রবিবার, ১৯ মে, ২০২৪ | ৫ জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩১ | ১০ জিলকদ, ১৪৪৫

মূলপাতা আইন-আদালত

মেজর সিনহাকে ‘ডাকাত’ সাজানোর চেষ্টা যেভাবে ভেস্তে যায়


রাজনীতি সংবাদ ডেস্ক প্রকাশের সময় :৩০ জানুয়ারি, ২০২২ ৬:৩৩ : অপরাহ্ণ
Rajnitisangbad Facebook Page

বাংলাদেশের পর্যটনশিল্পকে বিশ্বের মানুষের কাছে তুলে ধরতে নিজের ইউটিউব চ্যানেলের জন্য প্রামাণ্যচিত্র তৈরি করতে গিয়ে কক্সবাজারের টেকনাফে স্থানীয় পুলিশের রোষানলে পড়েন সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মো. রাশেদ খান।

টেকনাফ থানার ওসি প্রদীপ কুমার দাশ এবং তার পেটোয়া বাহিনীর নানা অপকর্ম জেনে ফেলায় তারা মেজর (অব.) সিনহাকে হত্যার ছক কষেন।

২০২০ সালের ৩১ জুলাই টেকনাফের মুইন্ন্যা পাহাড়ে ভিডিওচিত্র ধারণকালে সন্ধ্যারাতে পুলিশের সোর্সদের মাধ্যমে তাকে ডাকাত বলে অপপ্রচার চালিয়ে প্রথমে গণপিটুনি দিয়ে হত্যার চেষ্টা করা হয়।

কিন্তু স্থানীয় মসজিদের একজন ইমামের কারণে তাদের সে অপচেষ্টা সফল হয়নি।

২০২০ সালের ১৩ ডিসেম্বর কক্সবাজা‌রের ‌সি‌নিয়র জু‌ডি‌শিয়াল ম্যা‌জি‌স্ট্রেট তামান্না ফারাহর আদাল‌তে দাখিল করা অভিযোগপত্রে এভাবেই সিনহা মো. রাশেদ হত্যার পরিকল্পনা সম্পর্কে উল্লেখ করা হয়েছে।

অভিযোগপত্রের ১৩ পাতায় প্রথম অনুচ্ছেদে বলা হয়, ৩১ জুলাই বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে সিনহা মো. রাশেদ খান তাঁর সঙ্গী সাহেদুল ইসলাম সিফাতকে নিয়ে প্রতিদিনের কার্যক্রমের অংশ হিসেবে ভিডিও ধারণের জন্য টেকনাফ থানার মারিশ বুনিয়ার মুইন্ন্যা পাহাড়ের উদ্দেশে প্রাইভেটকারে করে রওনা দেন।

নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছে নতুন মেরিন ড্রাইভ রাস্তার পাশে গাড়িটি পার্ক করে তারা পাহাড়ের দিকে রওনা হন।

তার পরনে ছিল সেনাবাহিনীর পোশাকের মতো কমব্যাট প্যান্ট ও কমব্যাট গেঞ্জি; সঙ্গে ছিল ভিডিও ধারণের ক্যামেরা এবং প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি।

পাহাড়ে ওঠার সময় মারিশবুনিয়ার মাথাভাঙ্গা জামে মসজিদের ইমামের সঙ্গে সিনহা মো. রাশেদের সালাম বিনিময় হয়। পথে একটি ছোট ছেলের কাছ থেকে তারা পাহাড়ে উঠার পথও জেনে নেন।

এরপর তারা ছবি ও ভিডিওচিত্র ধারণ করার জন্য মুইন্ন্যা পাহাড়ে ওঠেন। অতঃপর পাহাড় ও সমুদ্রের চিত্র ধারণ করতে করতে সন্ধ্যা নেমে আসে।

এরই মধ্যে পুলিশের সোর্স মো. নুরুল আমিন, মো. নিজাম উদ্দিন ও মোহাম্মদ আইয়াজ লোক মারফত জানতে পারেন মুইন্ন্যা পাহাড়ে ভিডিও ধারণের জন্য দুজন লোক উঠেছে।

তারা আরও জানতে পারেন, তাদের মধ্যে একজন সেনাবাহিনীর মতো পোশাক পরিহিত এবং তাদের সঙ্গে ক্যামেরা রয়েছে।

