হেফাজতে ইসলামের সাবেক আমির শাহ আহমদ শফির মৃত্যুর ঘটনায় দায়ের করা মামলায় তাকে ‘মানসিক নির্যাতন করে পরিকল্পিতভাবে’ হত্যার অভিযোগ করা হয়েছে। কিন্তু মানসিক নির্যাতনের কারণে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে আহমদ শফির মৃত্যু হয়েছে কিনা ফরেনসিক ল্যাবে পরীক্ষার মাধ্যমে তা জানার উপায় নেই বলছেন সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকরা। আইনজীবীরা বলছেন, পারিপার্শ্বিক বিষয়ের ওপর নির্ভর করে হত্যার অভিযোগ প্রমাণ করা অনেক কঠিন ব্যাপার।
গেল বৃহস্পতিবার (১৭ ডিসেম্বর) চট্টগ্রামের জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে হাটহাজারী দারুল উলুম মাদ্রাসার সাবেক প্রধান পরিচালক আহমদ শফিকে হত্যার অভিযোগে ৩৬ জনের বিরুদ্ধে একটি মামলা দায়ের হয়েছে। আহমদ শফির শ্যালক মোহাম্মদ মহিউদ্দিন এই মামলা দায়ের করেন। ১০টি ধারায় এ মামলা দায়ের করা হয়।
মামলায় মূল আসামি করা হয়েছে হেফাজতে ইসলামের চার নম্বর যুগ্ম মহাসচিব নাছির উদ্দিন মুনিরকে। ঘটনার মূল পরিকল্পনাকারী হিসেবে অভিযুক্ত করে হেফাজতে ইসলামের দুই নম্বর যুগ্ম মহাসচিব মুহাম্মদ মামুনুল হককে ২ নম্বর আসামি করা হয়েছে। আসামিরা সবাই হেফাজতে ইসলামের আমির জুনায়েদ বাবুনগরীর সমর্থক।
পুলিশের বিশেষ ইউনিট পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনকে (পিবিআই) এক মাসের মধ্যে এই মামলার তদন্ত করে রিপোর্ট জমা দেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন আদালত।
আহমদ শফি মারা যাওয়ার প্রায় তিন মাস পর এই মামলা দায়ের করা হলো। চলতি বছরের ১৮ সেপ্টেম্বর ঢাকার একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান তিনি।
আহমদ শফির মৃত্যুর পেছনে তিনটি ঘটনার কথা উল্লেখ করে মামলার আরজিতে বলা হয়, গত ১৬ ও ১৭ সেপ্টেম্বর হাটহাজারী দারুল উলুম মাদ্রাসার ভেতরে ভাংচুর ও বিক্ষোভের ঘটনার সময় আহমদ শফিকে তার রুমে অবরুদ্ধ করে মানসিকভাবে নির্যাতন করেন আসামিরা। এতে তিনি হতভম্ব হয়ে পড়েন। ১৬ সেপ্টেম্বর মাগরিবের নামাজের পর এক নম্বর আসামি নাছির উদ্দিন মুনির ঘটনার একপর্যায়ে আহমদ শফির অক্সিজেনের লাইন টান দিয়ে খুলে ফেললে তিনি অজ্ঞান হয়ে পড়েন। ওই সময় তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে নিয়ে যেতে চাইলে এক নম্বর আসামি নাছির উদ্দিন মুনির ও ১৪ নম্বর আসামি এনামুল হাসান ফারুকী (হেফাজতে ইসলামের আমির জুনায়েদ বাবুনগরীর ব্যক্তিগত সহকারী) এক ঘন্টা অ্যাম্বুলেন্স আটকে কালক্ষেপন করেন। এতে আহমদ শফি কোমায় (অচেতন অবস্থা) চলে যান।
মাদ্রাসা অবৈধভাবে গ্রাস করার জন্য পূর্ব পরিকল্পিতভাবে ষড়যন্ত্র করে আহমদ শফিকে হত্যা করা হয় বলে মামলার আরজিতে উল্লেখ করা হয়।
মামলার আরজিতে আহমদ শফিকে হত্যার অভিযোগ করা হলেও যুক্ত করা হয় ৩০৪ ধারা (হত্যার উদ্দেশ্য না থাকার পরও মৃত্যু ঘটলে)।
জানা গেছে, ১০৪ বছর বয়সী আহমদ শফির মৃত্যু সনদে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা যাওয়ার বিষয়টি উল্লেখ করা হয়।
আইনজীবীরা বলছেন, আহমদ শফিকে মানসিকভাবে নির্যাতন করার বিষয়টি হয়তো সাক্ষীর ভিত্তিতে তদন্তে উঠে আসতে পারে কিন্তু তিনি মানসিক চাপের কারণে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা গেছেন কিনা সেটা প্রমাণ করা কঠিন বলে মনে করছেন তারা।
চট্টগ্রাম মহানগর সরকারি কৌঁসুলি (পিপি) ফখরুদ্দিন চৌধুরী রাজনীতি সংবাদকে বলেন, ‘পোস্টমর্টেম পরীক্ষার মাধ্যমে মানসিক চাপে মৃত্যুর অভিযোগ প্রমাণ করার সুযোগ নেই। পারিপার্শ্বিক বিষয়ের ওপর নির্ভর করে অপরাধ প্রমাণ করা অনেক কঠিন ব্যাপার।’
এ মামলার বাদীর আইনজীবী আবু হানিফও স্বীকার করেন মানসিক নির্যাতনের কারণেই যে তার (আহমদ শফি) হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়েছিল সেটা আদালতে প্রমাণ করতে হবে।
রাজনীতি সংবাদকে তিনি বলেন, ‘হত্যার হুমকিসহ পারিপার্শ্বিক কিছু ঘটনার মাধ্যমে হত্যার অভিযোগ প্রমাণ করা যেতে পারে। কিন্তু আদালতে মৃত্যুর কারণ প্রমাণ করতে হবে। কী কারণে মৃত্যু হলো সেটা পোস্টমর্টেম ছাড়া জানার কোনো উপায় নেই। আর এটা প্রমাণের দায়িত্ব পিবিআইয়ের।’
চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজের ফরেনসিক বিভাগের চিকিৎসকদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, মৃত ব্যক্তির পোস্টমর্টেমে হার্ট পরীক্ষা করে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হওয়ার পেছনে মানসিক চাপ ছিল কিনা তা জানার উপায় নেই।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বাংলাদেশের কোনো ফরেনসিক ল্যাবে মৃত ব্যক্তির পোস্টমর্টেম করে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হওয়ার পেছনে মানসিক চাপের কারণ পরীক্ষা করার কোনো যন্ত্র নেই। বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে পোস্টমর্টেমে হার্টের মানসিক চাপ পরীক্ষা করার অত্যাধুনিক যন্ত্র রয়েছে।
চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজের ফরেনসিক বিভাগের একজন চিকিৎসক নাম প্রকাশ না করার শর্তে রাজনীতি সংবাদকে বলেন, মৃত্যুর তিন মাস পর একজন মানুষের হার্টে পচন ধরে যায়। সেটা অত্যাধুনিক যন্ত্র দিয়ে পরীক্ষা করলেও নিখুঁত ফলাফল আসবে না। আর কোনো মানুষ বার্ধক্যজনিত কোনো রোগের কারণেও হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা যেতে পারে।
চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের আইসিইউ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক হারুনুর রশিদ জানিয়েছেন, আহমদ শফি শ্বাসকষ্ট, ডায়াবেটিস, কিডনি ও উচ্চরক্তচাপসহ বার্ধক্যজনিত নানা রোগে আক্রান্ত ছিলেন।