ছাত্রলীগ চট্টগ্রাম মহানগর শাখার ইউনিট কমিটি গঠন নিয়ে বিক্ষুদ্ধদের তোপের মুখে পড়েছেন সংগঠনের সভাপতি ইমরান আহমেদ ইমু ও সাধারণ সম্পাদক জাকারিয়া দস্তগীর। সম্প্রতি নগর ছাত্রলীগের আওতাধীন ১৩টি ইউনিটের কমিটি ঘোষণা করা হয়। এসব কমিটিতে যারা পদ পায়নি এবং ‘অবমূল্যায়ন’ হয়েছেন তারা ইমু-দস্তগীরের বিরুদ্ধে স্বজনপ্রীতির অভিযোগ তুলে ফেসবুকে সমালোচনা ও রাজপথে বিক্ষোভে নেমেছেন। নগর ছাত্রলীগের একটা অংশ অসন্তুষ্ট হয়ে পাল্টা কমিটি গঠন করে ইমু-দস্তগীরকে চ্যালেঞ্জও ছুঁড়ে দিয়েছেন।
বুধবার (১০ ফেব্রুয়ারি) নগর ছাত্রলীগের সভাপতি ইমরান আহমেদ ইমু ও সাধারণ সম্পাদক জাকারিয়া দস্তগীর স্বাক্ষরিত নগরীর ১২টি ইউনিটের কমিটি ঘোষণা করা হয়। এগুলো হলো-বাকলিয়া থানা, চকবাজার থানা, হালিশহর থানা, বায়েজিদ থানা, পাহাড়তলী থানা, হাজী মুহাম্মদ মহসীন কলেজ, ১৭ নম্বর পশ্চিম বাকলিয়া ওয়ার্ড, ১৯ নম্বর দক্ষিণ বাকলিয়া ওয়ার্ড, ১৬ নম্বর চকবাজার ওয়ার্ড, ১১ নম্বর দক্ষিণ কাট্টলী ওয়ার্ড, ১২ নম্বর সরাই পাড়া ওয়ার্ড এবং ২৫ নম্বর রামপুরা ওয়ার্ড। এছাড়া আজ (১২ ফেব্রুয়ারি) পাঁচলাইশ থানার কমিটিও ঘোষণা করা হয়। এর আগে ছয় থানা, দুটি ওয়ার্ড ও একটি কলেজ শাখার কমিটি ঘোষণা করা হয়।
নগর ছাত্রলীগের একাংশ (নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দীনের সমর্থক) ইমু-দস্তগীরের কমিটি নিয়ে অসন্তুষ্ট হয়ে বৃহস্পতিবার (১১ ফেব্রুয়ারি) রাতে নগরীর বাকলিয়া ও পাহাড়তলী থানা এবং হাজী মুহাম্মদ মহসিন কলেজে পাল্টা কমিটি ঘোষণা করে বসেন। তারা নগরীর অন্যান্য ইউনিটের কমিটিও গঠনের প্রক্রিয়া চালাচ্ছেন।
উল্লেখ্য, নগর ছাত্রলীগের সভাপতি ইমরান আহমেদ ইমু ও সাধারণ সম্পাদক জাকারিয়া দস্তগীর শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলের অনুসারী হিসেবে পরিচিত।
বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, ইমু-দস্তগীরের ঘোষিত কমিটি নিয়ে প্রতিপক্ষ শিবির আ জ ম নাছিরের সমর্থকদের পাশাপাশি শিক্ষা উপমন্ত্রীর বলয়ের ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরাও ফেসবুকে কদর্য ভাষায় বিষোদগার করছেন। রাজপথেও ক্ষোভে ফুঁসছেন বিক্ষুব্ধ নেতাকর্মীরা। গেল বৃহস্পতিবার নগরীর মহসিন কলেজের সামনে রাস্তায় আগুন জ্বালিয়ে বিক্ষোভ করেছেন তারা। এসময় বিক্ষুব্ধ নেতাকর্মীরা ইমু ও দস্তগীরের ছবিতে আগুন দিয়ে বিক্ষোভ করেন।
নগর ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক নুরুল আজিম রনি ইউনিট কমিটিগুলোতে তার সমর্থকদের বাদ দেওয়ার অভিযোগ করে ইমু-দস্তগীরকে ফেসবুকে সমালোচনার তীর ছুঁড়েছেন।