এতে তারা নিশ্চিত হন, তারাই সে ভিডিও পার্টি, যাদের খুঁজে বের করার জন্য ওসি প্রদীপ ও লিয়াকত আলী তাদের নিয়োগ দিয়েছেন।

এরপর রাত ৮টার দিকে নুরুল আমিন, নিজাম উদ্দিন ও আইয়াজ মেজর সিনহা মো. রাশেদকে ওসি প্রদীপ ও লিয়াকত আলীর পরিকল্পনা ও নির্দেশনা অনুযায়ী ডাকাত সাব্যস্ত করে গণপিটুনি দেওয়ার উদ্যোগ নেন।

সেজন্য দক্ষিণ মারিশবুনিয়া জামে মসজিদের মাইকে তাঁরা ঘোষণা করেন, পাহাড়ে ডাকাত দেখা যাচ্ছে। তখন কিছু লোক জড়ো হয়।

কিন্তু পাহাড়ে কোনো সাড়াশব্দ না পাওয়ায় লোকজনের কাছে তারা ডাকাতির বিষয়টি প্রতিষ্ঠা করতে পারেননি। এর পরেও দমে যাননি নুরুল আমিন, নিজাম উদ্দিন ও আইয়াজ।

তারা মাথাভাঙ্গা মসজিদের ইমাম হাফেজ মো. জহিরুল ইসলামকে দিয়ে মাইকে অনুরূপ ঘোষণা দেওয়ানোর চেষ্টা করেন।

কিন্তু হাফেজ জহিরুল ইসলাম উপস্থিত লোকজনদের বলেন, উক্ত ব্যক্তি অর্থাৎ সিনহা মো. রাশেদ খান ডাকাত নয়, আর্মির লোক।

পাহাড়ে ওঠার আগে তার সঙ্গে মেজর সাহেবের দেখা হয়েছে এবং সালাম বিনিময় হয়েছে। এ কথা বলায় লোকজন চলে যায়।

এর কিছুক্ষণ পর সিনহা মো. রাশেদ ও সিফাত পাহাড় থেকে আইয়াজ, নুরুল আমিন ও নিজাম উদ্দিনের সামনে দিয়ে নেমে আসেন।

সে সময় নুরুল আমিন, নিজাম উদ্দিন ও আইয়াজ তাদের হাতে থাকা টর্চ লাইটের আলো ফেলে নিশ্চিত হন, এরাই সে ভিডিও দল।

গণপিটুনির শিকার হওয়া থেকে বেঁচে পাহাড় থেকে নেমে আসেন মেজর (অব.) সিনহা মো. রাশেদ খান এবং তার সঙ্গী সিফাত।

তবে শেষ পর্যন্ত প্রাণে বাঁচতে পারেননি সিনহা মো. রাশেদ। ওই স্থান থেকে ফেরার পথে ওসি প্রদীপের তৈরি করা ছক অনুযায়ী, বাহারছড়া পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা পরিদর্শক মো. লিয়াকত আলীর (৩১) গুলিতে নিহত হন সিনহা মো. রাশেদ খান।

হত্যাকাণ্ডের চার দিন পর ৫ আগস্ট সিনহার বড় বোন শারমিন শাহরিয়া ফেরদৌস বাদী হয়ে কক্সবাজার জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিমের আদালতে নয় জনকে আসামি করে হত্যা মামলা করেন।

মামলায় প্রধান আসামি করা হয় বাহারছড়া পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের পরিদর্শক মো. লিয়াকত আলীকে (৩১)।

ওসি প্রদীপ কুমার দাশকে (৪৮) দুই নম্বর এবং বাহারছড়া তদন্ত কেন্দ্রের উপপরিদর্শক (এসআই) নন্দ দুলাল রক্ষিতকে (৩০) তিন নম্বর আসামি করা হয়।

বাকি ছয় আসামি হলেন উপপরিদর্শক (এসআই) টুটুল, সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) মো. লিটন মিয়া (৩০), কনস্টেবল ছাফানুর করিম (২৫), মো. কামাল হোসাইন আজাদ (২৭), মো. আব্দুল্লাহ আল মামুন ও মো. মোস্তফা। আদালত মামলাটির তদন্তের দায়িত্ব দেন কক্সবাজারের র‍্যাব-১৫ কে।

