বঙ্গোপসাগরের আন্দামান-নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের অন্তর্গত প্রবাল প্রাচীরে ঘেরা নিষিদ্ধ ও ভয়ংকর একটি দ্বীপ নর্থ সেন্টিনেল আইল্যান্ড বা উত্তর সেন্টিনেল দ্বীপ।
এই দ্বীপটিতে বসবাসকারী অধিবাসীদের বলা হয়, সেন্টিনেলিজ এবং তারা এমন এক উপজাতি যাদের সঙ্গে সমগ্র বিশ্বের কোনো যোগাযোগ নেই। এরা হলো আধুনিক সভ্যতার শেষ যোগাযোগ বিহীন উপজাতি।
আন্দাবর-নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের রাজধানী পোর্ট ব্লেয়ার থেকে সেন্টিনেল দ্বীপের দূরত্ব প্রায় ৫০ কিলোমিটার। দ্বীপটির আয়তন ৭২ বর্গকিলোমিটার। এখন পর্যন্ত সেন্টিনেল দ্বীপের জনসংখ্যার কোনো সঠিক তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে ধারণা করা হয় সর্বাধিক ৪০০ জন বাসিন্দা রয়েছেন সেখানে।
বিশ্বের অন্যান্য যে সমস্ত উপজাতি আছে, তাদের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা সেন্টিনেলরা। এরা একে অপরের সঙ্গে যে ভাষায় কথা বলেন, তা তাদের সবচেয়ে কাছের উপজাতির পক্ষেও বোঝা অসম্ভব। মনে করা হয়, এই আদিম মানুষেরা আফ্রিকা থেকে এসেছিলেন এই দ্বীপে।
কাগজে কলমে এটির মালিকানা ভারতের। ভারতের অন্তর্ভুক্ত হলেও ভারত সরকার কখনো দ্বীপটির সার্বভৌমত্বের ওপর হস্তক্ষেপ করতে পারেনি।
এর কারণ হলো সেন্টিনেল দ্বীপে বসবাসকারী ভয়ংকর এবং হিংস্র সেন্টিনেলিজ উপজাতিদের আদিম-বর্বর জীবনযাত্রা এবং সভ্য সমাজের সঙ্গে কোনো রকম যোগাযোগ করতে না চাওয়ার মনোভাব।
কথিত রয়েছে, সেন্টিনেল দ্বীপের উপজাতির মানুষজন নরমাংসভোজী। কোনো বহিরাগত সেখানে গেলেই তাদেরকে এরা মেরে ফেলে। দ্বীপের দুর্গম প্রাকৃতিক পরিবেশের কারণে উপজাতিদের এমন হিংস্র আচরণ বলে ধারণা করা হয়।
সেন্টিনেলিজদের কাছে বাইরের জগৎ যেমন অজানা, তেমনি দ্বীপের মধ্যে বাইরের কাউকে নাক গলাতে দেয় না তারা।
হাজার হাজার বছর ধরে সেন্টিনেলিজদের বসবাস বঙ্গোপসাগরের এই দ্বীপে। দ্বীপে রয়েছে ঘন সবুজ বনভূমি, বাসিন্দাদের জন্য ছোট ছোট কুঁড়েঘর। এদের পেশা মূলত শিকার করা, মৃত পশুপাখির মাংস এবং ফলমূল তাদের খাবার।
অদ্ভুত ব্যাপার হলো, তারা আগুনের ব্যবহার জানে না, চাষাবাদ করতেও জানে না। বস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে গাছের ছাল-বাকল এবং পশুর চামড়া।
গবেষকদের ধারণা, হাজার বছর আগে সেন্টিনেলিজরা আফ্রিকা থেকে এসেছিল বঙ্গোপসাগরের এই দ্বীপে। বাইরের কোনো মানুষকে তারা তাদের দ্বীপে প্রবেশের অনুমতি দেয় না। প্রতিবারই অনুপ্রবেশকারীরা সেন্টিনেলিজদের বিষাক্ত তীরের আক্রমণের শিকার হয়েছে। অনেকের মৃত্যুও ঘটেছে।
