রাজনীতি সংবাদ প্রতিবেদন প্রকাশের সময় :২৬ জানুয়ারি, ২০২১ ৯:১৫ : অপরাহ্ণ
সারাদেশের দৃষ্টি এখন বন্দরনগরী চট্টগ্রামে। চট্টগ্রাম সিটির ‘অভিভাবক’ কে হচ্ছেন? নৌকা নাকি ধানের শীষ প্রতীকের প্রার্থী ? এ প্রশ্নের নিষ্পত্তি করতে আজ (২৭ জানুয়ারি) বুধবার অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন (চসিক) নির্বাচন। প্রায় ২০ লাখ ভোটার বেছে নেবেন তাদের ‘অভিভাবক’।
জমজমাট প্রচার-গণসংযোগ, ভোটারের দ্বারে দ্বারে প্রার্থীদের বিরামহীন ছোটাছুটি। দলের প্রার্থীর জন্য কর্মীদের দৌড়ঝাঁপ। চসিক নির্বাচন ঘিরে উৎসবে মাতেন প্রার্থী–ভোটাররা। তবে শঙ্কাও ছিল, এখনো আছে, শেষ পর্যন্ত ভোটটা সুষ্ঠুভাবে হবে তো। ভোটাররা ভোট দিতে পারবেন তো।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ৭৩৫টি ভোটকেন্দ্রের মধ্যে ৪১০টি ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করে সুষ্ঠু ভোট নিয়ে যে শঙ্কা আছে সেটার বার্তা দিয়েছে! অথচ ভোটের তিন দিন আগে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নূরুল হুদা চট্টগ্রামে এসে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে বৈঠক করে চসিক নির্বাচন সুষ্ঠু হবে বলে আশ্বাস দিয়েছেন। গতকাল চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ (সিএমপি) কমিশনার সালেহ্ মোহাম্মদ তানভীর জানিয়েছেন, চসিক নির্বাচনে পুলিশ কঠোর অবস্থানে থাকবে। তিনি বলেন, ‘আমরা ডানেও তাকাবো না, বামেও তাকাবো না; যেই আইনশৃঙ্খলার জন্য থ্রেট হয়ে দাঁড়াবে তাকে কঠোরভাবে দমন করবো’।
নির্বাচন কমিশন থেকে প্রশাসন কোনও আশ্বাসেই ভরসা নেই বিএনপির, এমনকি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ প্রার্থীদেরও। বিদ্রোহী কাউন্সিলর প্রার্থীদের কারণে ভোটের দিনে সন্ত্রাসের আশঙ্কায় ভুগছেন আওয়ামী লীগ প্রার্থীরা। অন্যদিকে ভোটকেন্দ্র দখলের আশঙ্কা করছে বিএনপি।
নির্বাচনে সহিংসতার আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার। তিনি বলেছেন, এই নির্বাচনকে ঘিরে সহিংসতার শঙ্কা ও উদ্বেগের যথেষ্ট কারণ রয়েছে।
হয়তো নির্বাচনী প্রচারণায় সংঘাত-সহিংসতা ও খুনোখুনির ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করে এ মন্তব্য করেছেন নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার ।
গত ১২ জানুয়ারি ২৮ নম্বর পাঠানটুলী ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগ কাউন্সিলর প্রার্থী নজরুল ইসলাম বাহাদুরের গণসংযোগে গুলি বর্ষণ করে বিদ্রোহী প্রার্থী আবদুল কাদেরের সমর্থকরা। এতে আজগর আলী বাবুল (৫৫) নামে এক আওয়ামী লীগ কর্মী মারা যান। এ হত্যাকান্ডের পর নির্বাচনী মাঠ উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। এছাড়া গত ১৬ জানুয়ারি ১৪ নম্বর লালখান বাজার ওয়ার্ডে নৌকার মেয়র প্রার্থীর গণসংযোগে আওয়ামী লীগ কাউন্সিলর প্রার্থী ও বিদ্রোহী প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। এতে উভয়পক্ষের ১৫ জন সমর্থক আহত হন। একই দিন নগরীর ২৫ নম্বর রামপুর ওয়ার্ডে বিএনপির মেয়র প্রার্থী ডা. শাহাদাত হোসেনের গাড়িবহরে ভাঙচুরের ঘটনাও ঘটে। এসব ঘটনার পর ভোটের মাঠে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে।
আতঙ্কের মধ্যে ভোটের ফল ঘরে তুলতে এখন নানা সমীকরণ নিয়ে ব্যস্ত প্রার্থীরা। এর আগে প্রার্থীদের টানা ১৮ দিনের প্রচারণা শেষ হয়েছে গত সোমবার মধ্যরাতে। শেষ মুহূর্তের প্রচারণায় ব্যস্ত ছিলেন আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী রেজাউল করিম চৌধুরী ও বিএনপির মেয়র প্রার্থী ডা. শাহাদাত হোসেন। কাউন্সিলর প্রার্থীরাও প্রচারে বেশ ব্যস্ত সময় পার করেছেন।
নৌকা ও ধানের শীষের ভোটযুদ্ধের অপেক্ষায় নগরবাসী। মেয়র পদে দলীয় প্রতীকে নির্বাচন হওয়ায় বাড়তি আগ্রহ সবারই। দলীয় প্রচারণায় মেয়রদের মতো পিছিয়ে ছিলেন না সাধারণ ও সংরক্ষিত ওয়ার্ডের কাউন্সিলর প্রার্থীরাও। সব প্রার্থীর প্রচারণায় উত্তপ্ত হয়ে উঠেছিল নগরীর অলিগলি।
