নিজস্ব প্রতিবেদক প্রকাশের সময় :২৪ মার্চ, ২০২২ ৫:০১ : অপরাহ্ণ
হঠাৎ দেশে মার্কিন ডলারের সংকট দেখা দিয়েছে। ডলারের সংকট প্রকট আকার ধারণ করায় চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহ কম হচ্ছে। ফলে বাড়তি চাহিদার কারণে হু হু করে বেড়েই চলেছে ডলারের দাম। এতে করে মান হারাচ্ছে দেশীয় মুদ্রা টাকা।
গতকাল বুধবার আন্তঃব্যাংকে প্রতি ডলার বিক্রি হয়েছে ৮৬ টাকা ২০ পয়সা করে। তবে সংকটের কথা বলে অনেক ব্যাংক ৮৯ টাকা থেকে ৯০ টাকা আদায় করেছে।
আন্তঃব্যাংকের তুলনায় খোলাবাজারে ডলারের দাম আরও চড়া। খোলা বাজারে প্রতি ডলার কিনতে ক্রেতাকে খরচ করতে হচ্ছে প্রায় ৯৩ টাকা।
বর্তমানে আন্তঃব্যাংকের সঙ্গে খোলাবাজারের ডলারের দামের পার্থক্য প্রায় ৬ টাকা। স্বাভাবিক সময়ে এই পার্থক্য আড়াই থেকে ৩ টাকার মধ্যে থাকে।
সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক ডলারের দাম ২০ পয়সা বাড়িয়ে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর কাছে বিক্রি করছে ৮৬ টাকা ২০ পয়সা করে।
গত বছরের ২ আগস্ট আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারে প্রতি ডলার ৮৪ টাকা ৮১ পয়সায় বিক্রি হয়, যা বাড়তে বাড়তে চলতি বছরের ৯ জানুয়ারি ৮৬ টাকা ওঠে।
তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের ঘোষিত রেটে আমদানি পেমেন্টের জন্য ডলার পাচ্ছেন না ব্যবসায়ীরা। এতে আমদানিকারকদের গুনতে হচ্ছে বাড়তি অর্থ।
বর্তমানে আমদানি পেমেন্টের ক্ষেত্রে আমদানিকারকদের প্রতি ডলারের জন্য গুনতে হচ্ছে প্রায় ৮৯-৯০ টাকা।
বাজারে ডলার সংকট তৈরির পেছনে ব্যাংকগুলোকে দায়ী করছেন ব্যবসায়ী ও আমদানিকারকরা।
ব্যবসায়ী ও আমদানিকারকদের অভিযোগ, কেন্দ্রীয় ব্যাংক চাহিদা অনুযায়ী অন্যান্য ব্যাংকগুলোকে ডলার সরবরাহ করছে না। এ কারণে সংকটের কথা বলে নতুন এলসি খুলতে অনীহা ও আগের এলসির পেমেন্ট পরিশোধে ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে ঘোষিত রেটের চেয়ে ৪ টাকা পর্যন্ত বেশি আদায় করছে ব্যাংকগুলো। এতে ব্যবসায়ীদের আমদানি খরচ অনেক বেড়ে যাচ্ছে। আমদানি খরচ বৃদ্ধি পাওয়ায় পণ্যমূল্যও বাড়ছে।
কারা কেন ডলার কিনছেন তা খতিয়ে দেখার পরামর্শ দিয়েছেন অর্থনীতিবিদরা।
সাধারণত ডলারের দাম বাড়লে রেমিট্যান্স বৃদ্ধি ও রপ্তানিকারকরা লাভবান হন। আর ক্ষতিগ্রস্ত হয় আমদানিকারক ও সাধারণ মানুষ। কারণ ডলারের দাম বাড়লে পণ্যের মূল্যও বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে।
এরই মধ্যে আমদানি করা অনেক পণ্যের দাম বেড়ে গেছে। এতে সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস উঠেছে।
সংকট কাটাতে রিজার্ভ থেকে ডলারের সরবরাহ বাড়িয়ে এলসি খোলার সুযোগ ও দাম নিয়ন্ত্রণের দাবি জানিয়েছেন ব্যবসায়ী ও আমদানিকারকরা।
সংশ্লিষ্টরা জানায়, করোনা মহামারির সময় দেশে প্রবাসীদের পাঠানো আয় অনেক বেড়েছিল। কিন্তু পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ায় আন্তর্জাতিক চলাচল শুরু হলে রেমিট্যান্স কমতে শুরু করেছে। অন্যদিকে, আমদানি ব্যয়ও বাড়তে শুরু করেছে। করোনা চলাকালীন শিল্পের কাঁচামাল ও মেশিনারিজ আমদানি কম ছিল। সম্প্রতি তা বাড়তে শুরু করেছে। এ ছাড়া করোনার কারণে আমদানির অনেক এলসি’র অর্থ পরিশোধ বকেয়া ছিল। এখন সেগুলো পরিশোধ করতে হচ্ছে। সব মিলিয়ে বাজারে বৈদেশিক মুদ্রার চাহিদার তুলনায় সরবরাহে ঘাটতি দেখা দিয়েছে। এসব কারণে করোনা মহামারি-পরবর্তীতে ডলারের সংকট প্রকট আকার ধারণ করেছে।