১৮৮০ সালে ব্রিটিশ নৃতত্ত্ববিদ এম ভি পোর্টম্যান একটি দল নিয়ে সেন্টিনেল দ্বীপে গিয়ে উপজাতিদের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপন করেন। দলটি দ্বীপের দুজন বয়স্ক মানুষসহ চারজন শিশুকে নিয়ে আসে পরীক্ষা করার জন্য। তাদের নতুন পোশাক ও খাবার দেওয়া হয়, যত্ন করা হয়। কিন্তু তারা আধুনিক সমাজে মানিয়ে নিতে পারেনি। কিছুদিন পরেই অজানা রোগে আক্রান্ত হয়ে সবাই মারা যায়। এই ঘটনার পর সভ্য সমাজের মানুষদের প্রতি সেন্টিনেলিজরা আরো ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে।
১৯৬৭ সালে থেকে ভারত সরকার যোগাযোগ স্থাপনের চেষ্টা শুরু করে। ভারতীয় নৃতত্ত্ববিদ ত্রিলোকনাথ পণ্ডিতই প্রথম যিনি ১৯৯১ সালের ৪ জানুয়ারি আন্দামান-নিকোবরের এই দ্বীপে গিয়ে সেন্টিনেলদের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ যোগাযোগ স্থাপন করতে সক্ষম হন। কিন্তু সেই চেষ্টা সার্বিকভাবে সফল হয়নি বলা যায়। কারণ এই চেষ্টার পরও ওই উপজাতিরা আধুনিক মানুষকে তাদের রাজ্যে প্রবেশের অনুমতি দেননি। বারবারই তাদের আক্রমণের শিকার হতে হয়েছে আধুনিক মানুষকে। মৃত্যুও হয়েছে অনেকের।
২০০৪ সালে সুনামির পর সেন্টিনেল দ্বীপে ভারত সরকার হেলিকপ্টারে করে ত্রাণ পাঠিয়েছিলো। সেই ত্রাণ এবং সাহায্য-সহযোগিতা তারা প্রত্যাখ্যান করে এবং সাহায্যকারী দলের ওপর পাল্টা আক্রমণ চালায়।
২০০৬ সালে সেন্টিনেলিজরা বিষাক্ত তীর মেরে অনুপ্রবেশকারী দুজন জেলেকে হত্যা করে এবং সেই মরদেহগুলো উদ্ধার করতে আসা হেলিকপ্টারটিকেও তীর মেরে তারা হটিয়ে দেয়।
২০১৮ সালের ১৬ নভেম্বর মার্কিন ধর্মযাজক জন এলেন চাও বিনা অনুমতিতে নর্থ সেন্টিনেল দ্বীপে খ্রিষ্ট ধর্ম প্রচার করার উদ্দেশ্য নিয়ে প্রবেশ করেন। পরে অ্যালেন চাওকে তীর ছুড়ে হত্যা করা হয়।
সেন্টিনেলিজরা মানুষ মেরে প্রথমে কবর দেয়, কয়েকদিন পর সেই কবর থেকে মৃতদেহ বের করে সমুদ্রের তীরে ঝুলিয়ে দেয় যাতে ভয় পেয়ে বাইরের কেউ সেখানে প্রবেশ না করে।
এসব ঘটনার ফলে ভারত সরকার দ্বীপটিতে পর্যটন নিষিদ্ধসহ বহিঃবিশ্বের সঙ্গে দ্বীপটির সব ধরনের যোগাযোগ নিষিদ্ধ করে দেয়। নর্থ সেন্টিনেলের গায়ে এঁটে যায় নিষিদ্ধ দ্বীপের তকমা।
বর্তমানে সেন্টিনেলিজরা কার্যত এই দ্বীপটিতে স্বাধীনভাবে এবং সেই আদিম প্রস্তর যুগের মানুষদের মতোই জীবন যাপন করছে।
আরও পড়ুন: বিশ্বের শীর্ষ এই ধনী পরিবারের সম্পত্তির পরিমাণ জানলে চোখ কপালে উঠবে!