রাজনীতি সংবাদ ডেস্ক প্রকাশের সময় :১৬ নভেম্বর, ২০২০ ১০:২১ : পূর্বাহ্ণ
জীববৈচিত্র্য সমৃদ্ধ ভারতের মেঘালয়ের খাসিয়া, জৈন্তা পাহাড়ের পাদদেশে সারি সারি হিজল-করচ শোভিত, পাখিদের কলকাকলি মুখরিত টাঙ্গুয়ার হাওর মাছ-পাখি এবং অন্যান্য জলজ প্রাণীর এক বিশাল অভয়াশ্রম। শীত মৌসুমে ব্যাপক পরিযায়ী পাখির আগমন ও অবস্থানে মুখরিত হতো টাঙ্গুয়া। কিন্তু সে দিন আর নেই, এ যেন এখন কেবলই গল্পকাহিনী!
প্রতি বছরের মতো শীত শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে টাঙ্গুয়ার হাওরে ঝাঁকে ঝাঁকে আসতে শুরু করতো দেশি ও অতিথি পাখি। পাখির কলকাকলিতে মুখরিত হয়ে উঠতো হাওর-বিল ও তার আশপাশের এলাকাগুলো। এ সুযোগে সৌখিন ও পেশাদার পাখি শিকারিরা বিষটোপ, জাল ও বিভিন্ন ধরনের ফাঁদ পেতে পাখি নিধনে মেতে উঠে। যে কারণে দিন দিন পাখি শিকারিদের খপ্পরে অতিথি পাখির সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে কমছে। অতিথি পাখি আসা কমে যাওয়ায় আশঙ্কাজনক হারে কমছে পর্যটকের সংখ্যাও।
টাঙ্গুয়ায় জীববৈচিত্র্যের মধ্যে অন্যতম হলো বিভিন্ন জাতের পাখি। স্থানীয় জাতের পাখি ছাড়াও শীতকালে, সুদূর সাইবেরিয়াসহ অন্যান্য দেশ থেকে আগত পরিযায়ী পাখিরও আবাস এই হাওর।
প্রশাসনের নানামুখী তৎপরতায় বন্দুক দিয়ে পাখি শিকার বন্ধ হয়েছে ঠিক তবে থেমে নেই শিকারিরা! বের করা হয়েছে পাখি ধরার জন্য নানান অভিনব কৌশল। সূতা দিয়ে এক ধরণের ফাঁদ তৈরি করা ছাড়াও শিকারিরা রাতের আঁধারে হ্যাজাক লাইট দিয়ে করছে পাখি শিকার। এছাড়া পাখিদের খাবার সংকট, গাছ কেটে উজার করা, হাওরের সব জায়গায় পর্যটকদের অবাধ বিচরণ করা ও ইঞ্জিন চালিত নৌকা চলাচলের জন্য টাঙ্গুয়ার হাওরে পাখির সংখ্যা কমছে বলে মনে করেন স্থানীয়রা।
একটা সময় ছিল যখন, গাছ-মাছ-পাখি আর প্রাকৃতিক জীববৈচিত্র্যের আধার ছিল এই হাওর। ১৯৯৯ খ্রিষ্টাব্দে টাঙ্গুয়ার হাওরকে ‘পরিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা’ হিসেবে ঘোষণা ও ২০০০ খ্রিষ্টাব্দে এই হাওরকে ‘রামসার স্থান’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়। প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে স্থাপিত আন্তর্জাতিক প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ সংঘ (আইসিইউএন) এই হাওরের জীববৈচিত্র্যে রক্ষায় কাজ করছে।
তথ্য সূত্রে জানা গেছে, ২০১৯ সালের পাখিশুমারি অনুযায়ী হাওর ও এর আশপাশের এলাকায় ২০৮ প্রজাতির পাখি দেখা গেছে। পরিযায়ী পাখিদের মধ্যে বিরল প্রজাতির প্যালাসেস ঈগল, বড় আকারের গ্রে কিংস্টর্ক রয়েছে এই হাওরে। স্থানীয় জাতের মধ্যে শকুন, পানকৌড়ি, বেগুনি কালেম, ডাহুক, বালিহাঁস, গাঙচিল, বক, সারস, কাক, শঙ্খ চিল, পাতি কুট ইত্যাদি পাখির নিয়মিত বিচরণ এ টাঙ্গুয়া। বিপন্ন প্রজাতির পরিযায়ী পাখি কুড়ুল (দেশে এর নমুনা সংখ্যা ১০০টির মতো)।