মেয়র পদে ছয় জন প্রতিদ্বন্দ্বীতায় থাকলেও আওয়ামী লীগ-বিএনপি প্রার্থীর মধ্য থেকেই চট্টগ্রাম সিটির অভিভাবক নির্বাচিত হতে যাচ্ছেন-এমনটি মনে করছেন সাধারণ ভোটারসহ সংশ্লিষ্টরা। সকাল ৮টা থেকে ইলেক্ট্রনিক ভোটিং মেশিনের (ইভিএম) মাধ্যমে ভোটগ্রহণ শুরু হবে, যা বিরতিহীনভাবে চলবে বিকেল ৪টা পর্যন্ত।
এদিকে নির্বাচনের দুই দিন আগে স্বতন্ত্র মেয়র প্রার্থী (হাতি) খোকন চৌধুরী ভোটের মাঠ থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন। ফলে এখন মেয়র পদে আওয়ামী লীগ ও বিএনপিসহ ৬ দলের ৬ প্রার্থী ভোটযুদ্ধে অংশ নিচ্ছেন। এরা হলেন-আওয়ামী লীগের (নৌকা) এম. রেজাউল করিম চৌধুরী, বিএনপির (ধানের শীষ) ডা. শাহাদাত হোসেন, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের (হাতপাখা) মো. জান্নাতুল ইসলাম, বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্টের (মোমবাতি) এম এ মতিন, ইসলামিক ফ্রন্ট বাংলাদেশের (চেয়ার) মুহাম্মদ ওয়াহেদ মুরাদ এবং ন্যাশনাল পিপলস্ পার্টির (আম) আবুল মনজুর।
কাউন্সিলর প্রার্থী
সিটি করপোরেশনের ৪১টি ওয়ার্ডের মধ্যে কাউন্সিলর পদে ভোট হচ্ছে ৩৯টিতে। ৩১ নম্বর আলকরণ ওয়ার্ডে কাউন্সিলর প্রার্থী পদে ভোট স্থগিত করেছে নির্বাচন কমিশন। কাউন্সিলর প্রার্থী তারেক সোলেমান সেলিমের মৃত্যুতে গত ২১ জানুয়ারি এই ওয়ার্ডে শুধুমাত্র কাউন্সিলর পদে ভোট স্থগিত করে নির্বাচন কমিশন। এছাড়া ১৮ নম্বর পূর্ব বাকলিয়া ওয়ার্ডে ভোটের আগে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বীতায় নির্বাচিত হয়েছেন আওয়ামী লীগ সমর্থিত কাউন্সিলর প্রার্থী হারুন উর রশিদ।
চট্টগ্রাম আঞ্চলিক নির্বাচন কার্যালয়ের তথ্যমতে, ৩১ নম্বর আলকরণ ও ১৮ নম্বর পূর্ব বাকলিয়া ওয়ার্ড ছাড়া বাকি ৩৯টি সাধারণ ওয়ার্ডে কাউন্সিলর প্রার্থী রয়েছে ১৬৮ জন।
৩৯টি সাধারণ ওয়ার্ড ও ১৪টি সংরক্ষিত নারী ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগের মনোনীত ও বিদ্রোহী মিলে ৮৮ জন প্রার্থী রয়েছেন। ৩১টি সাধারণ ওয়ার্ডে ৬১ জন এবং ১২টি সংরক্ষিত নারী ওয়ার্ডে ১৭ জন আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী রয়েছেন। বাকি ৮টি সাধারণ ওয়ার্ড ও দুটি সংরক্ষিত নারী ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগের একক প্রার্থী রয়েছে।
বিএনপির মাত্র একটি সাধারণ ওয়ার্ড ও দুটি সংরক্ষিত নারী ওয়ার্ডে বিদ্রোহী প্রার্থী রয়েছে।
ভোট কেন্দ্র ও ভোটার সংখ্যা
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনে সাধারণ ওয়ার্ড ৪১টি ও সংরক্ষিত নারী ওয়ার্ড ১৪টি। সিটিতে ভোটকেন্দ্র ৭৩৫টি। চট্টগ্রাম আঞ্চলিক নির্বাচন কার্যালয়ের তথ্যমতে, নগরীতে ভোটার সংখ্যা ১৯ লাখ ৩৮ হাজার ৭০৪ জন। এর মধ্যে পুরুষ ভোটার ৯ লাখ ৯২ হাজার ২৬ জন এবং নারী ভোটার ৯ লাখ ৪৬ হাজার ৬৭৮ জন।
যে কেন্দ্রে ভোট দেবেন রেজাউল ও শাহাদাত
আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী রেজাউল করিম চৌধুরী ভোট দিবেন বহদ্দারহাট এখলাছুর রহমান প্রাথমিক বিদ্যালয় ভোটকেন্দ্রে। আর বিএনপির মেয়র প্রার্থী ডা. শাহাদাত হোসেন ভোট দিবেন বাকলিয়া বিএড কলেজ ভোটকেন্দ্রে।
নিরাপত্তা ব্যবস্থা
সিইসি মুখে ভোট সুষ্ঠু হওয়ার কথা বললেও সহিংসতা এড়াতে ব্যাপক প্রস্তুতি গ্রহণ করেছে নির্বাচন কমিশন। অপ্রীতিকর পরিস্থিতি মোকাবেলায় নগরীতে গত রোববার থেকে ২৫ প্লাটুন বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে। নির্বাচনের দিন মাঠে থাকবেন ২০ জন জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট। ৭৩৫টি কেন্দ্রে দায়িত্ব পালন করবেন ৮ হাজার পুলিশ সদস্য। এর মধ্যে প্রতিটি কেন্দ্রে ৬ জন পুলিশ ও ১২ জন আনসার দায়িত্ব পালন করবেন।