম ওই ‘ডি কোম্পানি’র সব কাজকর্ম দেখাশোনা করেন।

দাউদের প্রথম বড় অপরাধ ছিল, ভাই সাব্বির আর তার দলের সদস্যদের নিয়ে একটা ব্যাংক লুটের ঘটনা।

মুম্বাইয়ের কার্ণক বন্দর এলাকার ওই ব্যাংক ডাকাতির পরেই শহরের সংবাদমাধ্যমের নজরে যেমন তিনি আসেন, তেমনই তার দিকে নজর পড়ে অন্য গ্যাংগুলোরও।

দাউদ মনে করেছিলেন, সেই সময়ের ‘ডন’ হাজি মাস্তানের অর্থ ছিল ওই ব্যাংকে। কিন্তু আসলে এক দশকের মধ্যে সবচেয়ে বড় ওই ব্যাংক ডাকাতিতে লুট হওয়া অর্থ ছিল মেট্রোপলিটন কোঅপারেটিভ ব্যাংকের।

ছেলের কীর্তি শুনে হতবাক হয়ে গিয়েছিলেন ইব্রাহিম কাস্কর। মুম্বাইয়ের সিনিয়র ক্রাইম রিপোর্টার হুসেইন জাইদি এ ঘটনার কথা উল্লেখ করেছেন দাউদকে নিয়ে লেখা তার ‘ডোংরি টু দুবাই’ বইয়ে।

ইব্রাহিমের একটা নিজস্ব নেটওয়ার্ক ছিল। তাদের মাধ্যমেই তিনি তার দুই ছেলের খোঁজ নিতে শুরু করলেন।

বেশ কয়েক দিন পর ইব্রাহিম কাস্কর জানতে পারলেন যে, তার দুই ছেলেই বাইকুল্লা এলাকায় এক বন্ধুর বাড়িতে লুকিয়ে আছে। বাড়ি ফিরিয়ে আনলেন দুজনকেই।

জাইদি তার পরের ঘটনা বর্ণনা করেছেন এভাবে-মা আমিনা যখন দাউদ আর সাব্বিরকে চিৎকার করে বকাবকি করছেন, তাদের বাবা ইব্রাহিম পাশের ঘরে গিয়ে একটা স্টিলের আলমারি থেকে বার করে আনলেন পুলিশ ইউনিফর্মের মোটা চামড়ার বেল্ট।

মুম্বাই ক্রাইম ব্রাঞ্চের হেড কনস্টেবল হিসেবে যে বেল্ট গর্বের সঙ্গে তিনি কোমরে বাঁধতেন, সেটি দিয়ে শুরু হলো মার।

একনাগাড়ে দুই ছেলের পিঠে পড়ছিল ওই বেল্টের মার। তাদের দুজনের পুরো পিঠে কালশিটে পড়ে গিয়েছিল।

হুসেইন জাইদি লিখেছেন-পরিবারের অন্যরা এসে ইব্রাহিম কাস্করকে জাপটে ধরে তার হাত থেকে বেল্টটা নিয়ে নেন। তার আগে পর্যন্ত মার চলেছিল।

বেল্টটা নিয়ে নেওয়া হলেও দাউদ আর সাব্বিরের বাবাকে থামানো যায়নি। মা আমিনা ছেলেদের পানি আর কিছু খাবার দেওয়ার আগেই কাস্কর দুই ছেলেকে টানতে টানতে একটা ট্যাক্সিতে ওঠান। ট্যাক্সিটা সোজা গিয়ে থামে মুম্বাই পুলিশের ক্রাইম ব্রাঞ্চ দপ্তরে।

হুসেইন জাইদি লিখেছেন-দুই ছেলেকে নিয়ে সোজা অফিসারদের সামনে হাজির হন ইব্রাহিম কাস্কর। ছেলেদের কীর্তির জন্য হাতজোড় করে ক্ষমা চান ওই হেড কনস্টেবল। তখন তার চোখ দিয়ে অঝোরে জল পড়ছিল। বাবার সততা দেখে দয়া হয় অফিসারদের। তারা দুজনকেই ছেড়ে দেন। এ ঘটনাই সম্ভবত জন্ম দিয়েছিল পরবর্তীকালের ‘ডন’ দাউদ ইব্রাহিমের।

১৯৯৩ সালের সিরিয়াল বিস্ফোরণের একটি। ওই হামলার মূল হোতা ছিলেন দাউদ ইব্রাহিম-এমনই অভিযোগ।

মুম্বাইয়ের অপরাধ জগতে দাউদ ইব্রাহিমের প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গেই আগে থেকেই প্রতিষ্ঠিত অন্ধকার জগতের বাদশাদের সঙ্গে তার লড়াই শুরু হয়ে যায়।

