সোমবার, ২৫ নভেম্বর, ২০২৪ | ১০ অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ | ২২ জমাদিউল আউয়াল, ১৪৪৬

মূলপাতা চট্ট-মেট্টো

এ কেমন ‘ড্রেস কোড’! চট্টগ্রাম ক্লাবে পাঞ্জাবি পরে ঢুকতে পারে না কেউ


চট্টগ্রাম ক্লাব

বিশেষ প্রতিনিধি প্রকাশের সময় :১৭ আগস্ট, ২০২২ ৯:০১ : অপরাহ্ণ

কয়েকবছর আগে চট্টগ্রাম ক্লাবে বেসরকারি একটি ব্যাংকের অনুষ্ঠানে অতিথি ছিলেন দেশের স্বনামধন্য একটি শিল্পগ্রুপের চেয়ারম্যান। যিনি বছরে সরকারকে ৮০০ কোটি টাকা ট্যাক্স দেন। সেদিন ওই শিল্পপতির পরনে পাঞ্জাবি থাকায় তাকে ক্লাবের গেইট থেকে ফিরিয়ে দেওয়া হয়!

২০২১ সালে ট্রাস্ট ব্যাংক লিমিটেড প্রতিষ্ঠানটির শীর্ষ কর্মকর্তা ও ব্যবসায়ীদের নিয়ে একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিল। সে অনুষ্ঠানে পাঞ্জাবি পরে যাওয়ায় এক ব্যবসায়ীকে বের করে দেওয়া হয়। বিষয়টি নিয়ে আয়োজক প্রতিষ্ঠান বেশ বিব্রতকর অবস্থায় পড়েছিল।

স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম দৈনিক আজাদীর প্রয়াত সম্পাদক ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেককেও পাঞ্জাবি পরার কারণে চট্টগ্রাম ক্লাবে ঢুকতে দেওয়া হয়নি।

পাঞ্জাবি পরে যাওয়া এমন অনেক অতিথিকেই চট্টগ্রাম ক্লাবের গেট থেকে বিদায়ের ঘটনা ঘটেছে।

জানা যায়, চট্টগ্রাম ক্লাবে সদস্য ও অতিথিদের টি-শার্ট ও শার্টের সঙ্গে ফরমাল সু বা ক্লাব নির্দেশিত স্যান্ডেল পরে যেতে হয়।

কোনো অতিথি বাঙালির ঐতিহ্যবাহী পোশাক পাঞ্জাবি পরিহিত অবস্থায় চট্টগ্রাম ক্লাবে গেলে তাদের ড্রেস কোডের (পোশাক রীতি) দোহাই দিয়ে ঢুকতে দেওয়া হয় না।

বিভিন্ন সময়ে অনেক স্বনামধন্য ব্যক্তি, শিল্পপতি ও ব্যবসায়ী পাঞ্জাবি পরে চট্টগ্রাম ক্লাবে গিয়ে ঢুকতে পারেননি। এসব ব্যক্তিরা অপমানে আর কখনো ক্লাবে যাননি।

ভারতের তামিলনাড়ু রাজ্যের ঐতিহ্যবাহী পোশাক হলো ভেশ্‌তি (লুঙ্গির মতো জড়িয়ে নেওয়া ধুতি)। ২০১৪ সালে মাদ্রাজ হাইকোর্টের একজন বিচারপতি এই ভেশ্‌তি পরে তামিলনাড়ু ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন ক্লাবে গিয়েছিলেন। তার সঙ্গে ছিলেন আরও দুজন ভেশ্‌তি-পরা আইনজীবী। কিন্তু ক্লাবের ড্রেস কোডের দোহাই দিয়ে কর্তৃপক্ষ তাদের ভেতরে ঢুকতে দেননি।

এই খবর জানাজানি হওয়ার পর চেন্নাইয়ের অভিজাত ক্লাবগুলোর বিরুদ্ধে তীব্র সমালোচনা শুরু হয়। তামিলনাড়ুর রাজনৈতিক দলগুলোও ভেশ্‌তির পক্ষে অবস্থান নিয়ে আন্দোলন করেন।

এ ঘটনায় তামিলনাড়ুর রাজনীতিক তৎকালীন ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিআই) এমপি ডি রাজা বলেছিলেন, ‘মানুষ কী পরবে তা ঠিক করার অধিকার তো তার। আর তামিলনাড়ুতে সবচেয়ে স্বাভাবিক পোশাক হলো ধুতি বা ভেশ্‌তি। এটা পরার জন্য কীভাবে আপত্তি উঠতে পারে বা একজনকে কোথাও ঢুকতে বাধা দেওয়া হতে পারে? এ তো জঘন্য ব্যাপার।’

এ ঘটনা ঘটার এক মাসেরও কম সময়ের মধ্যে তামিলনাড়ু সরকার একটি আইন তৈরি করে ফেলে।

সে আইনে কোনো বিনোদন ক্লাব, সংস্থা, ট্রাস্ট, কোম্পানি বা সোসাইটি যদি ভেশ্‌তি পরার জন্য কাউকে ঢুকতে বাধা দেয় তাহলে তাদের এক বছর পর্যন্ত জেল ও এক লক্ষ টাকা পর্যন্ত জরিমানার বিধান রাখা হয়।

তামিলনাড়ুর ভেশ্‌তির মতো বাঙালির অঘোষিত জাতীয় পোশাক পাঞ্জাবি। সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব বয়সী বাঙালি পুরুষ পাঞ্জাবি পরে থাকেন। আর সেই পোশাকটিই কিনা নিষিদ্ধ চট্টগ্রাম ক্লাবে!

