মিয়ানমারের রাষ্ট্রপতি উইন মিন্ট ও ক্ষমতাসীন দলের নেত্রী অং সান সু চিকে গ্রেফতার করেছে দেশটির সেনাবাহিনী। সোমবার (১ ফেব্রুয়ারি) ভোরে সেনাবাহিনীর অভিযানে তাদের গ্রেফতার করা হয়। এছাড়াও আটক করা হয়েছে শাসক দলের শীর্ষ কয়েকজন নেতাকে।
অং সান সু চি বর্মী রাজনীতিক, কূটনীতিক এবং লেখিকা। তিনি মিয়ানমারের প্রথম ও বর্তমান রাষ্ট্রীয় উপদেষ্টা এবং ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্র্যাসির নেত্রী। তিনি দেশটির ডি ফ্যাক্টো তথা অনানুষ্ঠানিক প্রধান হিসেবেই ব্যাপকভাবে পরিচিত। এছাড়াও প্রথম নারী হিসেবে সু চি মিয়ানমারের পররাষ্ট্র মন্ত্রী, রাষ্ট্রপতির কার্যালয়ের মন্ত্রী, বিদ্যুৎশক্তি ও ক্ষমতা বিষয়ক মন্ত্রী এবং শিক্ষা মন্ত্রী হিসেবে প্রেসিডেন্ট টিন চাঅয়ের কেবিনেটে কাজ করেন।
আধুনিক মায়ানমারের জাতির জনক অং সান এবং খিন চির কন্যা সু চির জন্ম হয় ব্রিটিশ বার্মার রেঙ্গুনে। তার বয়স যখন দুই, ১৯৪৮ সালে ব্রিটিশ উপনিবেশ থেকে মিয়ানমারের স্বাধীনতা অর্জনের আগ মুহূর্তে নির্মমভাবে হত্যাকাণ্ডের শিকার হন সু চির বাবা। বয়স বাড়ার সঙ্গে রাজনীতিতে পা রাখেন সু চি। ১৯৬৪ সালে দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয় ও ১৯৬৮-তে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় হতে স্নাতক অর্জন করার পর তিনি জাতিসংঘে তিন বছর কাজ করেন। ১৯৭২ সালে মাইকেল অ্যারিসকে বিয়ে করেন এবং তাদের দুই ছেলে হয়। সু চির প্রয়াত স্বামী ও সন্তানেরা বিদেশি নাগরিক হওয়ায় সংবিধান অনুসারে তিনি রাষ্ট্রপতি হতে পারবেন না। তাই তিনি নবপ্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রীয় উপদেষ্টা পদটি গ্রহণ করেন যা কিনা প্রধানমন্ত্রী বা সরকারপ্রধানের সমান।
১৯৮৮-র গণআন্দোলনের সময় সু চি সবার নজর কাড়েন এবং ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্র্যাসির (এনএলডি) সাধারণ সম্পাদক হন; সেসময় সদ্যগঠিত দলটির প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন সামরিক জান্তার বিরোধী অবসরপ্রাপ্ত কয়েকজন সেনা কর্মকর্তা।
৬০ বছরের বেশি সময় ধরে মিয়ানমারে ক্ষমতাসীন ছিল জান্তা সরকার। ১৯৮৯ থেকে ২০১০ দীর্ঘ ১৫ বছর অন্ধকার কারাগারে কাটাতে হয় অং সান সু চিকে। এরপরও ছিলেন দীর্ঘসময় গৃহবন্দি। গণতন্ত্রে লড়াই ও নীতিবান অধিকারকর্মীর জন্য গৃহবন্দি থাকা অবস্থায় নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হন অং সান সু চি।
সু চির দল ২০১০ সালের নির্বাচন বয়কট করে, যা সেনাসমর্থিত ইউনিয়ন সলিডারিটি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টিকে তাৎপর্যপূর্ণ বিজয় এনে দেয়। ২০১২ সালের উপনির্বাচনে তিনি সংসদের নিম্নকক্ষের এমপি নির্বাচিত হন এবং তার দল ৪৫টি ফাঁকা আসনের মধ্যে ৪৩টিতে জয়লাভ করে। ২০১৫ সালের নভেম্বরে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জন করে ক্ষমতায় এসে বিশ্বজুড়ে প্রশংসিত হন গণতন্ত্রের এই বাতিঘর।
