শহরজুড়ে লকডাউন। রাস্তায় নেই কোনো যানবাহন। লকডাউনে বাড়ি থেকে বেরোতে না পেরে সবচেয়ে বেশি সমস্যায় পড়ছেন রোগীরা। বিশেষ করে প্রসব বেদনা ওঠা অন্তঃসত্ত্বা নারীরা গাড়ি না পেয়ে চরম বিপাকে পড়ছেন। আবার অনেক রোগী গাড়ি না পেয়ে হাসপাতাল থেকেও বাড়িতে যেতে পারছেন না। লকডাউনের কারণে গাড়িশূন্য হয়ে পড়ার এই সময়ে অসহায় রোগীদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন ফসিউল আলম রিয়াদ। ২২টি সিএনজি অটোরিকশা ভাড়া করে ২৪ ঘণ্টা তিনি রোগীদের বিনামূল্যে সার্ভিস দিচ্ছেন।
এমন সময় দেশের বহু বিত্তবান হাত গুটিয়ে বসে থাকলেও যুবলীগ নেতা হিসেবে পরিচিত রিয়াদ গত ২৮ জুন থেকে চট্টগ্রাম নগরীতে রোগীদের জন্য অটোরিকশা সার্ভিস শুরু করেন। গত ৬ দিন ধরে শতাধিক অসুস্থ রোগীকে বাড়ি থেকে হাসপাতালে কিংবা হাসপাতাল থেকে বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে তিনি হয়ে উঠেছেন চট্টগ্রাম শহরের মানবিক মুখ।
গত ১ জুলাই নগরীর আন্দরকিল্লা জেনারেল হাসপাতালের সামনে এই অটোরিকশা সার্ভিসের উদ্বোধন করেন জেলা সিভিল সার্জন ডা. সেখ ফজলে রাব্বি।
নগরীর হালিশহর ছোটপুল এলাকার বাসিন্দা ৪০ বছর বয়সী ফসিউল আলম রিয়াদ জানান, দিনে ১০টি ও রাতে ১২টি অটোরিকশা রোগীদের পরিবহন করেন। দৈনিক একটি অটোরিকশার পেছনে গাড়ি ভাড়া, চালকের বেতন ও গ্যাস বাবদ তার দেড় হাজার টাকা খরচ হয়। সে হিসেবে ২২টি অটোরিকশার পেছনে দৈনিক তার খরচ হয় ৩৩ হাজার টাকা। তবে এর আগে গত বছর প্রথম লকডাউনের সময়ও তিনি রোগীদের জন্য অটোরিকশা সার্ভিস দিয়েছেন।
অসহায় রোগীদের অটোরিকশা সার্ভিস দেওয়ার চিন্তাটা কীভাবে মাথায় এলো? জানতে চাইলে ফসিউল আলম রিয়াদ রাজনীতি সংবাদকে বলেন, ‘আমি দীর্ঘ দিন ধরে রাজনীতি করছি। রাজনীতির উদ্দেশ্যই হলো জনসেবা। তাছাড়া আমার বাবা শামসুল আলম ছিলেন একজন মুক্তিযোদ্ধা। আমি চিন্তা করলাম, দেশে তো আর কখনো মুক্তিযুদ্ধ হবে না। কিন্তু আমি তো করোনাযোদ্ধা হতে পারি। গত বছর করোনায় লকডাউনে আমি সমাজের অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছিলাম। রাতের অন্ধকারে মানুষের বাসায় খাদ্য সামগ্রী পোঁছে দিয়েছি। বিপদগ্রস্ত অসহায় মানুষের জন্য সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়ে তখন আমার মধ্যে মানবিক অনুভূতি জাগ্রত হয়। গত বছর প্রথম লকডাউন শুরু হলে আমি চিন্তা করে দেখলাম, লকডাউনে রাস্তায় গাড়ি না থাকলে সবচেয়ে বেশি কষ্ট হবে রোগীদের। তখন আমি রোগীদের জন্য অটোরিকশা সার্ভিস শুরু করি। তখন ১০টি অটোরিকশার মাধ্যমে সার্ভিস দিয়েছি।’
রিয়াদ জানান, অন্তঃসত্ত্বা নারীদের বেশি প্রয়োজন হয়েছে অটোরিকশা সার্ভিসের। তিনি বলেন, ‘গভীর রাতেও অনেকে ফোন করেছেন। সাথে সাথে আমি নির্দিষ্ট স্থানে গাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছি। লকডাউনের কারণে হঠাৎ প্রসব বেদনা ওঠা অন্তঃসত্ত্বা নারীরা গাড়ি না পেয়ে চরম বিপাকে পড়ে যান।’
রিয়াদের অটোরিকশার সার্ভিস নেওয়া নগরীর বিশ্বকলোনীর বাসিন্দা হালিমা খাতুন রাজনীতি সংবাদকে বলেন, ‘গত ২৯ জুন রাতে মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছিল। রাত সাড়ে ১১টার দিকে আমি বড়পুল এলাকায় এক ডাক্তারের চেম্বারে আটকা পড়ি। এ সময় আমার এক আত্মীয়ের সাথে যোগাযোগ করলে রিয়াদের অটোরিকশা সার্ভিসের সন্ধান পাই। ফোন করার ১৫-২০ মিনিটের মধ্যে গাড়ি চলে আসে। বৃষ্টির মধ্যে এতো রাতে এমন সহযোগিতা পাবো কল্পনাও করিনি। গাড়ির চালককে অনেক চেষ্টা করলাম বকশিস দিতে কিন্তু নেয়নি।’
এই অটোরিকশা সার্ভিসের টাকার উৎস কী? জানতে চাইলে রিয়াদ বলেন, ‘আমি গণপূর্ত অধিদপ্তরের তালিকাভুক্ত ঠিকাদার। এছাড়া এলপি গ্যাস সিলিন্ডারের ডিস্ট্রিবিউটর। এই দুটো উৎস থেকে আমি সৎভাবে উপার্জন করে যতটুকু সামর্থ আছে তার মধ্যে এই সার্ভিস দিচ্ছি।’
যতোদিন সামর্থ আছে ততোদিন লকডাউনে রোগীদের এই সার্ভিস দিবেন বলে জানিয়েছেন রিয়াদ।
রিয়াদের এই মানবিক উদ্যোগ প্রসঙ্গে সিভিল সার্জন ডা. সেখ ফজলে রাব্বি রাজনীতি সংবাদকে বলেন, ‘এটি একটি মহৎ উদ্যোগ। লকডাউনের সময় অনেক অসুস্থ রোগী বাসা থেকে হাসপাতালে আসতে কিংবা হাসপাতাল থেকে বাসায় যেতে যানবাহন পায় না। ইতোমধ্যে অনেক রোগী রিয়াদের অটোরিকশা সার্ভিস নিয়েছেন। অনেকে আমার মাধ্যমে তাকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন। এই সার্ভিস নিয়ে এ পর্যন্ত কোনো রোগীর অভিযোগ পায়নি। লকডাউনের সময়ে সমাজের বিত্তবান ব্যক্তিরা যদি এমন সার্ভিস দেন তাহলে এটার পরিধি আরও বাড়বে। এতে অসহায় রোগীরা উপকৃত হবে।’
রোগীরা রিয়াদের ব্যক্তিগত মোবাইল নাম্বারে (০১৮১৯৮২২৪৪৩) কল করে যোগাযোগ করলে বিনামূল্যের এই অটোরিকশা সার্ভিস পাবেন।