শনিবার, ২৩ নভেম্বর, ২০২৪ | ৮ অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ | ২০ জমাদিউল আউয়াল, ১৪৪৬

মূলপাতা দেশজুড়ে

সেন্টমার্টিনে সমুদ্রের পানিতে ভয়ংকর ‘ই-কোলাই’ ব্যাকটেরিয়া, স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পর্যটকরা



রাজনীতি সংবাদ ডেস্ক প্রকাশের সময় :২৩ ডিসেম্বর, ২০২১ ৬:৩১ : অপরাহ্ণ

সেন্টমার্টিন দ্বীপ। দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্র। একমাত্র প্রবাল সমৃদ্ধ এই দ্বীপে প্রতিদিন ঘুরতে আসেন অন্তত ৮ হাজার পর্যটক।

দেশ-বিদেশের নানান প্রান্ত থেকে ঘুরতে আসা পর্যটকরা দ্বীপে পৌঁছেই ঝাঁপিয়ে পড়েন সৈকতে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাপিয়ে বেড়ান সৈকতের নীল জলরাশিতে।

কিন্তু কারও জানা নেই সমুদ্রের নীল জলরাশিতে তার জন্য অপেক্ষা করছে ভয়ংকর ‘ই-কোলাই’ ব্যাকটেরিয়া, যা একজন মানুষকে নিয়ে যেতে পারে মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে।

সম্প্রতি বাংলাদেশ ওশানোগ্রাফিক রিসার্চ ইনস্টিটিউটের এক গবেষণায় উঠে এসেছে, সেন্টমার্টিনে সমুদ্রের পানিতে ‘ই-কোলাই’ ব্যাকটেরিয়ার ভয়াবহ পরিমাণ উপস্থিতি রয়েছে।

‘ই-কোলাই’ ব্যাকটেরিয়া মানুষের মলমূত্র থেকে জন্ম নেয়।

সমুদ্র বিজ্ঞানীরা জানান, আমেরিকান পাবলিক হেলথ অ্যাসোসিয়েশনের ম্যামব্রেইন ফিলটেশন ম্যাথড অনুসরণ করে এই গবেষণা করেছেন তারা।

এতে সেন্টমার্টিনের চারপাশের সমুদ্র সৈকত সংলগ্ন এলাকা এবং সৈকত থেকে ১ কিলোমিটার গভীর সমুদ্র এলাকার পানি সংগ্রহ করে গবেষণা করা হয়।

পানিতে ফিকাল কলিফর্মের উপস্থিতি পাওয়া গেলে সেই পানি ‘ই-কোলাই’ ব্যাকটেরিয়া আক্রান্ত বলে ধরা হয়।

আরও পড়ুন: কক্সবাজারে স্বামী-সন্তানকে জিম্মি করে পর্যটক নারীকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণ

মালয়েশিয়ান পরিবেশ অধিদপ্তরের মানমাত্রা অনুযায়ী, বিনোদনমূলক সৈকতের ১০০ মিলিলিটার পানিতে ১ থেকে ১০ কলনি ফরমিং ইউনিট (সিএফইউ) ফিকাল কলিফমের উপস্থিতি পাওয়া গেলে সেই পানি ‘ই-কোলাই’ ব্যাকটেরিয়ায় দূষিত ধরা হয়।

সেখানে সেন্টমার্টিনের সৈকতের পানিতে প্রতি ১০০ মিলিলিটারে ১ থেকে ২৭২ সিএফইউ ফিকাল কলিফর্ম অর্থাৎ ‘ই-কোলাই’ ব্যাকটেরিয়া পেয়েছেন গবেষকরা।

সৈকত থেকে ১ কিলোমিটার দূরের পানিতে এই পরিমাণ আরও বেশি ছিলো।

সেখানকার প্রতি ১০০ মিলিলিটার পানিতে সর্বনিম্ন ৩২ থেকে সর্বোচ্চ ২৮০ সিএফইউ ফিকাল কলিফর্ম পাওয়া গেছে।

অন্যদিকে বাংলাদেশ পরিবেশ অধিদপ্তরের মানমাত্রায় ১০০ মিলিলিটার পানিতে ২০০ কলনি ফরমিং ইউনিট (সিএফইউ) টোটাল কলিফর্ম পাওয়া গেলে সেই পানিকে বিভিন্ন ব্যাকটেরিয়া দূষিত ধরা হয়।