৭ আগস্ট মামলার সাত আসামি আদালতে আত্মসমর্পণ করেন।

তারা হলেন-লিয়াকত আলী, প্রদীপ কুমার দাশ, নন্দ দুলাল রক্ষিত, মো. লিটন মিয়া, ছাফানুর করিম, মো. কামাল হোসাইন ও মো. আব্দুল্লাহ আল মামুন।

তবে এসআই টুটুল ও কনস্টেবল মোস্তফা আত্মসমর্পণ করেননি।

র‍্যাব তদন্তে নেমে হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে আরও আট জনের সংশ্লিষ্টতা পায়।

তারা হলেন-ওসি প্রদীপের দেহরক্ষী রুবেল শর্মা (৩০), বরখাস্ত কনস্টেবল সাগর দেব, বরখাস্ত এপিবিএনের এসআই মো. শাহজাহান আলী (৪৭), বরখাস্ত কনস্টেবল মো. রাজীব হোসেন (২৩) ও আবদুল্লাহ আল মাহমুদ (২০), স্থানীয় বাসিন্দা টেকনাফের বাহারছড়া ইউনিয়নের শামলাপুরের মারিশবুনিয়া গ্রামের মো. নুরুল আমিন (২২), মো. নিজাম উদ্দিন (৪৫) ও মোহাম্মদ আইয়াজ (৪৫)।

তাদের মধ্যে সাগর দেব বাদে সবাইকে গ্রেপ্তার করা হয়।

হত্যাকাণ্ডের পর চার মাসেরও বেশি সময় ধরে তদন্তের পর ২০২০ সালের ১৩ ডিসেম্বর র‍্যাব ১৫-এর সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার মোহাম্মদ খায়রুল ইসলাম ১৫ জনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন।

অভিযোগপত্রে এজাহারভুক্ত নয় আসামির মধ্য থেকে এসআই টুটুল ও কনস্টেবল মো. মোস্তফাকে বাদ দেওয়া হয়।

অভিযুক্ত বাকি পলাতক আসামি কনস্টেবল সাগর দেব ২০২১ সালের ২৪ জুন আদালতে আত্মসমর্পণ করেন।

এর মাধ্যমে অভিযুক্ত ১৫ আসামি গ্রেপ্তার ও আত্মসমর্পণের মাধ্যমে আইনের আওতায় আসেন।

অভিযোগপত্রে সিনহা হত্যাকাণ্ডকে একটি ‘পরিকল্পিত ঘটনা’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। এ মামলায় মোট ৮৩ জনকে সাক্ষী করা হয়।

২০২১ সালের ৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত ৬৫ জন ব্যক্তি আদালতে সাক্ষ্য দেন। সাক্ষ্যগ্রহণ ও জেরা শেষ হওয়ার পর ফৌজদারি কার্যবিধির ৩৪২ ধারায় আত্মপক্ষ সমর্থনে আসামিদের বক্তব্য গ্রহণ করা হয়।

এরপর চলতি বছরের ৯ জানুয়ারি থেকে ১২ জানুয়ারি পর্যন্ত যুক্তিতর্ক উপস্থাপন অনুষ্ঠিত হয়।

প্রায় এক বছরের শুনানি, সাক্ষ্য-প্রমাণ ও যুক্তিতর্ক শেষে আগামীকাল সোমবার (৩১ জানুয়ারি) আলোচিত এ হত্যা মামলার রায় ঘোষণার দিন ধার্য করেছেন কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ মোহাম্মদ ইসমাঈল।

মামলাটি তদন্ত করেছেন কক্সবাজার র‍্যাব-১৫-এর দুই কর্মকর্তা সহকারী পুলিশ সুপার মো. জামিলুল হক ও সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার মো. খাইরুল ইসলাম।

মামলার শুনানিতে আসামিদের পক্ষে প্রধান কৌঁসুলি ছিলেন অ্যাডভোকেট রানা দাশ গুপ্ত, আর রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন অ্যাডভোকেট ফরিদুল আলম।

মন্তব্য করুন
Rajnitisangbad Youtube


আরও খবর