নিজস্ব প্রতিবেদক প্রকাশের সময় :৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ ৮:১৪ : অপরাহ্ণ
২০ বছর ধরে ছদ্মবেশে ছিলেন তিনি। পরিবর্তন করে ফেলেন নিজের জাতীয় পরিচয়পত্র। বেছে নেন ট্রাকচালকের পেশা। আসল পরিচয় গোপন রেখে বিয়েও করেন। কিন্তু তার শেষ রক্ষা হয়নি।
চট্টগ্রামের লোহাগাড়ার আলোচিত ও চাঞ্চল্যকর ব্যবসায়ী জানে আলম হত্যা মামলার মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি জসিম উদ্দিনকে ধরা পড়তে হয়েছে র্যাবের হাতে।
গতকাল বৃহস্পতিবার রাতে চট্টগ্রাম নগরীর বন্দর থানার নিমতল এলাকা থেকে র্যাব-৭ এর একটি দল তাকে গ্রেপ্তার করে।
র্যাব সূত্র জানায়, ২০০২ সালে সংঘটিত লোহাগাড়ার ব্যবসায়ী জানে আলম হত্যা মামলার আসামি ছিলেন জসিম উদ্দিন। মামলায় অভিযুক্ত হওয়ার পর থেকেই এলাকা ছাড়েন তিনি।
ছদ্মবেশে পালিয়ে বেড়াতে থাকেন বিভিন্ন স্থানে। ডবলমুড়িং থানাধীন ফকিরহাট এলাকায় বাসা ভাড়া নিয়ে বসবাস শুরু করেন।
এ সময় ট্রাকের চালক হিসেবে পরিচয় দিতেন নিজেকে। এরপর কালুরঘাট এলাকায় বাসা ভাড়া নিয়ে বোয়ালখালীতে বিয়ে করেন এবং লোহাগাড়ায় নিজের পৈত্রিক ভিটা-বাড়ি ফেলে সেখানে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে শুরু করেন।
এরপর কালুরঘাট এলাকায় গাড়িচালক পেশায় তিন বছরের মতো অবস্থান করেন।
পরবর্তীতে চট্টগ্রাম নগরীর আগ্রাবাদ ডেবারপাড় বাসা নিয়ে গাড়িচালক পেশায় চার বছর বসবাস করেন।
এরপর আবার ফকির হাটে বাসা ভাড়া নিয়ে ৭ বছর গাড়িচালক পেশায় অবস্থান করেন।
সেখান থেকে বাসা পরিবর্তন করে বন্দর থানাধীন নিমতলায় বাসা ভাড়া নেন।
মূলত ২০ বছর ধরে তিনি ট্রাকচালকের পেশায় থেকে নিজেকে আত্মগোপন করে রেখেছিলেন।
ট্রাকচালকের লাইসেন্স ও অন্যান্য কাগজপত্র তৈরিতে তিনি ভুয়া জাতীয় পরিচয়পত্র ব্যবহার করেন এবং নিজের আত্মীয়স্বজন থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন অবস্থায় ছিলেন।
র্যাবের গোয়েন্দা ইউনিট গোপন সংবাদের ভিত্তিতে অভিযান চালিয়ে তাকে শনাক্ত ও গ্রেপ্তার করে।
র্যাবের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জসিম স্বীকার করেছেন-তিনি ব্যবসায়ী জানে আলম হত্যা মামলায় পলাতক মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি।
আসামি জসিম উদ্দিনের বরাত দিয়ে র্যাব জানায়, এই হত্যাকাণ্ডের মূল কারণ হলো ব্যবসায়ী জানে আলম তার ছোট ভাইয়ের হত্যাকাণ্ডে প্রত্যক্ষ সাক্ষী ছিলেন।
জানে আলম পরিবারের বড় ছেলে এবং আর্থিকভাবেও কিছুটা সচ্ছল ছিলেন।
তাই মামলা-মোকদ্দমার ব্যয়ভার তিনি বহন করতেন। এতে প্রতিপক্ষের আক্রোশ তার ওপর দিন দিন বেড়ে যায়।
প্রতিপক্ষের ধারণা ছিল, ব্যবসায়ী জানে আলমকে হত্যা করলে ওই পরিবারের মামলা-মোকদ্দমা চালানোর মতো কোনো লোক থাকবে না এবং প্রত্যক্ষভাবে আর কোনো সাক্ষীও থাকবে না।
আর্থিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়বে এবং তার সব সম্পত্তি সহজে তারা গ্রাস করতে পারবে। এ কারণে ঘাতক চক্র প্রকাশ্যে ব্যবসায়ী জানে আলমকে নৃশংসভাবে হত্যা করে।
র্যাব-৭ এর সিনিয়র সহকারী পরিচালক (মিডিয়া) নুরুল আবছার জানান, ছদ্মাবেশে ২০ বছর ধরে পলাতক থাকা মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি জসিম উদ্দিনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাকে লোহাগাড়া থানায় হস্তান্তর করা হয়েছে।
উল্লেখ্য, ২০০২ সালের ৩০ মার্চ আদালতে সাক্ষ্য দেওয়ার প্রাক্কালে আনুমানিক সকাল ৯টার দিকে পূর্বশত্রুতার জের ধরে স্থানীয় কিছু দুষ্কৃতকারী ব্যবসায়ী জানে আলমকে (৪৮) তার এক বছরের শিশুসন্তানের সামনে প্রথমে লাঠিসোঁটা, দেশীয় ধারালো অস্ত্র ও হাতুড়ি দিয়ে আঘাত করে এবং পরে মৃত্যু নিশ্চিত করার জন্য গুলি করে হত্যা করে।
যা সেই সময়ে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে। ওই ঘটনায় ভিকটিমের বড় ছেলে মো. তজবিরুল আলম বাদী হয়ে চট্টগ্রাম জেলার লোহাগাড়া থানায় ২১ জনকে আসামি করে একটি হত্যা মামলা করেন।
যার মধ্যে জসিম উদ্দিন ছিলেন অন্যতম প্রধান আসামি।
এ ঘটনার চার মাস আগে ২০০১ সালের ৯ নভেম্বর নিহত জানে আলমের আপন ছোট ভাইকে ওই দুর্বৃত্তরাই একইভাবে হত্যা করে।
ওই ঘটনায়ও চট্টগ্রাম জেলার লোহাগাড়া থানায় ১৩ জনকে আসামি করে একটি হত্যা মামলা করা হয়েছিল।
সেই মামলায়ও জসিম উদ্দিন অন্যতম প্রধান আসামি ছিলেন।
২০০৭ সালের ২৪ জুলাই ব্যবসায়ী জানে আলম হত্যা মামলার রায় ঘোষণা করেন আদালত।
রায়ে ১২ জনকে ফাঁসি এবং ৮ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
পরবর্তী সময়ে আসামিরা সুপ্রিম কোর্টে আপিল করলে আদালত জসিম উদ্দিনসহ ১০ জনকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত ও ২ জনকে যাবজ্জীবন এবং বাকিদের খালাস দেন।