রাজনীতি সংবাদ প্রতিবেদন প্রকাশের সময় :১ মার্চ, ২০২১ ৯:০০ : অপরাহ্ণ
চট্টগ্রাম নগরীর পতেঙ্গা লালদিয়ার চরে ৪৮ বছর ধরে বসবাসরত ১৪ হাজার বাসিন্দাকে চোখের পানি ফেলে শেষ পর্যন্ত ভিটেমাটি ছাড়তে হলো। লালদিয়ার চরের বাসিন্দাদের পুনর্বাসনের দাবি মেনে নেয়নি সরকার। স্থানীয় বাসিন্দাদের উচ্ছেদ করতে বিপুল সংখ্যক র্যাব, পুলিশ ও আনসার সদস্য নিয়ে আজ (১ মার্চ) ওই এলাকায় উচ্ছেদ অভিযান শুরু করে বন্দর কর্তৃপক্ষ। ৫২ একর জায়গা থেকে বাসিন্দাদের উচ্ছেদ করে সেখানে কাঁটাতারের বেড়া দেওয়া হচ্ছে।
বন্দর ম্যাজিস্ট্রেট মো. সাইফুল ইসলামের নেতৃত্বে পাঁচজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সোমবার সকাল থেকে এ উচ্ছেদ অভিযান শুরু করেন। তবে উচ্ছেদ অভিযানে কোনো প্রকার বাধার সৃষ্টি করেননি স্থানীয় বাসিন্দারা। অভিযানের দুই দিন আগে বাসিন্দাদের অনেকে ভিটেমাটি ছাড়তে শুরু করেন। আজ সকাল থেকে বাসিন্দারা স্বেচ্ছায় বসতঘর ছেড়ে চলে যেতে শুরু করেন।
অভিযান চালাকালে চলাকালে সকাল সাড়ে ৯টার দিকে লালদিয়ার চর এলাকা পরিদর্শন করেন বন্দর চেয়ারম্যান কমডোর এম শাহজাহান।
গত ২০ ফেব্রুয়ারি বিকেলে লালদিয়ার চরের কয়েক হাজার মানুষ মানববন্ধন করে উচ্ছেদের আগে পুনর্বাসনের দাবি জানিয়েছিলেন। এরপর ২৬ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবের সামনে মানববন্ধন ও সংবাদ সম্মেলন করেন লালদিয়ার চরবাসী। লালদিয়ার চর এলাকায় মানববন্ধনে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরাও সংহতি জানিয়েছিলেন। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা মানববন্ধনে হুংকার দিয়েছিলেন, লালদিয়ার চরে উচ্ছেদ করতে আসলে তারা রাস্তায় শুয়ে পড়বেন। গত ২৪ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম নগর আওয়ামী লীগ কার্যনির্বাহী কমিটির সভায়ও লালদিয়ার চরবাসীদের পুনর্বাসনের দাবির প্রস্তাব তোলা হয়েছিল।
জেলা প্রশাসন লালদিয়ার চরের ২ হাজার ৩০০ পরিবারকে পুনর্বাসনের প্রস্তাব পাঠালেও সরকারের পক্ষ থেকে সায় দেওয়া হয়নি। গত ২৪ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রামে এসে নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী লালদিয়ার চরে উচ্ছেদের পক্ষে অনড় অবস্থান নিয়ে বলেছিলেন, সেখানে পুনর্বাসনের মতো কেউ নেই।
পতেঙ্গা এলাকার বাসিন্দারা স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের ভুমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন। তাদের অভিযোগ, স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা কেউই লালদিয়ার চরবাসীদের পুনর্বাসনের উদ্যাগ নিতে কার্যকর ভূমিকা রাখেননি। বরং তাদের নিয়ে রাজনীতি করেছে। বন্দর-পতেঙ্গা আসনের আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য এম এ লতিফের নীরব ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন তারা। তিনি সংসদ সদস্য হয়েও তাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে কোনো উদ্যোগ নেননি বলে জানান স্থানীয়রা।
স্থানীয় বাসিন্দাদের অনেকে মনে করছেন, আওয়ামী লীগের স্থানীয় কোনো কোনো নেতা ও জনপ্রতিনিধি মানববন্ধনে হুংকার দিলেও এরপর রহস্যজনকভাবে তারা নীরব ভূমিকা পালন করেন।
লালদিয়ার চরের একজন বাসিন্দা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, মানববন্ধনে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি বলেছিলেন, লালদিয়ার চরবাসীকে পুনর্বাসন ছাড়া উচ্ছেদ করতে আসলে তিনি রাস্তায় শুয়ে পড়বেন। তিনি এখন কোথায় গেলেন? আরও অনেকে বড় বড় কথা বলেছিলেন। এসব ছিল তাদের রাজনৈতিক স্ট্যান্ডবাজি।
গেল শনিবার চট্টগ্রাম বন্দর চেয়ারম্যানের সাথে বৈঠক করেছিলেন লালদিয়ার চর মহল্লা কমিটি ও স্থানীয় প্রতিনিধিরা।
জানা গেছে, বৈঠকে বন্দরটিলা এলাকার আওয়ামী লীগ নেতা মোহাম্মদ আসলাম বন্দর চেয়ারম্যানকে লালদিয়ার চরবাসীদের আর্থিকভাবে সহায়তা করার জন্য সরকারের নিকট দাবি জানানোর অনুরোধ করেন। বন্দর চেয়ারম্যান তাতে সায়ও দেন। কিন্তু লালদিয়ার চরের প্রতিনিধিরা আর্থিক সহায়তা নিতে অপারগতা প্রকাশ করেন।
আওয়ামী লীগ নেতা মোহাম্মদ আসলাম রাজনীতি সংবাদকে বলেন, দক্ষিণ পতেঙ্গা ওয়ার্ড কাউন্সিলর আমাকে তার পক্ষ হয়ে বৈঠকে কথা বলতে নিয়ে যান। যেহেতু হাইকোর্টের আদেশ, তাই উচ্ছেদ ঠেকানোর কোনো সুযোগ নেই। তাই আমি বন্দর চেয়ারম্যানকে বলেছিলাম, লালদিয়ার চরবাসীকে সরকারের পক্ষ থেকে আর্থিকভাবে সহায়তা করার জন্য। তিনি বিষয়টি সরকারের উচ্চ পর্যায়ে জানিয়ে উদ্যোগ নিবেন বলে জানান। কিন্তু লালদিয়ার চরের প্রতিনিধিরা বৈঠকে এ প্রস্তাবে রাজি হননি। তারা উচ্ছেদের জন্য আরও চার দিন সময় চেয়েছিলেন।
লালদিয়ার চর মহল্লা কমিটির সভাপতি আবদুল কাদের রাজনীতি সংবাদকে বলেন, বন্দর চেয়ারম্যানের কি আমাদের সহায়তা করার ক্ষমতা আছে? আর ৫ হাজার টাকা করে সহায়তা নিয়ে কী হবে?