পাঠান গ্যাংয়ের সদস্যরা প্রথমে হত্যা করে দাউদের ভাই সাব্বিরকে। ১৯৮৬ সালে সেই গোষ্ঠীর অন্যতম কারিল লালার ভাইপো সামাদ খানকে খুন করে দাউদ তার বদলা নেন।

এর পরেই দাউদ ইব্রাহিম ভারত ছাড়েন। দুবাই থেকে শুরু হয় ‘ডি কোম্পানির’ কাজকর্ম। ১৯৯২ সালে বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পরে মুম্বাইয়ে দাঙ্গা শুরু হয়। বহু মুসলমান সেই দাঙ্গায় নিহত হন।

এ ঘটনা দাউদ ইব্রাহিমকে খুবই বিচলিত করেছিল বলে মনে করা হয়।

মুম্বাইয়ের অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ কমিশনার রাকেশ মারিয়া তার আত্মজীবনী ‘লেট মি সে ইট নাও’তে লিখেছেন-বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পর মুম্বাইয়ের মুসলমানরা দাউদকে এগিয়ে আসার জন্য অনুরোধ করেছিলেন। কিন্তু তিনি প্রথমে কিছু করেননি। পরে বেশ কয়েকজন মুসলমান নারী দাউদের কাছে চুড়ি পাঠিয়ে দিয়েছিলেন।

এর পরেই দাউদ ইব্রাহিম মুম্বাই সিরিয়াল বিস্ফোরণের পরিকল্পনা করেন বলে মনে করা হয়।

তার বিরুদ্ধে অভিযোগ, পাকিস্তানের আইএসআইয়ের সহায়তায় তিনি চোরাপথে ভারতে বিস্ফোরক নিয়ে আসেন, আর তা দিয়েই ১৯৯৩ সালের ১২ মার্চ সিরিয়াল বিস্ফোরণ ঘটানো হয়।

সেদিন একের পর এক বিস্ফোরণ ঘটিয়ে ২৫৭ জনকে নিহত আর ৭০০ জন আহত হওয়ার সেই ঘটনার মূল চক্রী ছিলেন দাউদ ইব্রাহিমই-এমনটিই অভিযোগ।

ওই বিস্ফোরণে দাউদকে সহায়তা করেছিলেন তার গ্যাংয়েরই ছোটা শাকিল, টাইগার মেমন, ইয়াকুব মেমন আর আবু সালেম।

ওই বিস্ফোরণে জড়িত থাকার অপরাধে আবু সালেমের যাবজ্জীবন সাজা হয়েছে আর ইয়াকুব মেমনের ফাঁসির আদেশ হয়।

আল কায়েদা আর লস্কর-এ-তৈয়েবার সঙ্গেও দাউদ ইব্রাহিমের যোগাযোগ ছিল বলে অভিযোগ আছে।

যুক্তরাষ্ট্র অভিযোগ করে যে, ৯/১১-এ ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারে বিমান হামলার ঘটনাতেও দাউদের যোগ ছিল। তাকে একজন ‘গ্লোবাল টেররিস্ট’ আখ্যা দিয়ে বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে থাকা দাউদের সব সম্পত্তি অধিগ্রহণ করতে চেয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।

দাউদ ইব্রাহিম নিজের পাড়ায় গড়েছিলেন এ রেস্তোরাঁ। ভারত সরকার এটিকে জব্দ করে নিলামে বিক্রি করে দেয়।

দুবাই থেকে দাউদ ইব্রাহিম পাকিস্তানে চলে আসেন বলে জানা যায়। ভারত সব সময়েই অভিযোগ করে থাকে যে, পাকিস্তানের আইএসআই দাউদকে মদত দিয়ে থাকে। তিনি করাচিতে বসবাস করেন বলে মনে করা হয়।

কিন্তু পাকিস্তান এ অভিযোগ সবসময়েই অস্বীকার করে আসছে। কিন্তু কয়েক বছর আগে পাকিস্তান সরকার যখন সে দেশের ৮৮ জন চরমপন্থি নেতা আর সংগঠনের ওপরে নিষেধাজ্ঞা জারি করে, তার মধ্যে দাউদ ইব্রাহিমের নামও ছিল। সেই প্রথম আনুষ্ঠানিকভাবে পাকিস্তান স্বীকার করেছিল যে, দাউদ ইব্রাহিম সে দেশেই থাকেন।

সূত্র: বিবিসি

মন্তব্য করুন
Rajniti Sangbad


আরও খবর