শনিবার, ১৮ মে, ২০২৪ | ৪ জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩১ | ৯ জিলকদ, ১৪৪৫

মূলপাতা জাতীয়

‘কঠিন বার্তা’ দিয়ে ঢাকা ছাড়লেন জাতিসংঘ হাইকমিশনার


রাজনীতি সংবাদ ডেস্ক প্রকাশের সময় :১৮ আগস্ট, ২০২২ ১০:০১ : পূর্বাহ্ণ
জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের হাইকমিশনার মিশেল ব্যাচেলেট
Rajnitisangbad Facebook Page

চারদিনের সফর শেষ করে ঢাকা ছেড়ে যাওয়ার কয়েক ঘণ্টা আগে গতকাল বুধবার সন্ধ্যায় বাংলাদেশকে ‘কঠিন বার্তা’ দিয়ে গেলেন জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের হাইকমিশনার মিশেল ব্যাচেলেট।

এর আগে সফরের প্রত্যেক দিন তিনি বলেছেন, আমি সমালোচনা করার জন্য বাংলাদেশে আসিনি। আলোচনা করতে এসেছি।

কিন্তু শেষ দিন বুধবার সন্ধ্যায় ঢাকায় এক সংবাদ সম্মেলনে দক্ষিণ এশিয়ার দেশটির নানা ইস্যু নিয়ে বাচেলেট বলেন, গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও পুলিশ হেফাজতে নির্যাতনের ঘটনায় নিরপেক্ষ তদন্ত চায় জাতিসংঘ। পাশাপাশি ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনের সংশোধনের কথাও বলেছেন তিনি।

তারমতে, বাংলাদেশ আগামী নির্বাচনের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। একটি উত্তেজনাকর ও মেরুকরণের দিকে যাচ্ছে। এই অবস্থায় সুশীল সমাজের কর্মকাণ্ড খুবই গুরুত্বপূর্ণ হলেও দেশটিতে সুশীল সমাজ ও বিভিন্ন অধিকার কর্মীদের কাজের ক্ষেত্র সংকুচিত হয়েছে বলে মনে করেন জাতিসংঘের মানবাধিকার প্রধান মিশেল বাচেলেট।

জানতে চাইলে সাবেক পররাষ্ট্র সচিব শমসের মবিন চৌধুরী বলেন, মিশেল ব্যাচেলেটের সফর থেকে এটাই প্রতীয়মান হয়েছে, মানুষ যাতে অর্থনৈতিক, সামাজিক ও বিচারিক অধিকার প্রয়োগ করতে পারে-তার ক্ষেত্র নিশ্চিত করতে হবে। গত চার দিন তিনি সমালোচনামূলক কোনো বক্তব্য না দিলেও শেষ দিনে মিডিয়া ব্রিফিংয়ে তিনি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড নিয়ে তদন্তের কথা বলে কার্যত সরকারের প্রতি কঠিন বার্তা দিয়েই গেলেন বলে মনে হচ্ছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ ছিদ্দিকুর রহমান খান বলেন, জাতিসংঘ আইন আদালত বসিয়ে বিচার করবে না। কিন্তু তারা যা বলেছে তা আমলে না নিলে খুব একটা সুখকর হবে না।

সংবাদ সম্মেলনে জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনার বলেন, বিভিন্ন সময়ে ঘটে যাওয়া গুম ও বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করে স্বাধীনভাবে তদন্তের দাবি জানিয়েছেন। পাশাপাশি রাজনৈতিক সভা-সমাবেশ, সংলাপের সুযোগ ও সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করার দাবি জানান তিনি।

বিশ্লেষকরা বলেছেন, জাতিসংঘের মানবাধিকার প্রধান ঢাকা সফরে এসে গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের নিরপেক্ষ তদন্ত দাবি জানালেও সরকার স্বীকারই করে না বাংলাদেশে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড কিংবা গুম হয়।

ঢাকা সফরের প্রথমদিনে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেনের সঙ্গে বৈঠক করেন ব্যাচেলেট।

সেই বৈঠক শেষে পররাষ্ট্রমন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেছিলেন, দেশে কোনো বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটে না। সঙ্গত কারণেই জাতিসংঘের মানবাধিকার প্রধানের তদন্তের দাবি কতটা ফলপ্রসূ হবে তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে।

সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন প্রসঙ্গে মিশেল বাচেলেট বলেন, আমি কক্সবাজার রোহিঙ্গা শিবির পরিদর্শন করেছি। এই সঙ্কটের মূল কারণ খুঁজে বের করতে হবে। তবে দুঃখজনক হলেও এই মুহূর্তে রোহিঙ্গাদের ফেরার সুযোগ নেই। রোহিঙ্গা হত্যার তদন্ত করতে হবে। এর পেছনে কারা ছিল, বের করতে হবে। রুয়ান্ডার গণহত্যার তদন্ত যেভাবে হয়েছে, এখানেও সেটা জরুরি।

