দুই হাজার কোটি টাকা পাচারের মামলায় গ্রেপ্তার হয়েছেন সাবেক মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেনের ভাই খন্দকার মোহতেশাম হোসেন বাবর।
পাঠানো হয়েছে কারাগারে। তিনি ফরিদপুর জেলা আওয়ামী লীগের সহ সভাপতি এবং সদর উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান।
ফরিদপুরে এর আগে এই মামলায় ফরিদপুর শহর আওয়ামী লীগের দুই আলোচিত বহিষ্কৃত নেতা সাজ্জাদ হোসেন বরকত এবং ইমতিয়াজ হোসেন রুবেলও আসামি। তাদের আগেই গ্রেপ্তার করা হয়।
বাবর মামলা হওয়ার পর আত্মগোপনে ছিলেন। তাকে ঢাকার বসুন্ধরা এলাকা থেকে আটক করা হয়।
তার বড় ভাই ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশররফ হোসেন দুইবারের সাবেক মন্ত্রী। এখন মন্ত্রিত্ব না থাকলেও ফরিদপুর-৩ আসনে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য।
মানি লন্ডারিংয়ের এই মামলাটি হয়েছে ঢাকার কাফরুল থানায়। গত বছরের ৩ মার্চ চার্জশিট দেওয়া হয়।
এই মামলায় মোট ১০ জন আসামি। তাদের মধ্যে আট জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশ।
স্থানীয় লোকজন জানান, সাবেক মন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেনের প্রভাবেই বেপরোয়া হয়ে উঠেছিলেন তার ভাই বাবর।
আওয়ামী লীগের ত্যাগী নেতা-কর্মীদের মামলায় জড়িয়ে একচ্ছত্র আধিপত্য কায়েম করেছিলেন। আর সেই আধিপত্যে ঠিকাদারি, চাঁদাবাজি ও লেনদেন বাণিজ্যে শত শত কোটি টাকা আয় করেন।
স্থানীয় পর্যায়ে ব্যাপক নিয়োগ বাণিজ্যেরও অভিযোগ আছে। বিশেষ করে প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগের চূড়ান্ত পর্যায়ে লাখ লাখ টাকা হাতিয়েছেন তিনি এবং তার সহযোগীরা।
ফরিদপুর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মাসুদ হোসেন অভিযোগ করে বলেন, ‘দীর্ঘদিন মোশাররফ সাহেব আমাকে সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করতে দেননি। ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক দিয়ে চালিয়েছেন। তিনি তখন মন্ত্রী ছিলেন। কিন্তু নেত্রীর ইচ্ছায় এখন আমি দায়িত্ব পালন করতে পারছি।’
খন্দকার মোশররফের ভাই-ই কি এই দুর্নীতির একমাত্র ব্যক্তি? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘ফরিদপুরের মানুষ জানেন এখানে কার প্রভাবে কী হয়েছে। গোয়েন্দারাও জানেন। নেত্রীর নিকটাত্মীয় হওয়ার পরও এখন তারা রেহাই পাচ্ছেন না। এর আগে অনেকের ধারণা ছিলো খন্দকার বাবর গ্রেপ্তার হবেন না। কিন্তু শেষ পর্যন্ত হয়েছেন। হাতে হাতকড়াও দেওয়া হয়েছে। ওয়েট এন্ড সি এরপর কী হয়।’
ফরিদপুরের আলোচিত ও নির্যাতিত সাংবাদিক প্রবীর শিকদার ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশররফ হোসেনের মামলার শিকার হয়ে কারাগারেও গিয়েছেন। সেই মামলায় তিনি খালাস পেয়েছেন।
প্রবীর শিকদার বলেন, ‘রাজনীতিতে আসার শুরুতে না হলেও কিছু দিন পরই তার ভাইয়ের পৃষ্ঠপোষকতা শুরু করেন। খন্দকার বাবর একটা ফ্যাক্টর। কিন্তু খন্দকার মোশাররফ সাহেবের আশীর্বাদ ছাড়া তো ফরিদপুরে লুটপাট দুর্নীতি করা সম্ভব হয়নি।’