গত ১০ ফেব্রুয়ারি নুরুল আজিম রনি নিজের ফেসবুক ওয়ালে লিখেন-‘বিভিন্ন ওয়ার্ড থানাতে কমিটি দিয়েছে। শতাধিক ছাত্রলীগ কর্মী আজ পদে এসেছে। আনন্দের সংবাদ- ছোট ভাইদের অভিনন্দন।পাশাপাশি আমার সাথে থাকার কারনে ওয়ার্ড থানা থেকে গণহারে বাদ দেওয়ার জন্য অভিনন্দন জানাচ্ছি ইমরান আহমেদ ইমু ও জাকারিয়া দস্তগীরকে। আমাকে রাজনৈতিক ভাবে মোকাবিলা করতে ভয় পাও জানতাম, আমার কর্মী সমর্থকদেরও যে ভয় পাও আজ জানলাম। ধন্যবাদ।’
নিজের ফেসবুক ওয়ালে অপর একটি স্ট্যাটাসে দস্তগীরকে ইঙ্গিত করে ‘ব্যক্তিগত আক্রমণ’ও করেছেন রনি ।
নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দীনের সমর্থক নগর ছাত্রলীগের যুগ্ম সম্পাদক মুঈনুর রহমান কমিটি নিয়ে নিজের ফেসবুক ওয়ালে লিখেন-‘ইমু-দস্তগীর’র দোকান যা শুরু করছে! চট্টগ্রাম মহানগরে সেদিন আর বেশী দূরে নয়!!চায়ের দোকান’র মেসিয়ারও বলবে সে অমুক ওয়ার্ড/থানা/কলেজ ছাত্রলীগ’র সভাপতি/সম্পাদক…’
নগর ছাত্রলীগের সভাপতি ইমরান আহমেদ ইমুর মোবাইল ফোন বন্ধ থাকায় এ বিষয়ে তার বক্তব্য জানা যায়নি।
কমিটি নিয়ে বিক্ষুব্ধ নেতাকর্মীদের সমালোচনা স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া হিসেবে দেখছেন বলে জানিয়েছেন নগর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক জাকারিয়া দস্তগীর।
তিনি রাজনীতি সংবাদকে বলেন, ‘একসাথে ১৩টি ইউনিটের কমিটি ঘোষণা করেছি, সমালোচনা যে হবে সেটা আমি আগেই জানতাম। রাজনীতি করি তাই সমালোচনাকে ভয় করি না। কিন্তু আমরা মনে করি, প্রায় ৩১ বছর পর ইউনিট কমিটি গঠন করেছি। জট ভেঙ্গে দিয়েছি। এটা আমাদের বিরাট সফলতা।’
নুরুল আজিম রনির সমালোচনার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘সে আমাকে ব্যক্তিগত আক্রমণ করেছে। কিন্তু তাতে আমার কী আসে যায়? এটা তার হীনমন্যতা। সে তো ব্যর্থ, সে সাংগঠনিক দায়িত্ব পালন করতে পারেনি। এখন আমি কমিটি করেছি বিধায় তার গায়ে জ্বালা ধরেছে।’
কমিটিতে নেতাকর্মীদের অবমূল্যায়ন ও বাদ পড়া প্রসঙ্গে জাকারিয়া দস্তগীর বলেন, ‘সভাপতি পদ তো দুজনকে দেওয়া যায় না। আর আমরা নিজেদের পছন্দমতো কমিটি করিনি। ওয়ার্ড, থানা ও মহানগর আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের সম্মতিতে সবাইকে সমন্বয় করে কমিটি করেছি।’