তাহলে বৈঠকে কেন গেলেন?-এর উত্তরে তিনি বলেন, আমরা আরও চার দিন সময় চাইতে গিয়েছিলাম। যাতে বাসিন্দারা তাদের বাসার মালামাল স্থানান্তরের সুযোগটা পায়। কিন্তু বন্দর চেয়ারম্যান আমাদের আর সময় দিতে রাজি হননি।
উল্লেখ্য, কর্ণফুলী নদী রক্ষায় নির্দেশনা চেয়ে দশ বছর আগে মানবাধিকার ও পরিবেশবাদী সংগঠন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের সভাপতি সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মনজিল মোরসেদ হাইকোর্টে একটি রিট করেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৬ সালের ১৬ আগস্ট এক রায়ে হাইকোর্ট কর্ণফুলী নদীর তীরে থাকা অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের নির্দেশ দেন। এর আগের বছর হাইকোর্টের নির্দেশে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন কর্ণফুলী নদীপারের ২ হাজার ১১২টি অবৈধ স্থাপনা চিহ্নিত করে প্রতিবেদন দিয়েছিল। আদালতের নির্দেশের তিন বছর পর ২০১৯ সালের ২২ জুলাই লালদিয়ার চরের এ-ব্লকের আড়াইশ স্থাপনা উচ্ছেদ করে প্রায় ২০ একর জমি দখলমুক্ত করে বন্দর কর্তৃপক্ষ। এরপর ৯ মাস উচ্ছেদ কার্যক্রম বন্ধ ছিল।
কর্ণফুলী নদীর তীরে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ কার্যক্রম চলমান না থাকার পরিপ্রেক্ষিতে মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস গত বছরের ৭ এপ্রিলে হাইকোর্টে একটি আবেদন করে। ওই আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্ট কর্ণফুলী নদীর তীরের অবৈধ সব স্থাপনা উচ্ছেদে তিন মাসের সময় বেঁধে দিয়েছিল। অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের আগে সংশ্লিষ্ট স্থানের স্থাপনার পানি, গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করতেও বলা হয়। কিন্তু বন্দর কর্তৃপক্ষ করোনা পরিস্থিতির কারণে উচ্ছেদের নির্দেশনা বাস্তবায়ন করতে পারেনি বলে হাইকোর্টকে জানায়।
গত বছরের ৮ ডিসেম্বর হাইকোর্টে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদে আদালতের ইতিপূর্বের নির্দেশনা বাস্তবায়নের অগ্রগতি বিষয়ক শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। ওই শুনানিতে হাইকোর্টের বিচারপতি মো. আশফাকুল ইসলাম ও বিচারপতি মোহাম্মদ আলীর সমন্বয়ে গঠিত ভার্চ্যুয়াল বেঞ্চ কর্ণফুলী নদীর তীরের লালদিয়ার চর থেকে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে দুই মাস সময় বেঁধে দেন বন্দর কর্তৃপক্ষকে। দুই মাসের মধ্যে উচ্ছেদে ব্যর্থ হলে আগামী ৯ মার্চ পরবর্তী শুনানিতে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষসহ বিবাদীদের আদালতে উপস্থিত হতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
হাইকোর্টের নির্দেশের পর গত ১৭ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ পত্রিকায় গণবিজ্ঞপ্তি দিয়ে হাইকোর্টের আদেশ অনুযায়ী লালদিয়ার চরের অবৈধ দখলদারদের বিদ্যুৎ, গ্যাস ও পানি সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে উচ্ছেদ করা হবে বলে জানায়।
১৯৭২ সালে বিমান বাহিনীর ঘাঁটি সম্প্রসারণের সময় নিজেদের ভিটামাটি ছেড়ে লালদিয়ার চরে বসতি শুরু করে স্থানীয় কয়েকশ পরিবার। ২ হাজার ৩০০ পরিবারের ১৪ হাজার মানুষ এতদিন সেখানে বসবাস করে আসছিল।