রাজনীতি সংবাদ ডেস্ক প্রকাশের সময় :১১ অক্টোবর, ২০২২ ১১:১৯ : পূর্বাহ্ণ
ঢাকায় নিযুক্ত চীনা রাষ্ট্রদূতের তিস্তা বাঁধ প্রকল্প এলাকা পরিদর্শনের পর এ নিয়ে ঢাকা-বেইজিং–নয়াদিল্লিতে আলোচনায় নতুন মাত্রা পেয়েছে।
গত ৯ অক্টোবর ঢাকায় নিযুক্ত চীনা রাষ্ট্রদূত লি জিমিং-এর নেতৃত্বে চীনা দূতাবাসের তিন সদস্যের একটি দল লালমনিরহাট জেলার তিস্তা বাঁধ এলাকা পরিদর্শন করে।
তারা দুদিন ধরে রংপুর অঞ্চলে অবস্থান করে বিষয়টি নিয়ে স্থানীয় প্রশাসন, নাগরিক সমাজ ও রাজনৈতিক ব্যক্তিদের সঙ্গে মতবিনিময়ের পর থেকেই এর তাৎপর্য নিয়ে নানা আলোচনার সূত্রপাত হয়। পাশাপাশি চীনা দূতের তিস্তা ব্যারেজ পরিদর্শন নিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমও নানা বিশ্লেষণী প্রতিবেদন প্রকাশ ও পর্যালোচনা করেছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সরকারের পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় থেকে তিস্তা নদী সমন্বিত ব্যবস্থাপনা ও পুনরুদ্ধার প্রকল্পটি নীতিগত অনুমোদন পাওয়ার পর চীনের দূত অনেকটা পরিকল্পনা করেই তিস্তা ব্যারেজ সেচ প্রকল্প ও তিস্তা নদীর অববাহিকা পরিদর্শনে যান। তবে বিষয়টি নিয়ে পররাষ্ট্র ও পানি সম্পদ মন্ত্রণালয় কিছুই বলছে না।
এ বিষয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন একটি সংবাদমাধ্যমকে বলেন, সাধারণত কোনো রাষ্ট্রদূত ঢাকার বাইরে গেলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে জানিয়ে যাওয়াই রেওয়াজ। এক্ষেত্রেও হয়ত তাই হয়েছে, সংশ্লিষ্ট অনুবিভাগ বলতে পারবে। তিস্তার ওপর কোনো প্রকল্প নিয়ে চীনের কাছ থেকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কোনো প্রস্তাব পায়নি। হয়ত পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় থেকে ওখানে কোনো প্রকল্প নেয়া হয়েছে।
তবে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী ও উপমন্ত্রীর সঙ্গে কয়েক দফা যোগযোগের চেষ্টা করেও তাদের পক্ষ থেকে কোনো সাড়া মেলেনি।
গতকাল সোমবার চীনের রাষ্ট্রদূত রংপুরের বিভাগীয় কমিশনার মো. সাবিরুল ইসলামের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেছেন। এ সময় তিনি তিস্তা পাড়ে চীন যা করতে চায় তার বিস্তারিত জানান। এ সময় তিনি সেখানকার উত্তরা ইপিজেডে চীনা অর্থায়নে নির্মিত বিভিন্ন প্রকল্পের অগ্রগতিও জানান বিভাগীয় কমিশনারকে।
উল্লেখ্য, উত্তরাঞ্চলে দুই দিনব্যাপী এই সফরের দ্বিতীয় দিনে গতকাল চীনা রাষ্ট্রদূতের নেতৃত্বে দলটি রংপুরের পানি উন্নয়ন বোর্ডের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও স্থানীয় নেতৃবৃন্দের সঙ্গে দুই দেশের মধ্যে প্রস্তাবিত তিস্তা মহাপরিকল্পনার বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করেন। পরে তারা গাইবান্ধায় তিস্তা নদীর ওপর নির্মাণাধীন ব্রিজও পরিদর্শন করেন।
এর আগেরদিন হাতীবান্ধা-পাটগ্রাম আসনের সংসদ সদস্য এবং সাবেক মন্ত্রী মোতাহার হোসেন তাকে সেখানে স্বাগত জানান।
বিভাগীয় কমিশনার মো. সাবিরুল ইসলাম সংবাদমাধ্যমকে বলেন, তিস্তা ব্যারেজ প্রকল্পে চীন কী কী করতে চায় তা জানিয়েছেন রাষ্ট্রদূত লি জিমিং। পানি সম্পদ মন্ত্রণালয় থেকে প্রকল্পটির নীতিগত অনুমোদন পাওয়ার পরই তিনি এলাকাটি দেখতে আসেন বলে জানান। তবে এই প্রকল্পে এখনো সরকার থেকে অনাপত্তি পত্র দেয়া হয়েছে কিনা তা তিনি জানেন না বলে জানান। কারণ, সরকার থেকে কোনো প্রকল্প নীতিগতভাবে সম্মতি পেলেও কাজ শুরুর আগে অনাপত্তি পত্র পেতে হয়।
স্থানীয় সংসদ সদস্য মোতাহার হোসেন বলেন, চীনের রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে আলোচনায় দেখলাম, তারা খুব পজেটিভ এই ব্যারেজের কাজ করতে। আমিও ব্যক্তিগতভাবে (এটা) মনে করি। আমি ১১/১২ বার চীন গিয়েছি। ৫ বার আমি ওদের হোয়াং হো নদী দেখতে গিয়েছিলাম। সেই জায়গা থেকে আমার মনে হয়েছে যে, তারাই পারবে, আর কেউ পারবে না। চীন দিয়েছে আট হাজার চারশ কোটি টাকা। আর ভারত দিয়েছে দুই হাজার চারশ কোটি টাকা। আমাদের ফাইন্যান্সাররা (বিশ্বব্যাংক, এডিবি) বললো, এটা কীভাবে সম্ভব! দুই হাজার কোটি আর আট হাজার কোটি!
সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, চীনের অর্থায়নে তিস্তা ব্যবস্থাপনায় বিভিন্ন অবকাঠামো নির্মাণের পাশাপাশি গ্রীষ্মকালে পানির ঘাটতি মেটানোর জন্য বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ নির্মাণ করা হবে। ভারতের সঙ্গে তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি না হওয়ায় শুষ্ক মৌসুমে পানি ধরে রাখার জন্য বিকল্প ব্যবস্থা করা হবে।
সব মিলিয়ে এ পর্যন্ত প্রকল্পে যে বিষয়গুলো প্রাধান্য পেয়েছে, সেগুলোর মধ্যে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ- নদী খনন, বাঁধ মেরামত ও বাঁধ নির্মাণ এবং জমি পুনরুদ্ধার। এ ছাড়া বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ মেরামতেরও পরিকল্পনা রয়েছে। তিস্তা নদী সমন্বিত ব্যবস্থাপনা ও পুনরুদ্ধার নামের প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে তিস্তা নদীর ডান ও বাম উভয় তীরে ২২০ কিলোমিটার উঁচু গাইড বাঁধ, রিভার ড্রাইভ, হোটেল-মোটেল-রেস্তোরাঁ, আধুনিক শহর ও পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তোলা হবে।
সেই সঙ্গে ১৫০ মেগাওয়াট সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্র, শিল্প কারখানা, ইপিজেড নির্মাণ করা হবে। এছাড়া কয়েক লাখ হেক্টর কৃষি জমি সংরক্ষণ ও বনায়ন করা হবে।
এই প্রকল্পের আওতায় তিস্তার মূল স্রোত হবে দুই কিলোমিটার, যা সারা বছর নাব্যতা বজায় রাখবে। এটি বেশ কয়েকটি খাল দ্বারা সংযুক্ত হবে, যা তিস্তা পাড়ের কোটি কোটি মানুষ উপকৃত হবে।
মহাপরিকল্পনার মাধ্যমে তিস্তার দুই তীরকে চায়নার হুয়াং হো নদী ও সু’চিয়ান শহরের আদলে আধুনিকায়ন করা হবে বলে জানা গেছে। বাঁধের দুই পাশে মেরিন ড্রাইভ থাকবে। আধুনিক সেচ প্রকল্প ও যন্ত্রপাতিসহ কৃষি ফ্রেম নির্মাণ করা হবে। একই সঙ্গে নদীর দুই তীরে স্যাটেলাইট শহর গড়ে তোলা হবে। এতে প্রায় ৯ হাজার কোটি টাকা খরচ হতে পারে।
তবে বহুল কাক্সিক্ষত মহাপরিকল্পনা এখনো শুরু হয়নি।
গত রোববার চীনা রাষ্ট্রদূত লি জিমিং মাত্র তিস্তা ব্যারেজ পরিদর্শন করেন। এ সময় তিনি এলাকার মানুষের আশা-আকাক্সক্ষার কথা শোনেন। এ সময় বিপুল সংখ্যক এলাকাবাসী, নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি ও প্রশাসনের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
চীনা রাষ্ট্রদূত বলেছেন, আমরা এখানে নদী ড্রেজিংয়ের সম্ভাবনা অন্বেষণ করতে এসেছি, আমাদের প্রকৌশলীরা প্রকল্পের সময়সীমা নিশ্চিত করার জন্য অবস্থাটি বিশদভাবে জানার চেষ্টা করছেন। আমরা আত্মবিশ্বাসী যে তিস্তা মেগা প্রকল্প খুব শিগগিরই চালু হতে পারে। এই প্রকল্পের ফলে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি হবে এবং এই অঞ্চলের মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নত হবে, যারা প্রাথমিকভাবে কৃষির উপর নির্ভরশীল।
ভারত থেকে বাংলাদেশে প্রবেশকারী ৫৪টি নদীর মধ্যে তিস্তা একটি। ভারতের সিকিম ও পশ্চিমবঙ্গের উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে রংপুর অঞ্চল দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে এটি। পরে এটি কুড়িগ্রামের চিলমারীর কাছে ব্রহ্মপুত্র নদের সঙ্গে মিলিত হয়েছে।