বাঙালি সংস্কৃতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক চট্টগ্রাম ক্লাবের এ পোশাক রীতি নিয়ে দীর্ঘকাল ধরে সমালোচনা চলে আসছে।

চট্টগ্রাম ক্লাবের বিতর্কিত ‘ড্রেস কোড’ নিয়ে সম্প্রতি বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশ হচ্ছে।

এ নিয়ে সচেতন নাগরিকরা চট্টগ্রাম ক্লাবের তীব্র সমালোচনা করছেন।

চট্টগ্রাম ক্লাবের বয়স এখন ১৪৫ বছর। ১৮৭৮ সালের ২৩ আগস্ট তৎকালীন বৃটিশ শাসনামলে বিনোদনমূলক এই ক্লাবটি প্রতিষ্ঠিত হয়। ২০১৩ সালে বন্দরনগরীর লালখান বাজার মোড়ে চট্টগ্রাম ক্লাবের ৪ তলা বিশিষ্ট ভবন নির্মিত হয়।

চট্টগ্রাম ক্লাব

এটি দক্ষিণ এশিয়ার প্রাচীনতম ক্লাব হিসেবে বিবেচিত।

প্রতিষ্ঠার শুরুতে এই ক্লাবে বৃটিশরাই কেবল সদস্য হতে পারতেন। ফলে এখানে বৃটিশদের সংস্কৃতি ও আচারঘনিষ্ঠ নিয়মই চলতো। তখন থেকে ক্লাব সদস্যদের ‘ড্রেস কোড’ তৈরি করা হয়েছিল বৃটিশ সংস্কৃতি মেনে।

১৯৪৭ সালে ব্রিটিশরা চলে যাওয়ার পর পাকিস্তান আমলেও ক্লাবের ‘ড্রেস কোড’ পরিবর্তন হয়নি। পাকিস্তানিরা পাঞ্জাবিকে হিন্দু সম্প্রদায়ের পোশাক মনে করতো। আর তখন বাঙালিদের সদস্য হওয়ার সুযোগ ছিল না।

কিন্তু বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার ৫০ বছর পরও চট্টগ্রাম ক্লাব পরিচালিত হচ্ছে ব্রিটিশ শাসনামলের ভাবধারায়। বাঙালি সংস্কৃতি ও জীবনাচারকে উপেক্ষা করে এখনো বৃটিশদের চালু করা ‘ড্রেস কোড’ ধরে রেখেছে প্রতিষ্ঠানটি।

সচেতন নাগরিকরা বলছেন, পাঞ্জাবির অপমান মানে বাঙালি সংস্কৃতির অপমান।

চট্টগ্রাম ক্লাবে ব্রিটিশদের গোলামির নিয়ম এখনো কীভাবে বহাল আছে তা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন চট্টগ্রামের সচেতন নাগরিকরা।

জানা গেছে, চট্টগ্রাম ক্লাব কর্তৃপক্ষ চাইলে বিশেষ সাধারণ সভায় (ইজিএম) ড্রেস কোডের সংশোধন বা পরিবর্তন আনতে পারে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম ক্লাবের চেয়ারম্যান নাদের খান রাজনীতি সংবাদকে বলেন, ‘এই ক্লাবের বয়স এখন ১৪৫ বছর। এতো বড় একটা সংগঠন এতো বছর ধরে পরিচালিত হয়ে আসছে সংবিধানের মাধ্যমে। বাংলাদেশের যে রকম সংবিধান আছে, তেমনি এই ক্লাবেরও মেমোরেন্ডাম অ্যান্ড আর্টিকেল আছে। কেউ কোনো অনুষ্ঠানের জন্য ক্লাবের হল বুকিং করলে তাকে ড্রেস কোডের কথা বলা হয়ে থাকে। শুধু চট্টগ্রাম ক্লাব কেন, সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনীর কোনো অনুষ্ঠান হলে অতিথিদের আমন্ত্রণপত্রে ড্রেস কোডের কথা উল্লেখ থাকে। এটা ইন্টারন্যাশনাল কার্টেসি। এই ড্রেস কোড নিয়ে কে কি বললো তাতে আমাদের কিছু যায় আসে না।’

অনেক স্বনামধন্য ব্যক্তি, শিল্পপতি ও ব্যবসায়ী পাঞ্জাবি পরে চট্টগ্রাম ক্লাবে গিয়ে ঢুকতে না পারার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘যাদের ঢুকতে দেওয়া হয়নি, তারা শিল্পপতি হলেও ক্লাবের মেম্বার হওয়ার উপযুক্ত না। এই ক্লাবে যাকে তাকে মেম্বার করা হয় না, হাজার শিল্পপতি হোক।’

ক্লাবের সদস্য ও সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাঙালি সংস্কৃতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক ড্রেস কোডের এই নিয়ম বাতিল করা জরুরি। ক্লাবের কমিটি ইজিএমে এমন পোশাক রীতির নিয়ম বাতিল করতে পারে।

চট্টগ্রাম ক্লাবের সাবেক চেয়ারম্যান এমএ ছালাম বলেন, ‘ক্লাবটি এখনো ব্রিটিশদের অনেক নিয়ম মেনে চলছে। ড্রেস কোডও তার অংশ। এই ড্রেস কোড নিয়ে অনেক সদস্যের ক্ষোভ আছে। কালের পরিক্রমায় অনেক ক্লাব তাদের নিয়মে পরিবর্তন এনেছে। ঢাকা ক্লাব নিয়ম পরিবর্তন করে পাঞ্জাবি অ্যালাউ করেছে। এখানেও এই নিয়ম পরিবর্তন করা দরকার।’

আরও পড়ুন: সমালোচনার মুখে সঙ্গীতানুষ্ঠান স্থগিত করলো চট্টগ্রাম ক্লাব

মন্তব্য করুন
Rajniti Sangbad


আরও খবর