নিজস্ব প্রতিবেদক প্রকাশের সময় :৭ জুন, ২০২১ ১:৪৮ : অপরাহ্ণ
কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক অরাজনৈতিক সংগঠন হেফাজতে ইসলামের ৩৩ সদস্যের নতুন কমিটি গঠন নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। হেফাজতের আগের কমিটি বিলুপ্তির ৪২ দিন পর নতুন এই কমিটিতে বিতর্কিত ও কারাবন্দি নেতাদের স্থান দেওয়া হয়নি। অথচ হেফাজতের আমির আল্লামা শাহ আহমদ শফি হত্যা মামলার আসামি হয়েও নতুন কমিটিতে আবার আমির হয়েছেন জুনায়েদ বাবুনগরী ও সাংগঠনিক সম্পাদক পদে স্থান পেয়েছেন মীর ইদ্রিস।
এছাড়া ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সহিংসতার ঘটনায় অভিযুক্ত জেলা হেফাজতে ইসলামের সভাপতি মাওলানা সাজিদুর রহমান ও সাধারণ সম্পাদক মুফতি মোবারক উল্লাহও নতুন কমিটিতে স্থান পেয়েছেন। মাওলানা সাজিদুর রহমান যুগ্ম মহাসচিব ও মুফতি মোবারক উল্লাহ সদস্য পদে স্থান পেয়েছেন।
আজ সোমবার (৭ জুন) খিলগাঁও মাখজানুল উলুম মাদ্রাসায় সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে নতুন এই আংশিক কমিটি ঘোষণা করা হয়।
হেফাজতের শুরা (পরামর্শ) কমিটির মতামত ছাড়া নতুন এই কমিটি গঠন করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
নতুন কমিটিতে আগের কমিটির আহ্বায়ক জুনায়েদ বাবুনগরীকে আমির এবং সদস্য সচিব নুরুল ইসলাম জিহাদীকে মহাসচিব করা হয়েছে। এছাড়া হেফাজতের প্রয়াত আমির আল্লামা শফির বড় ছেলে মো. ইউসুফ মাদানীকে সহকারী মহাসচিব পদে স্থান দেওয়া হয়েছে। তবে তিনি এই পদ প্রত্যাখ্যান করেছেন বলে জানিয়েছেন।
গত বছরের ১৫ নভেম্বর হাটহাজারী দারুল উলূম মাদ্রাসায় সম্মেলনের মাধ্যমে জুনায়েদ বাবুনগরীকে আমির ও নূর হোসাইন কাসেমীকে মহাসচিব করে হেফাজতে ইসলামের ১৫১ সদস্যের পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন করা হয়েছিল। এই কমিটি হয়েছিল হেফাজতের ১৫ সদস্যের শুরা (পরামর্শ) কমিটির মতামতের ভিত্তিতে।
অভিযোগ উঠেছে, শুরা কমিটির মতামত ছাড়া হেফাজতের ৩৩ সদস্যের নতুন কমিটি গঠন করা হয়েছে। জুনায়েদ বাবুনগরী ও নুরুল ইসলাম জিহাদীর মতামতের ভিত্তিতে এই কমিটি গঠন হয়েছে।
ঢাকার একটি মাদ্রাসার হেফাজতের শুরা কমিটির সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, আমি হেফাজতকে কলঙ্কমুক্ত করতে একেবারে ঢেলে সাজানোর প্রস্তাব দিয়েছিলাম। শুনেছি, অনেকে নেতৃত্ব পরিবর্তনের মতামতও দিয়েছেন। কিন্তু তারা তাদের মতো করে কমিটি করেছে। পূর্ণাঙ্গ না করে ৩৩ সদস্যের আংশিক কমিটি ঘোষণা করা রহস্যজনক। হয়তো পরিস্থিতি অনুকূলে আসলে বিতর্কিত ও কারাবন্দি নেতাদের কমিটিতে আবার অন্তর্ভূক্ত করা হতে পারে।
চট্টগ্রামের হাটহাজারী দারুল উলূম মাদ্রাসার সাবেক প্রধান পরিচালক আল্লামা শাহ আহমদ শফিকে হত্যার অভিযোগে হেফাজতে ইসলামের আমির আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরীসহ ৪৩ জনকে অভিযুক্ত করে গত ১২ এপ্রিল আদালতে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। কিন্তু আল্লামা শফি হত্যা মামলার আসামি হয়েও জুনায়েদ বাবুনগরী হেফাজতের নতুন কমিটিতে নেতৃত্ব ধরে রেখেছেন। আল্লামা শফি হত্যা মামলার আসামির তালিকায় থাকা হাটহাজারীর মাওলানা মীর ইদ্রিসকেও নতুন কমিটির গুরুত্বপূর্ণ সাংগঠনিক সম্পাদক পদে স্থান দেওয়া হয়েছে। তিনি জুনায়েদ বাবুনগরীর ঘনিষ্ঠ নেতা হিসেবে পরিচিত।
নতুন কমিটি থেকে হেফাজতের যেসব বিতর্কিত ও কারাবন্দি নেতারা বাদ পড়েছেন তারা হলেন- সদ্য বিলুপ্ত কমিটির যুগ্ম-মহাসচিব মাওলানা জুনায়েদ আল হাবিব, মাওলানা মামুনুল হক ও নাছির উদ্দিন মুনির, সাংগঠনিক সম্পাদক আজিজুল হক ইসলামাবাদী, কেন্দ্রীয় প্রচার সম্পাদক জাকারিয়া নোমান ফয়জী, খালিদ সাইফুল্লাহ আইয়ুবী, হাসান জামিল ও মুফতি হারুন ইজহার।
