নিজস্ব প্রতিবেদন প্রকাশের সময় :১১ মে, ২০২১ ১১:৫৫ : পূর্বাহ্ণ
মুসা সিকদার নামে এক ব্যক্তির সাথে মোবাইল ফোনে মাত্র ২৭ সেকেন্ডের কথোপকথনের রেকর্ডের কারণেই ফেঁসে গেছেন সাবেক পুলিশ সুপার বাবুল আক্তার। এই কথোপকথনের সূত্র ধরে চট্টগ্রামের বহুল আলোচিত ও চাঞ্চল্যকর মাহমুদা খানম মিতু হত্যার ঘটনায় তার স্বামী বাবুল আক্তারকে কয়েক দফা জিজ্ঞাসাবাদ শেষে মঙ্গলবার (১১ মে) ‘আটক’ করেছে পুলিশ ব্যুরো ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)।
এর আগে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য মিতু হত্যা মামলার বাদী বাবুল আক্তারকে ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে ডেকে নেয় তদন্তকারী সংস্থা পিবিআই। সকাল ১০টায় বাবুল আক্তার উপস্থিত হন পিবিআই চট্টগ্রাম মেট্রো কার্যালয়ে। জিজ্ঞাসাবাদ শেষে বাবুল আক্তারকে ‘আটক’ করে রাখা হয়েছে বলে জানিয়েছেন পিবিআইয়ের এক কর্মকর্তা।
এই কর্মকর্তা জানিয়েছেন, মিতু হত্যা মামলায় বাদী হিসেবে বাবুল আক্তারকে গ্রেপ্তারের আইনি সুযোগ নেই। এ হত্যা মামলায় পুলিশ চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করবে। বুধবার (১২ মে) সকালে বাবুল আক্তারকে আদালতে হাজির করা হবে। নতুন মামলায় তাকে গ্রেপ্তার দেখানো হবে।
২০১৬ সালের ৫ জুন সকাল ৭টা ৩৭ মিনিটে চট্টগ্রামের কামরুল শিকদার মুসা নামে এক ব্যক্তির মোবাইল ফোনে কল যায় তৎকালীন এসপি বাবুল আক্তারের মোবাইল ফোন থেকে। সালাম দিয়ে মুসা ফোনটি রিসিভ করতেই অপর প্রান্ত থেকে বাবুল আক্তার বলেন, ‘তুই কোপালি ক্যান?’
৩/৪ সেকেন্ড থেমে আবার বলেন, ‘বল তুই কোপালি ক্যান? তোরে কোপাতে কইছি?’
অপর প্রান্ত থেকে মুসা বলেন, ‘না মানে…।’
বাবুল আক্তার এরপর ফোনটি কেটে দেন।
মাত্র ২৭ সেকেন্ডের মোবাইল ফোনের কথোপকথনের রেকর্ডটিই এখন মিতু হত্যার প্রধান আলামত ও সাক্ষী। এই ২৭ সেকেন্ড কলের কথোপকথনের রেকর্ড পেয়েই হত্যাকাণ্ডের ১৯ দিন পর ২০১৬ সালের ২৪ জুন রাতে বনশ্রীর শ্বশুরের বাসা থেকে বাবুলকে মিন্টো রোডের ডিবি কার্যালয়ে নিয়ে প্রায় ১৪ ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। তার কিছু দিন পর পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়, বাবুল আক্তার স্বেচ্ছায় চাকরিতে ইস্তফা দিয়েছেন।
২০১৬ সালের ৫ জুন ভোরে চট্টগ্রাম নগরীর জিইসি মোড়ে ছেলেকে স্কুলবাসে তুলে দিতে যাওয়ার সময় গুলি ও ছুরিকাঘাত করে হত্যা করা হয় মাহমুদা খানম মিতুকে। ওই সময় পুলিশ সুপার বাবুল আক্তার অবস্থান করছিলেন ঢাকায়। চট্টগ্রামে ফিরে তিনি পাঁচলাইশ থানায় অজ্ঞাতনামাদের আসামি করে হত্যা মামলা করেন।
এই হত্যা মামলায় ওই বছরের ৮ জুন ও ১১ জুন নগর গোয়েন্দা পুলিশ হাটহাজারি উপজেলা থেকে আবু নসুর গুন্নু ও বায়েজিদ বোস্তামী থানার শীতল ঝর্ণা থেকে শাহ জামান ওরফে রবিন নামে দু’জনকে গ্রেফতারের খবর জানায়। পরে পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়, মিতু হত্যায় তাদের সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়নি। দীর্ঘদিন জেলে থাকার পর তারা জামিনে মুক্তি পান।
২৬ জুন মো. আনোয়ার ও মো. মোতালেব মিয়া ওরফে ওয়াসিম নামে দু’জনের গ্রেপ্তারের খবর প্রকাশ করে পুলিশ। তারা আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। তারা হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে জানান, মিতু হত্যায় ব্যবহৃত অস্ত্রটি তাদের ভোলা দিয়েছিল।
এরপর এহেতাশামুল হক ভোলা ও তার সহযোগী মো. মনিরকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাদের কাছ থেকে পয়েন্ট ৩২ বোরের একটি পিস্তল উদ্ধার করা হয়, যেটি মিতু হত্যায় ব্যবহৃত হয়েছে বলে পুলিশের ভাষ্য।
এ ঘটনায় পুলিশের পক্ষ থেকে ভোলা ও মনিরকে আসামি করে একটি অস্ত্র মামলা দায়ের করা হয়।
এরপর ১ জুলাই মোটরসাইকেল সরবরাহ করার অভিযোগে মুসা সিকদারের ভাই সাইদুল আলম শিকদার ওরফে সাক্কু ও শাহজাহান নামে দু’জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। ভোলা, সাইদুল ও রবিন এরই মধ্যে জামিনে মুক্তি পেয়েছেন।
মিতু হত্যায় সন্দেহভাজনদের মধ্যে রাশেদ ও নবী নামে দু’জন রাঙ্গুনিয়ায় পুলিশের সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়।
পুলিশের ভাষ্যমতে, মিতু হত্যায় অন্যতম সন্দেহভাজন মুসা সিকদার পলাতক আছেন। তবে পুলিশ তখন মুসাকে গ্রেপ্তার করেছিল বলে গুঞ্জন উঠে। তার স্ত্রী তখন গণমাধ্যমকে জানিয়েছিলেন, মুসাকে পুলিশ আটক করে নিয়ে গেছেন। গত পাঁচ বছর ধরে মুসার কোনো হদিস পাওয়া যায়নি।
পাঁচ বছর আগে বাবুল আক্তারকে ডিবি পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদ করার পর মিতুর বাবা সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা মোশাররফ হোসেন দাবি করে আসছেন, বাবুল আক্তারের পরিকল্পনায় ও নির্দেশে তার মেয়ে মিতুকে খুন করা হয়েছে।
চাকরি থেকে ইস্তফা দেওয়ার পর ২০১৬ সালের ৯ আগস্ট পদত্যাগপত্র প্রত্যাহারের জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেন বাবুল আক্তার। নানা নাটকীয়তা শেষে ৬ সেপ্টেম্বর বাবুলকে চাকরি থেকে অব্যাহতি দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
উল্লেখ্য, গত ৪ ফেব্রুয়ারি মিতু হত্যা মামলার অগ্রগতির বিষয়ে হাইকোর্ট বেঞ্চে শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। শুনানিতে বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মোহাম্মদ মোস্তাফিজুর রহমানের হাইকোর্ট বেঞ্চকে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল সারোয়ার হোসেন বাপ্পী জানান, শিগগিরই মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেয়া হবে।