বিভিন্ন ব্যাংকে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বিপিসিসহ গভর্নমেন্টের কিছু পেমেন্ট হওয়ায় গত এক সপ্তাহ ধরে আন্তঃব্যাংকে ডলারের বড় ধরনের সংকট তৈরি হয়েছে। এমনকি সরকারি ব্যাংকগুলোর কাছেও প্রয়োজনীয় ডলার নেই। ফলে এই সংকটকে পুঁজি করে ব্যাংকগুলো যেমন খুশি তেমন ডলারের রেট আদায় করছে।
ব্যবসায়ীরা জানান, এলসি খোলার সময় ব্যাংকগুলো ডলারের যে রেট ধরে, পেমেন্টের দিনে সেই রেট নিতে চায় না। এমনকি পেমেন্টের তারিখে যেই রেট থাকে সেই রেটেও ডলার দিচ্ছে না।
চট্টগ্রামের একজন ব্যবসায়ী রাজনীতি সংবাদকে জানান, একটি বিদেশি ব্যাংক এলসি পেমেন্টে তাদের কাছ থেকে ৮৯ টাকা ৯০ পয়সা করে ডলার রেট নিয়েছেন। কিন্তু যখন তিনি এলসি খুলেছিলেন, তখন ডলারের রেট ছিল ৮৫ টাকার মতো। এখন সেটি ৮৬ টাকা ২০ পয়সায় উঠেছে। কিন্তু ব্যাংকটি সংকটের কথা বলে ঘোষিত রেটের চেয়েও প্রায় চার টাকা বেশি নিয়েছে।
এই ব্যবসায়ীর প্রশ্ন-তাহলে কি ডলারের বাজার যথাযথ মনিটরিং হচ্ছে না? ডলারের দামে লাগাম টানার কি কেউ নেই?
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ড. মো. হাবিবুর রহমান গণমাধ্যমকে বলেন, কয়েক মাস আমাদের আমদানি অস্বাভাবিক গতিতে বাড়ছে। কিন্তু একই সময়ে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স কমে গেছে। এ কারণে বাজারে ডলারের কিছুটা সংকট রয়েছে। এ সংকট সামাল দিতে ব্যাংকগুলোর চাহিদা অনুযায়ী বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে প্রায় প্রতিদিনই ডলার বিক্রি করা হচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ গণমাধ্যমকে বলেন, আন্তঃব্যাংকে ডলারের সংকট কি শুধু আমদানি বৃদ্ধির কারণে হচ্ছে, নাকি ব্যাংকগুলো ডলার ধরে রেখেও সংকট তৈরি করছে সেটি কেন্দ্রীয় ব্যাংক যথাযথ তদারিকর মাধ্যমে দেখতে পারে। এ ছাড়া খোলাবাজার থেকে কারা ডলার কিনছেন, প্রয়োজনে কিনছেন, নাকি অপ্রয়োজনে কিনে ব্যবসার করছেনও সেটিও খতিয়ে দেখা দরকার।
তিনি বলেন, ডলারের দাম বেশি হলে আমদানি খরচ আরও বাড়বে, যার প্রভাব পড়বে পণ্যমূল্যেও।
করোনা পরিস্থিতি উন্নতি হওয়ার পর থেকে দেশে অস্বাভাবিক গতিতে বাড়ছে বিভিন্ন পণ্যের আমদানি। মূলধনী যন্ত্রপাতি, শিল্পের কাঁচামাল, শিল্পের মধ্যবর্তী পণ্য, খাদ্যপণ্য, জ্বালানি তেলসহ সব পণ্যের আমদানিই এখন বেশ ঊর্ধ্বমুখী।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, চলতি অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে পণ্য আমদানি বেড়েছে প্রায় সাড়ে ৫২ শতাংশ। একই সময়ে বিভিন্ন পণ্যের এলসি বেড়েছে প্রায় ৪৯ শতাংশ। ফলে আমদানিতে ডলারের চাহিদা বেশ বেড়েছে। কিন্তু ব্যাংকের কাছে ডলার আসার উৎস রেমিট্যান্স প্রবাহ কমছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম আট মাসে রেমিট্যান্স কমেছে প্রায় সাড়ে ১৯ শতাংশ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, গত বছরের ২ আগস্ট আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারে প্রতি ডলার ৮৪ টাকা ৮১ পয়সায় বিক্রি হয়, যা বাড়তে বাড়তে চলতি বছরের ৯ জানুয়ারি ৮৬ টাকা ওঠে। এর পর থেকে প্রায় আড়াই মাস ডলারের দাম এই জায়গাতেই আটকে রেখেছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তবে গতকাল ২০ পয়সা দাম বৃদ্ধি পেয়ে ৮৬ টাকা ২০ পয়সায় উঠেছে।
এদিকে আমদানিতে ডলারের চাহিদা বৃদ্ধির পর থেকে ব্যাংকগুলোর কাছে ডলার বিক্রি অব্যাহত রেখেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। চলতি অর্থবছরের ২২ মার্চ পর্যন্ত বিভিন্ন ব্যাংকের কাছে ডলার বিক্রি করা হয়েছে প্রায় ৩৬৫ কোটি ডলার।