রাজনীতি সংবাদ প্রতিবেদন প্রকাশের সময় :৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ ৭:৩০ : অপরাহ্ণ
হাটহাজারী দারুল উলুম মাদ্রাসার সাবেক প্রধান পরিচালক আল্লামা শাহ আহমদ শফির মৃত্যুর ঘটনায় দায়ের করা ‘হত্যা মামলায়’ স্বাক্ষীদের জবানবন্দির ভিত্তিতে হেফাজতে ইসলামের আমির আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরীকে অভিযোগপত্রে (চার্জশিট) আসামি করা হতে পারে। মামলার তদন্ত সংস্থা পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) সূত্রে এমন আভাস পাওয়া গেছে।
গত বছরের ১৭ ডিসেম্বর চট্টগ্রামের জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে হেফাজতের সাবেক আমির আল্লামা আহমদ শফিকে ‘মানসিক নির্যাতন করে পরিকল্পিতভাবে’ হত্যার অভিযোগে ৩৬ জনের বিরুদ্ধে একটি মামলা দায়ের হয়। আহমদ শফির শ্যালক মোহাম্মদ মহিউদ্দিন এই মামলা দায়ের করেন।
পিবিআইকে এক মাসের মধ্যে (৯ ফেব্রুয়ারি) এই মামলার তদন্ত রিপোর্ট জমা দেয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন আদালত। কিন্তু তদন্ত কার্যক্রম সম্পন্ন না হওয়ায় আগামীকাল মঙ্গলবার অভিযোগপত্র দিচ্ছে না পিবিআই।
ঢাকার বেসরকারী আজগর আলী হাসপাতাল থেকে আল্লামা শফির মূল মৃত্যু সনদ না পাওয়ায় তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে পারছে না পিবিআই।
উল্লেখ্য, গত বছরের ১৮ সেপ্টেম্বর ঢাকার বেসরকারী আজগর আলী হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান ১০৪ বছর বয়সী আল্লামা আহমদ শফি। এর আগের দিন রাতে তাকে হাটহাজারী মাদ্রাসা থেকে মুমূর্ষ অবস্থায় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আইসিইউতে নেয়া হয়েছিল। পরে সেখান থেকে তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকার আজগর আলী হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়। মামলার আরজিতে সংযুক্ত মৃত্যু সনদের স্ক্যান কপিতে আল্লামা শফি হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা যান বলে উল্লেখ করা হয়।
মামলার আরজিতে ৬ জনকে স্বাক্ষী করা হলেও পিবিআই এ পর্যন্ত ২৬ জনের স্বাক্ষী নিয়েছে। পিবিআই কর্মকর্তারা গত ১২ জানুয়ারি হাটহাজারী দারুল উলুম মাদ্রাসায় গিয়ে ১৫ জনের জবানবন্দি নিয়েছেন।
পিবিআইয়ের তদন্ত কর্মকর্তা মনির হোসেন রাজনীতি সংবাদকে বলেন, ‘আল্লামা শফির হত্যা মামলার তদন্ত প্রায় শেষ পর্যায়ে। এ পর্যন্ত আমরা ২৬ জনের জবানবন্দি নিয়েছি। ঢাকার আজগর আলী হাসপাতালে আল্লামা শফির মূল মৃত্যু সনদের জন্য আমরা চিঠি দিয়েছি। তারা এখনো সনদ পাঠায়নি। এটা পেলে আমরা তদন্ত প্রতিবেদন আদালতে জমা দিবো।’
মামলার আরজিতে আসামির তালিকায় হাটহাজারী দারুল উলুম মাদ্রাসার শিক্ষা পরিচালক জুনায়েদ বাবুনগরীর নাম উল্লেখ নেই। তবে আরজিতে তাকে অভিযুক্ত করা হয়। আরজিতে উল্লেখ করা হয়, গত বছরের ১৬ সেপ্টেম্বর হাটহাজারী মাদ্রাসার ভেতরে ভাংচুর ও বিক্ষোভের ঘটনার সময় মাগরিবের নামাজ শেষে আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরী শূরা সদস্য নোমান ফয়েজী, মাওলানা সালাউদ্দিন এবং মাওলানা ওমর ফারুকসহ মাদ্রাসার কয়েকজন শিক্ষকদের নিয়ে বৈঠক করেন।
মামলার বাদী পক্ষের আইনজীবী আবু হানিফ রাজনীতি সংবাদকে বলেন, ‘আরজিতে আসামির তালিকায় হেফাজতের আমির আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরীর নাম না থাকলেও ঘটনার সাথে তাকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। বাদী হয়তো কৌশলগত কারণে আরজিতে তাকে আসামি করেননি। এখন অভিযোগের তদন্তে পিবিআই যদি ঘটনার সাথে তার সম্পৃক্ততা খুঁজে পায় তাকে অভিযোগপত্রে আসামি করতেই পারেন। কোনো স্বাক্ষী যদি জুনায়েদ বাবুনগরীকে অভিযুক্ত করে তাহলে অভিযোগপত্রে তাকে আসামি করার জোরালো সম্ভাবনা রয়েছে।’