‘সরকারের চাপে’ হেফাজতের নতুন কমিটিতে বিতর্কিত ও কারাবন্দি নেতাদের বাদ দেওয়া হয় বলে সংগঠনটির নেতারা জানিয়েছেন। অথচ মামলার আসামি হয়েও হেফাজতের নতুন কমিটির নেতৃত্বে আসীন হয়েছেন জুনায়েদ বাবুনগরী।
হেফাজতের নতুন কমিটির নায়েবে আমির পদে থাকা একজন নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেছেন, বিতর্কিত ও কারাবন্দি নেতাদের বাদ দেওয়ার ব্যাপারে সরকারের চাপ থাকলেও জুনায়েদ বাবুনগরীকে মাইনাস করার কোনো চাপ ছিল না। কারণ তিনি তো এখন তাদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছেন। মাইনাস করার চেয়ে নিয়ন্ত্রণে রাখার সুবিধা হয়তো বেশি।
হেফাজতের ৩৩ সদস্যের পূর্ণাঙ্গ কমিটিতে নায়েবে আমির হিসেবে রাখা হয়েছে নয়জনকে। তারা হলেন- মাওলানা আতাউল্লাহ হাফেজ্জী, মাওলানা সালাউদ্দিন নানুপুরী, অধ্যক্ষ মিজানুর রহমান চৌধুরী, মাওলানা মুহিব্বুল হক (সিলেট) ও মাওলানা উবায়দুর রহমান মাহবুবসহ (বরিশাল), মাওলানা আবদুল হক (ময়মনসিংহ), মাওলানা ইয়াহইয়া (হাটহাজারী মাদরাসা), মাওলানা আব্দুল কুদ্দুস (ফরিদাবাদ মাদরাসা), মাওলানা তাজুল ইসলাম ও মাওলানা মুফতী জসিমুদ্দীন (হাটহাজারী মাদরাসা)।
যুগ্ম মহাসচিব হয়েছেন পাঁচজন- মাওলানা সাজেদুর রহমান (বি-বাড়িয়া), মাওলানা আবদুল আউয়াল (নারায়নগঞ্জ), মাওলানা লোকমান হাকীম (চট্টগ্রাম), মাওলানা আনোয়ারুল করীম (যশোর) ও মাওলানা আইয়ুব বাবুনগরী।
সহকারী মহাসচিব হিসেবে আছেন মাওলানা জহুরুল ইসলাম ও মাওলানা ইউসুফ মাদানীকে। সাংগঠনিক সম্পাদক হিসেবে মাওলানা মীর ইদ্রিস (চট্টগ্রাম), অর্থ সম্পাদক হিসেবে মাওলানা মুফতী মুহাম্মদ আলী (মেখল) ও সহ-অর্থ সম্পাদক হিসেবে আছেন মাওলানা মুফতী হাবিবুর রহমান কাসেমী (নাজিরহাট)।
প্রচার সম্পাদক করা হয়েছে মাওলানা মুহিউদ্দীন রব্বানীকে (সাভার) এবং সহ-প্রচার সম্পাদক করা হয়েছে মাওলানা জামাল উদ্দীনকে (কুড়িগ্রাম)। দাওয়া বিষয়ক সম্পাদক হিসেবে আছেন মাওলানা আবদুল কাইয়ুম সোবহানী (উত্তরা) এবং সহকারী দাওয়া হিসেবে আছেন মাওলানা ওরম ফারুক (নোয়াখালী)।
এছাড়া কমিটিতে সদস্য হিসেবে রাখা হয়েছে নয়জনকে। তারা হলেন- মাওলানা মোবারাকুল্লাহ (বি.বাড়িয়া), মাওলানা ফয়জুল্লাহ (মাদানীনগর), মাওলানা ফোরকানুল্লাহ খলিল (চট্টগ্রাম), মাওলানা মোশতাক আহমদ (খুলনা), মাওলানা রশিদ আহমদ (কিশোরগঞ্জ), মাওলানা আনাস (ভোলা), মাওলানা মাহমুদুল হাসান (ফতেহপুরী) এবং মাওলানা মাহমুদুল আলম (পঞ্চগড়)।
উল্লেখ্য, গত বছরের ১৫ নভেম্বর জুনায়েদ বাবুনগরীকে আমির করে ১৫১ সদস্য বিশিষ্ট হেফাজতের কমিটি ঘোষণা করা হয়। বিশেষ পরিস্থিতির কথা বলে হেফাজত আমির জুনায়েদ বাবুনগরী চলতি বছরের ২৬ এপ্রিল হেফাজতের এ কমিটির বিলুপ্তি ঘোষণা করে পাঁচ সদস্যের আহবায়ক কমিটি ঘোষণা করেন।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ আগমনকে কেন্দ্র করে গত মার্চের ২৫, ২৬ ও ২৭ তারিখ দেশজুড়ে সহিংস ঘটনায় অন্তত ১৭ জনের প্রাণহানি হয়। এসব নাশকতার পেছনে জড়িত থাকার অভিযোগে অন্তত এক ডজন হেফাজত নেতা গ্রেপ্তার হয়ে বর্তমানে জেলে বন্দী রয়েছেন।
এছাড়াও নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁওয়ে রয়্যাল রিসোর্টের আলোচিত ঘটনায় হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব মামুনুল হককে নিয়ে বিতর্কের মুখে পড়ে হেফাজত। এসব ঘটনায় সরকারের কঠোরতার কারণে কোণঠাসা হয়ে পড়ে হেফাজতে ইসলাম।