তিস্তার পানি বণ্টনের দাবি বহু বছর ধরে। কিন্তু ভারতের পক্ষ থেকে নানা অজুহাতে চুক্তিটি ঝুলে আছে। এ কারণে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের মানুষ এখন তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের স্বপ্ন দেখছে।
২০১১ সালে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের ঢাকা সফরের সময় তিস্তা চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির বিরোধিতার মুখে তা স্থগিত হয়ে যায়।
তারপর ২০১৫ ও ২০২১ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশ সফর করেন। সেখানে তিনি আশ্বাস দেন যে তিস্তার পানি বণ্টন নিয়ে সমঝোতা হবে। কিন্তু তিস্তা সমস্যার সমাধান হয়নি।
সর্বশেষ বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরে তিস্তার পানি বণ্টন নিয়ে সমঝোতায় পৌঁছানোর সম্ভাবনা থাকলেও তা হয়নি।
এররকম পরিস্থিতিতে চীনা দূতের তিস্তা ব্যারেজ প্রকল্প এলাকা পরিদর্শন অনেকটা তাৎপর্যপূর্ণ। তিনি কার্যত বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে এই কৌশলগত বার্তাটিই দিলেন যার অর্থ হলো-তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি কবে হবে তার জন্য আর অপেক্ষা না করে ঢাকা যেন বেইজিংয়ের সহায়তায় তিস্তাকে ঘিরে নেয়া মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করে।
দুই বছর আগে বাংলাদেশ চীনের অর্থায়নে ১ বিলিয়ন ডলারের এই প্রকল্প বাস্তবায়নের প্রস্তাব দেয়। এখন এতো বড় প্রকল্পে চীন জড়িত হওয়ার সম্ভাবনা ভারতকে যেমন উদ্বিগ্ন করবে, পাশাপাশি সবচেয়ে বিশ্বস্ত প্রতিবেশীর সঙ্গে জল-কূটনীতির ব্যর্থতার ইঙ্গিতবহ এটি। এছাড়া রয়েছে কৌশলগত উদ্বেগও।
এই প্রকল্পের ফলে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের ১০০ কিলোমিটারের মধ্যে চীনাদের উপস্থিতি ভারতের জন্য অস্বস্তিকর।
কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, এই প্রকল্পে চীনের সম্পৃক্ততা সম্পর্কে নয়াদিল্লির আপত্তির পর শেখ হাসিনা সরকার পরিকল্পনাটি সাময়িকভাবে স্থগিত করে।
এই প্রেক্ষাপটে, গত মাসে শেখ হাসিনার ভারত সফরের সময় তিস্তার পানি ভাগাভাগির বিষয়ে দিল্লির সমঝোতার ব্যর্থতার পরে এই প্রকল্পে ঢাকার নতুন করে আগ্রহের প্রতিফলন হিসাবে চীনের রাষ্ট্রদূতের নেতৃত্বে একটি কারিগরি দলের ওই তিস্তা ব্যারেজ এলাকায় সফর অনেক তাৎপর্যপূর্র্ণ।
সূত্রের মতে, বাংলাদেশে পানি একটি আবেগপ্রবণ ইস্যু, তাই তিস্তা চুক্তি সম্পাদনের জন্য অনির্দিষ্টকাল অপেক্ষা করা সরকারের জন্য ভালো সুযোগ নয়। এছাড়া, বাংলাদেশের গবেষকরা তিস্তার পানি শুকিয়ে যাওয়া এবং এর প্রভাব কৃষি অর্থনীতি এবং এ অঞ্চলের বাস্তুসংস্থানের বিষয়েও উদ্বিগ্ন।
তবে সবকিছুতেই অভিসন্ধি খোঁজার দরকার নেই মন্তব্য করে চীনে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত মুন্সী ফয়েজ আহমেদ বলেন, তারা (ভারত) আমাদের পানি দেবে না, আবার আমাদের স্বার্থে কোনো কাজ করবো তা নিয়েও সমালোচনা করবে-এটা হয় না।
তারমতে, বাংলাদেশ-ভারত-চীন মিলেমিশে থাকলে সবারই মঙ্গল হবে। পাশাপাশি জনগণেরও লাভ হবে।