রবিবার, ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ | ১৪ আশ্বিন, ১৪৩১ | ২৫ রবিউল আউয়াল, ১৪৪৬

মূলপাতা আইন-আদালত

আদালতে বাদী শারমিন

‘লিয়াকত ফোনে বলেছে টার্গেট ফেলে দিয়েছি, তোরা তাড়াতাড়ি আয়’


প্রতিনিধি, কক্সবাজার প্রকাশের সময় :২৩ আগস্ট, ২০২১ ১১:৩০ : অপরাহ্ণ
Rajnitisangbad Facebook Page

সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান হত্যা মামলার বিচার শুরু হয়েছে। আজ সোমবার দুপুরে কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালতে আলোচিত হত্যা মামলাটির বাদীর সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়।

দায়রা জজ মোহাম্মদ ইসমাইলের আদালতে প্রথম দিনে সাক্ষ্য দেন সিনহার বড় বোন ও মামলার বাদী শারমিন শাহরিয়ার ফেরদৌস।

আদালত সূত্রে জানা যায়, শারমিন শাহরিয়ার ফেরদৌস আদালতকে বলেন, লিয়াকত ফোনে বলেছে, ‘টার্গেট ফেলে দিয়েছি, তোরা তাড়াতাড়ি আয়।’ আরেক ফোনে বলেন, ‘স্যার একটাকে ডাউন করেছি, আরেকটারে ধরে ফেলেছি।’ সিনহা পানি ও শ্বাস নিতে চাইলে লিয়াকত গালাগাল করে কোমরে লাথি মেরে ফেলে দেয় ও মাথা চেপে ধরে। এরপর পুলিশ আসলে লিয়াকত নির্দেশ দেয় আশপাশের মানুষকে ভয় দেখাতে, যাতে কেউ সিনহাকে সাহায্য করতে না পারে, ছবি বা ভিডিও করতে না পারে।

তিনি সাক্ষ্যে আরও বলেন, কিছুক্ষণ পর প্রদীপ আসে, কাকে যেন ফোন করে, লিয়াকতের সাথে কথা বলেন, সিনহার দিকে এগিয়ে যান, তার বাম পাঁজরে সজোরে লাথি মারেন। এরপর তিনি জুতা দিয়ে বাম গলা চাপ দেন, তখন সিনহা নাড়াচাড়া করেন ও কাঁপতে থাকেন। একপর্যায়ে তার মৃত্যু নিশ্চিত করে প্রদীপ গলা থেকে পা সরিয়ে নেন।

এরপর রুবেল সাগরকে বলেন, গাড়ি থেকে ইয়াবা, গাঁজা নিয়ে আসতে হবে। রাত ১২টার দিকে হাসপাতালে নেয়া হলে ডাক্তার সিনহাকে মৃত ঘোষণা করেন। পরবর্তীতে আসামিরা তাদের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের যোগসাজশে দুটি মিথ্যা মামলা দায়ের করে ঘটনাকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা করেন। লিয়াকত, প্রদীপের প্ররোচনায় ও ফোনে নির্দেশিত হয়ে সিনহাকে গুলি করেন, পরে প্রদীপ ঘটনাস্থলে গিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত ও তরান্বিত করেন।

শারমিন শাহরিয়ার হত্যাকাণ্ডটি পূর্বপরিকল্পিত দাবি করে অভিযুক্ত ১৫ আসামির সর্বোচ্চ শাস্তির দাবি করেন।

শারমিন শাহরিয়ারের সাক্ষ্য গ্রহণের পর শুরু হয় জেরা। আসামিপক্ষের আইনজীবীরা জেরায় সিনহা স্বেচ্ছায় না বাধ্যতামূলক অবসরে গিয়েছেন, ইউটিউব চ্যানেলের বিষয়সহ বিভিন্ন প্রশ্ন করেন তাকে।

জেরার সময় আইনজীবীদের প্রশ্নের যৌক্তিকতা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন আদালত, সতর্কভাবে প্রশ্ন করার আহবান জানান। বাহাদুরি দেখানোর জন্য যেনতেন প্রশ্ন না করার অনুরোধ জানান। এ নিয়ে বাকবিতণ্ডা হয় দুই পক্ষের আইনজীবীদের মধ্যে।

বাদীর সাক্ষ্য গ্রহণের সময় আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে ছিলেন ওসি প্রদীপ, পরিদর্শক লিয়াকত আলীসহ মামলার ১৫ জন আসামি।