তিনি বলেন, আমরা হয়তো বিভিন্ন প্রস্তাব পাস করতে পারি, কিন্তু মিয়ানমার যদি না মেনে চলে তাহলে কী করার আছে। এছাড়া রোহিঙ্গারাও মিয়ানমারে ফিরে যেতে আস্থা পাচ্ছে না। বিশ্লেষকরা বলেছেন, ব্যাচেলেটের এমন কথা মধ্য দিয়ে এটুকু বলা যায়, রোহিঙ্গাদের নিজভূমে ফেরত পাঠাতে কার্যত তিনি কোনো শক্তিশালী বার্তা দিতে পারেননি।

ব্যাচেলেট বলেন, বাংলাদেশ আর্থ সামাজিক খাতে অভূতপূর্ব উন্নতি করেছে। এদেশের অনেক খাতে অগ্রগতি হয়েছে। এখানে আমি আসতে পেরে খুশি।

জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনার আরো বলেন, বাংলাদেশে বিভিন্ন পক্ষের সঙ্গে আমার আলাপ হয়েছে। সে সময় ডিজিটাল সিকিউরিটি আইন নিয়েও উদ্বেগ প্রকাশ করেছি আমি।

এক প্রশ্নের উত্তরে ব্যাচেলেট বলেন, আমার এখানে আসার পেছনে কোনো ম্যাজিক নেই। আমি এখানে আসার জন্য আমন্ত্রিত ছিলাম।

তিনি বলেন, বাংলাদেশ সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে অভূতপূর্ব উন্নতি করেছে এবং ২০২৬ সালে স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে উত্তরণ ঘটতে যাচ্ছে। একইসঙ্গে দেশটি মানবাধিকার বিষয়ক অনেক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্র বাড়ানো, মত প্রকাশের স্বাধীনতা, সমাবেশ করার অধিকার এবং বিরোধী নেতা-কর্মীদের রক্ষা করা নির্বাচনকালীন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। মনে রাখতে হবে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যেন অতিরিক্ত বল প্রয়োগ না করে বিরোধী দলের সমাবেশে।

জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনার বলেন, গুম, আইনবহির্ভূত হত্যা ও অত্যাচারের অভিযোগ গত কয়েক বছর ধরে শোনা যাচ্ছে এবং এগুলোর অনেকগুলোই র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটেলিয়ন (র‌্যাব) করেছে বলে অভিযোগ আছে। আমি মন্ত্রীদের সঙ্গে আলোচনায় এ বিষয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছি এবং স্বাধীন ও নিরপেক্ষ তদন্তের কথা জানিয়েছে।

গুমের বিষয়ে ঢিলেঢালা তদন্তের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে তিনি বলেন, এ বিষয়ে সরকারকে পরামর্শ দিয়েছি, একটি স্বাধীন বিশেষায়িত মেকানিজম প্রতিষ্ঠা করার। যেখানে সবার সঙ্গে কথা বলে তদন্ত করা হবে। আমার অফিস এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা দিতে প্রস্তুত। ডিজিটাল সিকিউরিটি আইন নিয়েও সরকারের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, আমার অফিস এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় কয়েকটি সংশোধনীর প্রস্তাব করেছে।

মিশেল ব্যাচেলেট বলেন, টেকসই অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য আগামী নির্বাচন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এসময় রাজনৈতিক দল, কর্মী, সুশীল সমাজের কর্মীদের সভা সমাবেশের সুযোগ দেয়া জরুরি। তাদের অধিকার থেকে যদি বঞ্চিত করা হয় তাহলে সামাজিক অস্থিরতার জন্ম দিতে পারে। নারী, সংখ্যালঘু, তরুণদের দাবি বা চাওয়া শুনতে হবে। ওই সময়টাতে যে রাজনৈতিক অস্থিরতা থাকবে সেখানে অতিরিক্ত বলপ্রয়োগের ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে। আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী মানবাধিকার রক্ষায় বাংলাদেশকে কাজ করতে হবে।

গত রোববার বাংলাদেশে আসেন জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনার মিশেল বাচেলেট। প্রথম দিনেই তিনি পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল, আইনমন্ত্রী আনিসুল হক এবং শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনির সঙ্গে বৈঠক করেন। পাশাপাশি মানবাধিকার কর্মী, জাতীয় মানবাধিকার কমিশন, বিভিন্ন দেশের হাইকমিশনার ও অ্যাম্বাসেডারদের সঙ্গে বৈঠক করেন। এ সময় গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, সংবাদমাধ্যম এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতাসহ নানা বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়।

মন্তব্য করুন
Rajnitisangbad Youtube


আরও খবর