চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন (চসিক) নির্বাচনে সাতটি ওয়ার্ডে দলের বিদ্রোহী প্রার্থীর কাছে পরাজিত হয়েছেন আওয়ামী লীগ সমর্থিত কাউন্সিলর প্রার্থীরা। গত ২৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত নির্বাচনে ৩৯টি ওয়ার্ডে ৩২টিতে আওয়ামী লীগ সমর্থিত কাউন্সিলর প্রার্থীরা বিজয়ী হন। সাতটি ওয়ার্ডে জয়ী হন বিদ্রোহী প্রার্থীরা। নির্বাচনে বিএনপি প্রার্থী থাকলেও সাতটি ওয়ার্ডে বিজয়ী বিদ্রোহী প্রার্থীদের নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থীরা। আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থীরা হেরে যাওয়ার পেছনে দলের নেতাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অভিযোগ তুলছেন। ভোটে নানা অনিয়ম এবং মহানগর কমিটির নেতৃবৃন্দের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন তারা।
নির্বাচনে ২ নম্বর জালালাবাদ ওয়ার্ডে বিদ্রোহী সাহেদ ইকবাল বাবু পরাজিত করেন আওয়ামী লীগ প্রার্থী মোহাম্মদ ইব্রাহিমকে, ৩ নম্বর পাঁচলাইশ ওয়ার্ডে বিদ্রোহী শফিকুল ইসলামের কাছে হেরে যান আওয়ামী লীগ প্রার্থী সাবেক কাউন্সিলর কফিল উদ্দিন খান , ৪ নম্বর চান্দগাঁও ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগ প্রার্থী সাবেক কাউন্সিলর সাইফুদ্দিন খালেদকে হারিয়ে জয়ী হন বিদ্রোহী এসরারুল হক, ৯ নম্বর উত্তর পাহাড়তলী ওয়ার্ডে বিদ্রোহী জহুরুল হক জসিমের কাছে পরাস্ত হন আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী নুরুল আবছার মিয়া, ২৬ নম্বর উত্তর হালিশহর ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগ সমর্থিত চার বারের কাউন্সিলর মোহাম্মদ হোসেনকে পরাজিত করেন মোহাম্মদ ইলিয়াছ, ৩১ নম্বর ফিরিঙ্গী বাজার ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগ সমর্থিত সালাহ উদ্দিনকে পরাজিত করেন বিদ্রোহী হাসান মুরাদ বিপ্লব এবং ৩৬ নম্বর গোসাইলডাঙ্গা ওয়ার্ডে চার বারের কাউন্সিলর হাজী জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীকে পরাজিত করেন নতুন মুখ বিদ্রোহী প্রার্থী মো. মোর্শেদ আলী।
ঘোষিত ফলাফলে দেখা গেছে, ২ নম্বর জালালাবাদ ওয়ার্ডে সাহেদ ইকবাল বাবু ৫ হাজার ৬৬০ ভোট আর ইব্রাহিম ৩ হাজার ৯৩১ ভোট পেয়েছেন। ৩ নম্বর পাঁচলাইশ ওয়ার্ডে শফিকুল ইসলাম ৬ হাজার ৮৯৩ আর কফিল উদ্দিন খান পেয়েছেন ৪৭৭২ ভোট। ৪ নম্বর চান্দগাঁও ওয়ার্ডে এসরারুল হক ৬ হাজার ৮৯৯ আর সাইফুদ্দিন খালেদ পেয়েছেন ৪ হাজার ৬০২ ভোট। ৯ নম্বর উত্তর পাহাড়তলী ওয়ার্ডে জহুরুল হক জসিম ৭ হাজার ৪৮০ ভোট আর নুরুল আবছার মিয়া পেয়েছে ৩ হাজার ৫৫৯ ভোট। ২৬ নম্বর উত্তর হালিশহর ওয়ার্ডে মোহাম্মদ ইলিয়াছ ৬ হাজার ৪১১ ভোট আর মোহাম্মদ হোসেন পেয়েছেন ৩ হাজার ১৯৬ ভোট। ৩১ নম্বর ফিরিঙ্গী বাজার ওয়ার্ডে হাসান মুরাদ বিপ্লব পেয়েছেন ৩ হাজার ৭৪৫ ভোট আর মো. সালাহ উদ্দিন পেয়েছেন ৩ হাজার ৩৪০ ভোট। ৩৬ নম্বর গোসাইলডাঙ্গা ওয়ার্ডে মো. মোর্শেদ আলী পেয়েছেন ৪ হাজার ২৭৬ ভোট আর হাজী জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী পেয়েছেন ৩ হাজার ৯০৮ ভোট।
ভোটে হেরে যাওয়ার কারণ জানতে চাইলে ৯ নম্বর উত্তর পাহাড়তলী ওয়ার্ডের আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী নুরুল আবছার মিয়া রাজনীতি সংবাদকে বলেন, ‘নির্বাচনে আমি হারিনি, জোর করে হারিয়ে দেওয়া হয়েছে। আমি নাকি কোটার মধ্যে পড়ি নাই। যারা কোটার মধ্যে ছিল তারা জিতেছে।’
আপনাকে কে হারিয়ে দিয়েছে ?- এ প্রশ্নের উত্তরে মহানগর আওয়ামী লীগের সদস্য ও পাহাড়তলী থানা শাখার সভাপতি নুরুল আবছার মিয়া ওই ওয়ার্ডে নির্বাচন মনিটরিং সেলের আহ্বায়কের দিকে আঙ্গুল তুলেন।
তিনি বলেন, ‘আমাকে কেন নমিনেশন দেওয়া হলো ? আওয়ামী লীগের নেতারা প্রধানমন্ত্রীকে অন্ধকারে রেখে কোটা পদ্ধতি চালু করে দলীয় প্রার্থীদের হারিয়েছেন।’