মালেয়েশিয়ান পরিবেশ অধিদপ্তর একই পরিমাণ পানিতে ১০ থেকে ১০০ সিএফইউ হলে দূষিত বলে চিহ্নিত করে। সমুদ্র সৈকতের পানির ক্ষেত্রে ১০০ এর উপরে হলে দূষিত বলে চিহ্নিত করেন তারা।

সেখানে সেন্টমার্টিনের সৈকতের প্রতি ১০০ মিলিলিটার পানিতে টোটাল কলিফর্মের উপস্থিতি মিলেছে সর্বনিম্ন ১৫ থেকে ৬৫৭ সিএফইউ পর্যন্ত।

সৈকত থেকে ১ কিলোমিটার দূরে এর পরিমাণ ছিলো সর্বনিম্ন ২৬ থেকে ১৮১০ সিএফইউ পর্যন্ত।

বছরব্যাপী এই গবেষণায় পর্যটন মৌসুমে অন্য সময়ের তুলনায় ৬৩ শতাংশ বেশি দূষণ মিলেছে।

আরও পড়ুন: কক্সবাজারে ‘উড়ন্ত রেস্টুরেন্ট’, বসলেই বিল ৪ হাজার টাকা!

সেন্টমার্টিনের চারপাশের সৈকতের মধ্যে জেটি এবং সৈকতের উত্তর ও পশ্চিম মাথায় ফিকাল ও টোটাল কলিফর্মের উপস্থিতি সবচেয়ে বেশি মিলেছে।

সবচেয়ে কম মিলেছে গলাচিপা এলাকায়।

সৈকত থেকে ১ কিলোমিটার দূরের ক্ষেত্রে পশ্চিম সৈকত এলাকায় কলিফর্মের উপস্থিতি সবচেয়ে বেশি ছিলো।

অন্যদিকে দ্বীপের একমাত্র মিঠাপানির উৎসে টোটাল কলিফর্মের উপস্থিতি ৬৫৭ সিএফইউ পেলেও ফিকাল কলিফর্ম পাওয়া যায়নি বলে তুলে ধরা হয় গবেষণাটিতে।

গবেষণাটিতে নেতৃত্ব দিয়েছেন বাংলাদেশ ওশানোগ্রাফিক রিসার্চ ইনস্টিটিউটের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মীর কাশেম।

তিনি গণমাধ্যমকে বলেন, করোনার লকডাউনের পর সেন্টমার্টিনে যে হারে পর্যটকের আগমন ঘটে তা দেখে এতো মানুষের মলমূত্র কোথায় যাচ্ছে তা যাচাই করার কথা আমাদের মাথায় আসে। যেহেতু সেখানকার নির্দিষ্ট কোনো স্যুয়ারেজ নেই তাই আমরা ধারণা করি, সমুদ্রে বা মিঠাপানির রিজার্ভারে মলমূত্রগুলো ছাড়া হতে পারে। তাই আমরা পর্যটন মৌসুম এবং বন্ধের সময় আলাদাভাবে মিঠাপানির রিজার্ভার, সৈকত এবং ১ কিলোমিটার দূরের সমুদ্রের পানি সংগ্রহ করি। সেই পানি নিয়ে গবেষণা করে ভয়াবহ অবস্থা দেখতে পাই। ফল যা পেয়েছি সেটা স্বাভাবিকের ধারেকাছেও নেই।

মীর কাশেম বলেন, আমরা জেটি এলাকা এবং উত্তর ও পশ্চিম বিচ এলাকায় কলিফর্মের উপস্থিতি বেশি পেয়েছি। নিঃসন্দেহে বলা যায়, জাহাজগুলো জেটিতে এসে তাদের স্যুয়ারেজের মলমূত্র সাগরে ছেড়ে দেয়। যার কারণে এখানে কলিফর্ম বেশি।