২০১১-র পাখিশুমারিতে এই হাওরে চটাইন্নার বিল ও তার খাল, রোয়া বিল, লেচুয়ামারা বিল, রুপাবই বিল, হাতির গাতা বিল, বেরবেরিয়া বিল, বাইল্লার ডুবি, তেকুন্না ও আন্না বিলে প্রায় ৪৭ প্রজাতির জলচর পাখি বা ওয়াটারফাউলের মোট ২৮,৮৭৬টি পাখি গণনা করা হয়। এই শুমারিতে অন্যান্য পাখির পাশাপাশি নজরে আসে কুট, মরচেরং ভুতিহাঁস, পিয়ংহাস সাধারণ ভুতিহাঁস, পান্তামুখী বা শোভেলার, লালচে মাথা ভুতিহাঁস, লালশির, নীলশির, পাতিহাঁস, লেনজা, ডুবুরি, পানকৌড়ি ইত্যাদি পাখিও।
প্রতি বছরই টাঙ্গুয়ায় সমগ্র দেশের মধ্যে সবচেয়ে বিরল কয়েক জাতের পাখি দেখা যায়। এর মধ্যে রয়েছে বৈকাল তিলিহাঁস, বেয়ারের ভুঁতিহাস এবং কালোলেজ জৌরালি। দেশে দৃশ্যমান আটটি বেয়ারের ভুঁতিহাসের পাঁচটিই পাওয়া গেছে টাঙ্গুয়ায়। বিরল প্রজাতির পাখিদের মধ্যে আরো আছে কালোপাখা টেঙ্গি, মোটাঠুঁটি ফাটানো, ইয়ার, মেটে রাজহাঁস, মাছমুরাল, লালবুক গুরগুরি, পাতি লালপা, গেওয়াল বাটান, লম্বা আঙুল চা পাখি, বড় গুটি ঈগল, বড় খোঁপা ডুবুরি, কালো গির্দি প্রভৃতি।
স্থানীয়দের দাবি, হাওরের গভীর এলাকাকে পাখিদের অভয়াশ্রম হিসেবে চিহ্নিত করার পাশাপাশি এসব এলাকায় জন সাধারণের চলাচলে পুরোপুরি নিষেধাজ্ঞা জারি করতে হবে।
শিক্ষক মো. হাদিউজ্জামান বলেন, হাওরে গত ৪-৫ বছর ধরেই স্থানীয় জাতের পাখিসহ শীতের পরিযায়ী পাখির সংখ্যা কমতে শুরু করেছে। একটা সময় সুতা দিয়ে ফাঁদ তৈরি করে পাখি শিকার করতো, এখন রাতের আঁধারে প্রশাসনের চোখ ফাঁকি দিয়ে হ্যাজাক লাইট জ্বালিয়ে দলে দলে শিকারিরা পাখি শিকার করে থাকে। এ অবস্থা চলতে থাকলে একটা সময় বলতে হবে পরিযায়ী পাখিশূন্য টাঙ্গুয়ার হাওর।
পরিবেশ ও হাওর উন্নয়ন সমিতির সভাপতি কাসমির রেজা বলেন, টাঙ্গুয়ার হাওরে মাছ ও পাখির অভয়াশ্রম আছে। কিন্তু এগুলো নামে মাত্র অভয়াশ্রম। এসবে মানুষ অবাধে মাছ ও পাখি শিকার করছে। অথচ এসব আইনত নিষিদ্ধ। তাই টাঙ্গুয়ার হাওরকে একটি সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার আওতায় নিয়ে আসতে হবে। আইনের কঠোর বাস্তবায়ন করতে হবে। একজন ম্যাজিস্ট্র্যাট ট্যাকেরঘাটে বসে এসব মনিটরিং করতে পারবেন না। আরো লোকবল নিয়োগ করতে হবে। হাওরের মধ্যে ম্যাজিস্ট্র্যাট থাকার ব্যবস্থা করা দরকার।
সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আব্দুল আহাদ বলেন, বন্যপ্রাণী আইনে দেশি ও অতিথি পাখি এবং প্রাণী শিকার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। টাঙ্গুয়ার হাওরে অবৈধভাবে পাখি শিকার বন্ধে একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে আনসার ও পুলিশ নিয়ে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হয়। আর রাতের আঁধারে পাখি শিকারি চক্র যখন বিশাল হাওরে প্রবেশ করে, অনেক সময় প্রশাসনের পক্ষে তাদের ঠেকাতে কঠিন হয়ে পড়ে। সর্বোপরি হাওরে এ ধরনের চক্রের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক অভিযান তৎপরতা অব্যাহত রয়েছে।
খবর: সিলেট ভয়েস.কম