নগর ছাত্রলীগের একটা অংশের পাল্টা কমিটি ঘোষণা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘তারা সাংগঠনিক ও রাজনৈতিকভাবে অজ্ঞ। তারা পাল্টা কমিটি দেওয়ার এখতিয়ার রাখে না। পাল্টা কমিটি দিতে পারে সভাপতি কিংবা সেক্রেটারি। তারা পাল্টা কমিটি দিয়ে শৃঙ্খলা ভঙ্গ করেছেন।’
ছাত্রলীগের ইউনিট কমিটি নিয়ে সমালোচনার বিষয়ে নুরুল আজিম রনি রাজনীতি সংবাদকে বলেন, ‘কমিটিতে খুনের মামলার আসামিদের নেতা বানানো হয়েছে আর ত্যাগী কর্মীদের বাদ দেওয়া হয়েছে। আমার কর্মী বিধায় তাদের বাদ দেওয়া হয়েছে।’
প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘কমিটি তো সে (দস্তগীর) একা দেয়নি। আর কমিটি চাইলে যখন তখন দেওয়া যায় না। আমি যখন দায়িত্বে ছিলাম তখন আমার পাশে কোনো মন্ত্রী ছিল না। এখন তাদের পাশে মন্ত্রী আছে বিধায় কমিটি দিতে পেরেছে।’
উল্লেখ্য, ২০১৩ সালে ইমরান আহমেদ ইমু সভাপতি ও নুরুল আজিম রনিকে সাধারণ সম্পাদক করে মহানগর ছাত্রলীগের কমিটি গঠন করা হয়েছিল। ২০১৮ সালের ২০ এপ্রিল নুরুল আজিম রনি পদত্যাগ করলে যুগ্ম সাধারণ সম্পাাদক হিসেবে জাকারিয়া দস্তগীর ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব নেন। গত বছরের ১৯ জুলাই কেন্দ্র থেকে দস্তগীরকে পূর্ণাঙ্গ সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব দেওয়া হয়।
পাল্টা কমিটি ঘোষণার বিষয়ে মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দীনের সমর্থক নগর ছাত্রলীগের সহ সভাপতি মিথুন মল্লিক রাজনীতি সংবাদকে বলেন, ‘তারা (ইমু-দস্তগীর) জট ভাঙতে গিয়ে আরেকটা প্রজন্মকে জটে ফেলে দিয়েছে। নাছির ভাইয়ের সমর্থক বলে কমিটিতে কাউকে অবমূল্যায়ন করা হয় আর কাউকে পদ দেওয়া হয় না।’
প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমাদের কমিটি নিয়ে যদি বৈধতার প্রশ্ন উঠে তাহলে নগর ছাত্রলীগেরও তো বৈধতা নেই। ৬ বছরের মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটি। তারা (ইমু-দস্তগীর) ইউনিট কমিটি ঘোষণার বৈধতা রাখে না।’
এ পর্যন্ত নগর ছাত্রলীগের আওতাধীন ১১টি থানা, ৮টি ওয়ার্ড ও দুটি কলেজ শাখা কমিটি ঘোষণা করা হয়েছে।
থানা কমিটিগুলো হলো-চান্দগাঁও, ডবলমুরিং, আকবরশাহ, বন্দর, পতেঙ্গা, বাকলিয়া, চকবাজার, হালিশহর, বায়েজিদ, পাহাড়তলী ও পাঁচলাইশ।
ওয়ার্ড কমিটিগুলো হলো- ১৭ নম্বর পশ্চিম বাকলিয়া, ১৮ নম্বর পূর্ব বাকলিয়া, ১৯ নম্বর দক্ষিণ বাকলিয়া, ১৬ নম্বর চকবাজার, ১০ নম্বর উত্তর কাট্টলী, ১১ নম্বর দক্ষিণ কাট্টলী ওয়ার্ড, ১২ নম্বর সরাই পাড়া ওয়ার্ড এবং ২৫ নম্বর রামপুর।
দুটি কলেজ কমিটি হলো-হাজী মুহাম্মদ মহসীন কলেজ ও চট্টগ্রাম কলেজ।