আসামি প্রদীপ কুমার ও লিয়াকত আলীর আইনজীবী রানা দাশ গুপ্ত সাক্ষ্য গ্রহণ শেষে সাংবাদিকদের বলেন, এ মামলায় অভিযোগ গঠন হলেও আমরা এখনও এর নকল কপি পাইনি। অভিযোগে কী বলা হয়েছে, তা না জেনে সাক্ষীদের জেরা করা সঠিক হবে না বলে আদালতকে জানিয়েছি। আদালত মঙ্গলবার সাক্ষীদের জেরা করার পরামর্শ দিয়েছেন।

বাদীপক্ষের আইনজীবী মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর দাবি করেন, মামলার স্বাভাবিক বিচারিক কার্যক্রমে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করার চেষ্টা করছে আসামি পক্ষ। তিনি বলেন, আজও আসামি পক্ষ ১১টি দরখাস্ত দিয়েছে। সবগুলোর সারবস্তু হলো মূল আসামির মামলা স্থগিত করা।

সাক্ষ্য গ্রহণ শেষে পিপি ফরিদুল আলম বলেন, সোমবার মামলার বাদী শারমিন শাহরিয়া ফেরদৌসসহ পাঁচজনের সাক্ষ্য গ্রহণের সময় নির্ধারিত ছিল। কিন্তু সাক্ষ্য দিয়েছেন কেবল মামলার বাদী। ২৪ ও ২৫ আগস্ট আরও দুই দিন সাক্ষ্য গ্রহণ চলবে। এ সময় আরও ১৪ জন সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণের কথা রয়েছে।

উল্লেখ্য, ২০২০ সালের ৩১ জুলাই রাতে কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ সড়কের শামলাপুর চেকপোস্টে পুলিশের গুলিতে নিহত হন মেজর (অব.) সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান। তার সঙ্গে থাকা সাহেদুল ইসলামকে (সিফাত) পুলিশ আটক করে। এরপর সিনহা যেখানে ছিলেন সেই নীলিমা রিসোর্টে ঢুকে তার অপর দুই সফর সঙ্গী শিপ্রা দেবনাথ ও তাহসিন রিফাত নুরকে আটক করে। পরে তাহসিনকে ছেড়ে দিলেও শিপ্রা ও সিফাতকে গ্রেফতার দেখিয়ে কারাগারে পাঠায় পুলিশ। এই দুজন পরে জামিনে মুক্তি পান।

সিনহা হত্যার ঘটনায় মোট চারটি মামলা হয়েছে। ঘটনার পরপরই পুলিশ বাদী হয়ে তিনটি মামলা করে। এর মধ্যে দুটি মামলা হয় টেকনাফ থানায়, একটি রামু থানায়। ঘটনার পাঁচ দিন পর অর্থাৎ ৫ আগস্ট কক্সবাজার আদালতে টেকনাফ থানার বরখাস্ত হওয়া ওসি প্রদীপ কুমার দাশ, বাহারছড়া তদন্ত কেন্দ্রের পরিদর্শক লিয়াকত আলীসহ ৯ পুলিশের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করেন সিনহার বড় বোন শারমিন শাহরিয়া ফেরদৌস। চারটি মামলা তদন্তের দায়িত্ব পায় র‍্যাব।

২০২০ সালের ১৩ ডিসেম্বর ওসি প্রদীপ কুমার দাশসহ ১৫ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে অভিযোগপত্র দেন তদন্তকারী কর্মকর্তা ও র‍্যাব-১৫ কক্সবাজারের সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার মো. খাইরুল ইসলাম।

আসামিদের মধ্যে পুলিশের ৯ সদস্য রয়েছেন। তারা হলেন, বরখাস্ত হওয়া ওসি প্রদীপ কুমার দাশ, পরিদর্শক লিয়াকত আলী, এসআই নন্দদুলাল রক্ষিত, এএসআই লিটন মিয়া, কনস্টেবল সাফানুল করিম, রুবেল শর্মা, কামাল হোসেন, আব্দুল্লাহ আল মামুন ও সাগর দেব নাথ।

অপর আসামিরা হলেন- আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) সদস্য যথাক্রমে এসআই মো. শাহজাহান, কনস্টেবল মো. রাজিব ও মো. আব্দুল্লাহ এবং টেকনাফের বাহারছড়ার মারিষবুনিয়া গ্রামের বাসিন্দা ও পুলিশের করা মামলার সাক্ষী নুরুল আমিন, মো. নিজাম উদ্দিন ও আয়াজ উদ্দিন।

গ্রেফতারদের মধ্যে ১২ জন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। তবে ওসি প্রদীপ ও কনস্টেবল রুবেল শর্মা আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেননি। এর আগে আসামিদের তিন দফায় ১২ থেকে ১৫ দিন রিমান্ডে নেওয়া হয়েছিল।

মন্তব্য করুন
Rajnitisangbad Youtube


আরও খবর