তিনি প্রশ্ন রাখেন, রিসোর্টগুলোর কথা আপনি চিন্তা করেন। এতো ট্যুরিস্ট আসে, মলমূত্র ত্যাগ করে। এদের কারও কী ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট আছে? একটারও নেই। সবাই হিডেন পাইপ দিয়ে সমুদ্রে মলমূত্র ছেড়ে দিচ্ছে। পাইপগুলো তারা এক কিলোমিটার পর্যন্ত পাঠিয়েছে। একারণে সেখানে বেশি দূষিত।

আরও পড়ুন: পরিচয় জানা গেলো সেই আইসক্রিমওয়ালার, যার ভক্ত দেড় মিলিয়ন (ভিডিও)

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক (ইন্টারর্নাল মেডিসিন) ক্লিনিক্যাল টক্সিকোলজিস্ট ডা. ফজলে রাব্বী চৌধুরী বলেন, যেহেতু ই-কোলাই ব্যাকটেরিয়া অতিরিক্ত উপস্থিতি দেখা যাচ্ছে, তাহলে নিসন্দেহে বলা যায়, যত্রতত্র মূলমূত্র ছেড়ে দেওয়া রয়েছে। এটাকে খুব হালকাভাবে নেওয়ার কিছু নেই। বিভিন্ন দেশে ই-কোলাই বড় বিপর্যয় ডেকে আনার এবং গণমৃত্যুর ঘটনার দৃষ্টান্ত রয়েছে।

তিনি বলেন, যেহেতু সেন্টমার্টিনে ই-কোলাই মিলেছে এটি সবচেয়ে বেশি ক্ষতির কারণ হবে স্থানীয়দের জন্য। কোনো না কোনোভাবে তারা আক্রান্ত হবেই। ট্যুরিস্টদেরও বাঁচার উপায় নেই। কারণ সেখানে যারা খাবার রান্না করে বা পরিবেশন করেন তাদের মাধ্যমে ই-কোলাই ছড়াতে পারে।

ডা. ফজলে রাব্বী চৌধুরী জানান, ই-কোলাই পরিপাকতন্ত্রে দূষণ করতে পারে। প্রচুর লোকের ট্রাভেলার্স ডায়েরিয়া হতে পারে। হঠাৎ করে অনেকের জ্বরে চলে এসে ডায়রিয়া শুরু হবে, বমি হবে। ট্রাভেলার্স ডায়েরিয়া স্থানীয় ছোট আকারে মহামারির আকার নিতে পারে। দেখা যেতে পারে, একসঙ্গে দুই-তিনশ পর্যটক আক্রান্ত হয়েছেন। তখন সেখানকার চিকিৎসা ব্যবস্থা কোনোভাবেই কন্ট্রোল করতে পারবে না। অনেক ক্ষেত্রে ডিহাইড্রেশনে অনেকের মৃত্যু হতে পারে। অনেক দেশে এধরনের ঘটনার নজির আছে।

এই সমস্যার সমাধান জানতে চাইলে বাংলাদেশ ওশানোগ্রাফিক রিসার্চ ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক সমুদ্র বিজ্ঞানী সাঈদ মাহমুদ বেলাল হায়দর বলেন, সেন্টমার্টিনের ভূ-গঠন এমন যে, দ্বীপটির যেখানেই বর্জ্য ফেলেন না কেন তা সমুদ্রেই যাবে। সেটা প্লাস্টিক বর্জ্য হোক বা মানুষের মলমূত্র হোক। এখন প্রথম সমাধান হবে সমুদ্র থেকে হোটেলগুলোর স্যুয়ারেজ লাইন সরিয়ে নেওয়া। এক্ষেত্রে বর্জ্য দিয়ে বায়োগ্যাস প্ল্যান্ট করা যেতে পারে। এছাড়া বর্জ্যগুলোর জন্য আর কোনো বিকল্প মাধ্যম দেখছি না।

আপাতত পানির মানের উন্নতি না হওয়া পর্যন্ত সেন্টমার্টিনের সমুদ্রে গোসল না করা এবং দ্রুত পর্যটকের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ নেওয়ারও পরামর্শ দেন এই সমুদ্রবিজ্ঞানী।

আরও পড়ুন: মাত্র ৬০ টাকায় কোটিপতি ভ্যানচালক ফজলে মিয়া

মন্তব্য করুন
Rajniti Sangbad


আরও খবর