পিবিআইয়ের তদন্ত কর্মকর্তা মনির হোসেন বলেন, ‘স্বাক্ষীদের জবানবন্দির ভিত্তিতে অভিযোগপত্রে হয়তো আরও আসামির নাম যুক্ত হতে পারে। তবে তদন্ত যেহেতু এখনো পুরোপুরি শেষ হয়নি সে বিষয়ে চূড়ান্তভাবে কিছু বলা যাচ্ছে না।’
আল্লামা শফি মারা যাওয়ার প্রায় তিন মাস পর এই মামলা দায়ের করা হয়। মামলায় মূল আসামি করা হয়েছে হেফাজতে ইসলামের চার নম্বর যুগ্ম মহাসচিব নাছির উদ্দিন মুনিরকে। ঘটনার মূল পরিকল্পনাকারী হিসেবে অভিযুক্ত করে হেফাজতে ইসলামের দুই নম্বর যুগ্ম মহাসচিব মুহাম্মদ মামুনুল হককে ২ নম্বর আসামি করা হয়েছে। আসামিরা সবাই হেফাজতে ইসলামের আমির জুনায়েদ বাবুনগরীর সমর্থক।
আল্লামা শফির মৃত্যুর পেছনে তিনটি ঘটনার কথা উল্লেখ করে মামলার আরজিতে বলা হয়, গত ১৬ ও ১৭ সেপ্টেম্বর হাটহাজারী দারুল উলুম মাদ্রাসার ভেতরে ভাংচুর ও বিক্ষোভের ঘটনার সময় আহমদ শফিকে তার রুমে অবরুদ্ধ করে মানসিকভাবে নির্যাতন করেন আসামিরা। এতে তিনি হতভম্ব হয়ে পড়েন। ১৬ সেপ্টেম্বর মাগরিবের নামাজের পর এক নম্বর আসামি নাছির উদ্দিন মুনির ঘটনার একপর্যায়ে আহমদ শফির অক্সিজেনের লাইন টান দিয়ে খুলে ফেললে তিনি অজ্ঞান হয়ে পড়েন। ওই সময় তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে নিয়ে যেতে চাইলে এক নম্বর আসামি নাছির উদ্দিন মুনির ও ১৪ নম্বর আসামি এনামুল হাসান ফারুকী (হেফাজতে ইসলামের আমির জুনায়েদ বাবুনগরীর খাদেম) এক ঘন্টা অ্যাম্বুলেন্স আটকে কালক্ষেপন করেন। এতে আহমদ শফি কোমায় (অচেতন অবস্থা) চলে যান।
মাদ্রাসা অবৈধভাবে গ্রাস করার জন্য পূর্ব পরিকল্পিতভাবে ষড়যন্ত্র করে আহমদ শফিকে হত্যা করা হয় বলে মামলার আরজিতে উল্লেখ করা হয়। আরজিতে আহমদ শফিকে হত্যার অভিযোগ করা হলেও যুক্ত করা হয় ৩০৪ ধারা (হত্যার উদ্দেশ্য না থাকার পরও মৃত্যু ঘটলে)।
মামলায় অভিযুক্ত এক নম্বর আসামি হেফাজতে ইসলামের যুগ্ম মহাসচিব নাছির উদ্দিন মুনির রাজনীতি সংবাদকে বলেন, ‘এই মামলা মিথ্যা, ভিত্তিহীন ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। সেদিন আমি মাদ্রাসায়ও ছিলাম না। হত্যার অভিযোগ প্রমাণের কোনো সুযোগ নেই। আল্লামা শফি সেদিন তার ছেলে আনাস মাদানীর অনিয়ম ও দুর্নীতির কথা শুনে মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়েছিলেন। আল্লামা শফিকে নির্যাতনের কোনো কথা মামলার আরজিতেও উল্লেখ নেই। হয়তো কাল্পনিক চুরির অভিযোগে আমাদেরকে অভিযুক্ত করা হতে পারে।’
আইনজীবীরা বলছেন, আহমদ শফিকে মানসিকভাবে নির্যাতন করার বিষয়টি হয়তো সাক্ষীর ভিত্তিতে তদন্তে উঠে আসতে পারে কিন্তু তিনি মানসিক চাপের কারণে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা গেছেন কিনা সেটা প্রমাণ করা কঠিন। আর পারিপার্শ্বিক বিষয়ের ওপর নির্ভর করে হত্যার অভিযোগ প্রমাণ করা অনেক কঠিন ব্যাপার।
মানসিক নির্যাতনের কারণে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে আহমদ শফির মৃত্যু হয়েছে কিনা ফরেনসিক ল্যাবে পরীক্ষার মাধ্যমে তা জানার উপায় নেই বলছেন সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকরা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বাংলাদেশের কোনো ফরেনসিক ল্যাবে মৃত ব্যক্তির পোস্টমর্টেম করে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হওয়ার পেছনে মানসিক চাপের কারণ পরীক্ষা করার কোনো যন্ত্র নেই। বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে পোস্টমর্টেমে হার্টের মানসিক চাপ পরীক্ষা করার অত্যাধুনিক যন্ত্র রয়েছে।