কিন্তু ২০১৭ সালে মিয়ানমারে রোহিঙ্গা গণহত্যা ও নির্যাতনের কারণে দেশটির সেনাবাহিনীর পক্ষে সাফাই গাওয়ায় সু চির মুদ্রার আরেক পিঠ দেখতে সময় লাগেনি বিশ্ববাসীর। মূলত ২০১৯ সালে হেগে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে শুনানিতে সামরিক বাহিনীর অভিযানের পক্ষে অবস্থান নেওয়ায় তার জনপ্রিয়তার মোড় ঘুরে যায়। শেষ পর্যন্ত তার বিরুদ্ধে চলে যায় বিশ্ববাসী। এমনকি সু চির বিরুদ্ধে বিভিন্ন জায়গায় বিক্ষোভও হয়।
মিয়ানমারের রোহিঙ্গা গণহত্যায় দেশটির সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ তো নেননি, উল্টো সামরিক বাহিনীর কার্যকলাপে সাফাই গেয়ে বিশ্বজুড়ে সমালোচিত নেত্রী সু চি।
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের জন্য বাংলাদেশ বারবার অবগত করলে এ নিয়ে টালবাহানা করে আসছে সু চি সরকার। রোহিঙ্গা শরণার্থীদের নিজ দেশে ফিরিয়ে নিতে সু চি কোনো পদক্ষেপই নেননি।
তার এক সময়ের বিদেশি সমর্থক বা বন্ধুপ্রতিম রাষ্ট্রগুলো তার বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলে, তিনি ধর্ষণ, হত্যা এবং সম্ভাব্য গণহত্যা রুখতে কোনো পদক্ষেপ নেননি এবং ক্ষমতাধর সামরিক বাহিনীর নিন্দা কিংবা তাদের নৃশংসতার মাত্রাও স্বীকার করেননি। তার দেশের সেনাবাহিনীর বর্বর নির্যাতনের মুখে ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন।
এমন বাস্তবতার মধ্যেই ২০২০ সালের নভেম্বরের নির্বাচনে দ্বিতীয়বারের মতো নিরঙ্কুশ বিজয়লাভ করে সু চির দল ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্রেসি- এনএলডি। অপরদিকে নির্বাচনে সেনাবাহিনীর সমর্থক রাজনৈতিক দল ইউএসডিপি (ইউনিয়ন সলিডারিটি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি) ভরাডুবি হয়।সেই পরাজয় মেনে নিতে পারেনি সেনাবাহিনী।
নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন তোলে সেনাবাহিনী। শুরু থেকেই সেনাবাহিনী নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ তোলে। সর্বশেষ সোমবার সু চিসহ এনএলডির শীর্ষ নেতাদের গ্রেপ্তার করে সেনাবাহিনী। এদিন নতুন পার্লামেন্টের প্রথম অধিবেশন বসার কথা ছিল। যেই গণতন্ত্রের জন্য সু চি লড়াই করেছেন, সেই গণতন্ত্র এবং সংবিধান রক্ষার দোহাই দিয়েই তাকে ফের গ্রেপ্তার করেছে সেনাবাহিনী।
গত কয়েক দিন ধরে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে গুঞ্জনের ডালপালা মেলে, সেনাবাহিনী সু চির সঙ্গে দর-কষাকষি করছিল, জেনারেল মিন অং কে প্রেসিডেন্ট হিসেবে মেনে নিতে। কিন্তু সু চি সেই আপসে যাননি। তারই ধারাবাহিকতায় সর্বশেষ সেনা অভ্যুত্থান। সেনাবাহিনীর হাতে আটক সু চির ভবিষ্যৎ কী? এ নিয়ে প্রশ্নই থেকে যাচ্ছে।