তিনি বলেন, ‘খন্দকার মোশাররফ সাহেব এখনো এমপি এবং সংসদীয় কমিটির সভাপতি। তিনি অনেক বাড়াবাড়ি করেছেন। তার চূড়ান্ত পরিণতি শুরু হয়েছে।’
প্রবীর শিকদার বলেন, ‘ফরিদপুর আওয়ামী লীগকে খন্দকার মোশাররফ ধ্বংস করে দিয়েছেন। যারা তার অপকর্মের বিরোধিতা করেছেন তাদের মামলা দিয়ে, হামলা করে পর্যুদস্ত করা হয়েছে। কোপানো হয়েছে। তাদের শেষ করে দেওয়া হয়েছে।’
তবে এই রকম অবস্থা দেশের অন্যান্য জেলায়ও আছে বলে তিনি মনে করেন।
তার কথায়, ‘ফরিদপুর হলো ঘরের মত। তাই হয়তো এখান থেকে দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযান শুরু হয়েছে। সংস্কার শুরু হয়েছে। আশা করি সারাদেশেই এটা হবে।’
ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেন এ বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘আমার ভাইয়ের যে অপরাধ তাতে আমার দায় আছে কী না তা কি আমি বলবো? আপনি কী প্রশ্ন করেন আপনি কী তা বোঝেন?’
তার ভাইকে গ্রেপ্তার ও মামলা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আপনার যা জানেন আমার ভাইয়ের ব্যাপারে আমি তার চেয়ে কমই জানি। আর সে যদি কোনো গর্হিত অপরাধ করেও থাকে তাহলে আপনি ফোন করলেই কি আমি বলে দেব যে, এই অপরাধ করেছে আর সেই কারণে সে অ্যারেস্ট হয়েছে। আমার ভাই কেন অ্যারেস্ট হলো এর জবাব আমি আপনাকে কী দেব? আপনারা খোঁজ নিয়ে জানান।’
এদিকে পুলিশের একাধিক সূত্র জানায়, মানি লন্ডারিং মামলায় আগে যারা গ্রেপ্তার হয়েছে তাদের কয়েকজন আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন। তাদের জবানবন্দিতে খন্দকার মোশাররফের ভাইয়ের নাম এসেছে।
ওই পুলিশ কর্মকর্তারা জানান, যাদের নামে চার্জশিট হয়েছে তাদেরই গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। মোশাররফের ভাইয়ের বিরুদ্ধে আদালতের গ্রেপ্তারি পরওয়ানা ছিলো।
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘যারা দুর্নীতি করেন তাদের একাংশ রাজনৈতিকভাবে ক্ষমতাবান। আমরা বলছি না সব রাজনৈতিক নেতারা এটা করেন। সৎ রাজনীতিবিদও আছেন। এখন ফরিদপুরের যে ঘটনা আমরা দেখছি সেটা রাজনৈতিক ক্ষমতারই দুর্নীতি।’
তার কথায়, ‘এটা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে আমি মনে করি না। এরকম ক্ষমতার অপব্যবহার আরও আছে। রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী ব্যক্তি ও পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে। সরকারের উচিত হবে সব বিষয়ে তদন্ত এবং নজরদারি বাড়ানো। এটা স্বচ্ছতার জন্যই করা দরকার।’
ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেন দুই টার্মে ১০ বছর মন্ত্রী ছিলেন। তিনি প্রবাসী কল্যাণ এবং স্থানীয় সরকার মন্ত্রী ছিলেন। তার ও তার পরিবারের সদস্যদের ক্ষমতার দাপট অনেক দিন থেকেই চলে আসছিলো।
আরও পড়ুন: সাবেক এলজিআরডি মন্ত্রীর ভাই গ্রেপ্তার হওয়ায় ফরিদপুরে মিষ্টি বিতরণ