এ বিষয়ে জানতে নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দীনের মোবাইল ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করে তাকে পাওয়া যায়নি।
৯ নম্বর পাহাড়তলী ওয়ার্ডে নগর আওয়ামী লীগের নির্বাচন মনিটরিং সেলের সদস্য সচিব ও আকবর শাহ থানার সাধারণ সম্পাদক আলতাফ হোসেন রাজনীতি সংবাদকে বলেন, ‘এই ওয়ার্ডে আমাদের দলীয় প্রার্থী হেরে যাওয়াটা দুঃখজনক বিষয়। কিন্তু নির্বাচনে সমন্বয় ও জয়ের পরিকল্পনা প্রার্থীকেই করতে হয়। তিনি সেটা করতে পারেননি বলে হেরেছেন।’
৩৬ নম্বর গোসাইলডাঙ্গা ওয়ার্ডের আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী হাজী জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী তার পরাজয়ের পেছনে সিটি করপোরেশনের প্রশাসক খোরশেদ আলম সুজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলেছেন। তিনি বলেন, ‘সুজন ভাই বিদ্রোহী প্রার্থী মোর্শেদ আলীর পক্ষে নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নিয়েছেন। নির্বাচনে তাকে সাপোর্ট দিয়েছেন। ভোটের দিন নৌকার এজেন্টরা বিদ্রোহী প্রার্থীর পক্ষে ভোট আদায় করেছে।’
হাজী জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘ভোটের মাঠে তো বিদ্রোহীরা থাকার কথা ছিল না। কারা তাদের সুযোগ করে দিয়েছে ? আমি প্রধানমন্ত্রীর কাছে গিয়ে সব বলবো।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে নগর আওয়ামী লীগের সহসভাপতি খোরশেদ আলম সুজন রাজনীতি সংবাদকে বলেন, ‘আমি বিদ্রোহী প্রার্থী মোর্শেদ আলীর পক্ষে নির্বাচনে কোনো প্রচারণা চালায়নি। এটা ডাহা মিথ্যা কথা।’
২৬ নম্বর উত্তর হালিশহর ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী মোহাম্মদ হোসেন বলেন, আমি মহিউদ্দিন চৌধুরীর (প্রয়াত নগর আওয়ামী লীগের সাবেবক সভাপতি) অনুসারী ছিলাম, তাই নির্বাচনে ষড়যন্ত্র করে আমাকে হারিয়ে দেওয়া হয়েছে। আমি পেশিশক্তি ও কালো টাকার কাছে হেরেছি, জনগণের ভোটে হারিনি।
৩ নম্বর পাঁচলাইশ ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী কফিল উদ্দিন খান অভিযোগ করে বলেন, ‘ভোটের দিন পুলিশ প্রশাসন নগর আওয়ামী লীগের কোনো নেতার নির্দেশে বিদ্রোহী প্রার্থীর পক্ষে অবস্থান নিয়েছিল। ৪টা কেন্দ্র থেকে পুলিশ আমার এজেন্টদের বের করে দিয়েছে। পুলিশ রাজনৈতিক নেতাদের মতো কেন্দ্র থেকে এজেন্টদের বের করে দেওয়ার ঘটনা নজিরবিহীন।’
৩৩ নম্বর ফিরিঙ্গী বাজার ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী মো. সালাহ উদ্দিন ভোটে নানা অনিয়মের অভিযোগ তুলে ওই দিন বিকেলে নির্বাচন কমিশনে ওই ওয়ার্ডের ভোট স্থগিত রাখার আবেদন করেন বলে জানিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘বিদ্রোহী প্রার্থী কেন্দ্রে ভোটারদের আসতে বাধা দিয়েছে। কারণ ভোটাররা কেন্দ্রে আসতে পারলে তো জয় আমার হতো। কয়েকটি কেন্দ্রে ইভিএম মেশিন পর্যন্ত বন্ধ করে দিয়েছিল। জনগণ সব দেখেছে।’
৪ নম্বর চান্দগাঁও ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী সাইফুদ্দিন খালেদ বলেন, ‘এটা কি ভোট হয়েছে ? বিদ্রোহী প্রার্থী কেন্দ্র দখল করে বিজয় হয়েছে। আর আমি হেরেছি মানে প্রধানমন্ত্রী হেরেছেন। কারণ আমি প্রধানমন্ত্রীর প্রার্থী ছিলাম।’
২ নম্বর জালালাবাদ ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী মোহাম্মদ ইব্রাহিম বলেন, ‘কয়েকটি কেন্দ্র থেকে আমার এজেন্টদের বের করে দেওয়া হয়েছে। মহানগর আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকরা সরাসরি আমার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিলেন। তাদের ষড়যন্ত্রের কারণে আমি হেরেছি।’
সাত দলীয় প্রার্থীর পরাজয় প্রসঙ্গে জানতে চাইলে নগর আওয়ামী লীগের সহসভাপতি আলতাফ হোসেন বাচ্চু রাজনীতি সংবাদকে বলেন, ‘নির্বাচনে অনেক সমীকরণ ছিল। যে সাত প্রার্থী পরাজিত হয়েছে ওই ওয়ার্ডের দায়িত্বে থাকা নেতারাই সেটার ব্যাখ্যা দিতে পারবেন। সামনে কার্যনিবাহী কমিটির সভা হবে। নির্বাচনে কোনো ভুলত্রুটি হয়ে থাকলে সভায় তা উঠে আসবে।’