শনিবার, ২৩ নভেম্বর, ২০২৪ | ৮ অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ | ২০ জমাদিউল আউয়াল, ১৪৪৬

মূলপাতা রাজধানী

৮ বছর গুম থাকার লোমহর্ষক বর্ণনা দিলেন ব্রিগেডিয়ার আজমী


সেনাবাহিনীর সাবেক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আবদুল্লাহিল আমান আযমী। ছবি: সংগৃহীত

রাজনীতি সংবাদ প্রতিবেদক, ঢাকা প্রকাশের সময় :৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ ৪:০৫ : অপরাহ্ণ

দীর্ঘ আট বছর গুম থাকার পর লোমহর্ষক বর্ণনা দিয়েছেন সেনাবাহিনীর সাবেক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আবদুল্লাহিল আমান আযমী। গত ৭ আগস্ট মধ্যরাতে তিনি পরিবারের কাছে ফিরেন। তিনি জামায়াতে ইসলামীর সাবেক আমির প্রয়াত গোলাম আজমের মেজো ছেলে।

আজ মঙ্গলবার বেলা ১১টার দিকে রাজধানীর জাতীয় প্রেস ক্লাবের মিলনায়তনে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা-ডিজিএফআইয়ের ‘আয়নাঘরে’ (বন্দিশালা) ৮ বছর গুম থাকার লোমহর্ষক বর্ণনা তুলে ধরেন।

তবে তিনি সশরীরে সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত হননি, অনলাইনে ভার্চুয়ালি কথা বলেন।

২০১৬ সালের ২২ আগস্ট রাতে রাজধানীর বড় মগবাজারের বাসা থেকে সাদা পোশাকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয় দিয়ে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আবদুল্লাহিল আমান আযমীকে তুলে নেওয়া হয়।

আবদুল্লাহিল আযমী বলেন, ‘যখন আমার বাসায় তারা আসলো তখন তাদের কাছে আমি জানতে চেয়েছিলাম আপনারা কারা, পরিচয় কী, পরিচয়পত্র দেখান। তারা আমার কথার জবাব দেননি। আমি বেশ কিছু প্রশ্ন করেছি তারা কোনো কথার জবাব দেননি। এক অফিসার আমাকে তুই করে সম্বোধন করে। আমার সঙ্গে খুবই খারাপ ব্যবহার করে। এক পর্যায়ে আমাকে গ্রেপ্তার করে গাড়িতে নিয়ে চোখ বেঁধে দেয়। সে সময় আমাকে ও সেনাবাহিনীকে নিয়ে খুবই খারাপ ব্যবহার করে।’

সাবেক এই সেনা কর্মকর্তা বলেন, ‌‘আমি ফিরে এসে জানতে পারলাম, আমার পরিবারের ওপর তারা কী পরিমাণ নির্যাতন চালিয়েছে। আমার স্ত্রীর গায়ে হাত তুলতে চেয়েছিল তারা। এক পর্যায়ে আমার স্ত্রীকে তুলে নিতে চাইলে স্ত্রী আমার মাকে সঙ্গে নিতে বলে তখন তারা তাকে নেয়নি। এ সময় আমার বাড়ির যুবতী কাজের মেয়ের ওপর হাত চালিয়েছে। বাসার ম্যানেজার ও দারোয়ানসহ সবাইয়ের ওপর তারা হামলা চালায়।’

আবদুল্লাহিল আযমী বলেন, ‘আমার চোখ-মুখ বাঁধা অবস্থায় একটা জায়গায় নিয়ে গেলো। তারা আমাকে পোশাক দিলো। রাতে আমাকে খাবার দেয় কিন্তু খাওয়ার মতো অবস্থায় ছিলাম না। টয়লেট যেতে চাইলে তারা আমার চোখ-হাত বেঁধে নিয়ে যেত। প্রায় ৫০ কদম হাঁটার পর টয়লেটে যেতাম।’

সাবেক এই সেনা কর্মকর্তা বলেন, ‘৮ বছর সেখানে বন্দি থাকা অবস্থায় পৃথিবীর কোনো আলো দেখিনি, আকাশ দেখিনি, সূর্য দেখিনি। প্রতি রাতেই ক্রসফায়ারের ভয় থাকতো। বারবার মনে হতো, তারা হয়তো আমাকে ক্রসফায়ার করে হত্যা করবে। আমি রাতে তাহাজ্জুদ পড়ে আল্লাহর কাছে শুধু কান্না করতাম, আল্লাহ আমার লাশটা যেন কুকুরদের খাদ্যে পরিণত না হয়। আমার লাশটা যেন আমার পরিবারের কাছে যায়। সবসময় এ দোয়াটাই করতাম।’

আবদুল্লাহিল আযমী বলেন, ‘আমাকে যখন একটি ঘরে আবদ্ধ করা হলো তখন জিজ্ঞাস করা হয়েছিল, কেন আমি ভারতের বিরুদ্ধে লেখি। কেন ফেসবুকে ভারতের বিরুদ্ধে সোচ্চার। এতে স্পষ্টই বুঝা যাচ্ছে, তারা কেন আমাকে আয়নাঘরে আটকিয়ে রাখেন।’

‘আয়নাঘর’ থেকে যেভাবে মুক্তি পেলেন
আবদুল্লাহিল আযমী বলেন, ‘দেশে যে বিপ্লব হয়েছে সেটি আমি জানতাম না। আগস্টের ৫ তারিখে রাত সাড়ে দশটার সময় এসে আমাকে বলা হলো আপনাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া হবে। আমি বললাম, আমিতো ফজরের নামাজ পড়ে ঘুমাই যদি দুইটার দিকে আসেন তবে সুবিধা হয়। কয়েকদিন আগেই ডাক্তার দেখে গেছেন, রক্ত পরীক্ষা করলেন। এখন আবার কোথায় নিয়ে যাবেন। পরে আমাকে মুখোশ পরিয়ে আশপাশের আরেকটি রুমে নিয়ে যাওয়া হলো।’

সাবেক এই সেনা কর্মকর্তা বলেন, ‘আমি বললাম, আট বছর ধরে আপনাদের বলেছি আমার দাঁত ভেঙে গেছে, আমার কানের সমস্যা হচ্ছে। এতদিন আপনাদেরকে বলেছি আমাকে হাসপাতালে নিয়ে যান, আপনারা নিয়ে যাননি। আর এখন বলছেন হাসপাতালে যেতে হবে এটা কেমন কথা?’

আবদুল্লাহিল আযমী বলেন, ‘এরপর আমাকে নিয়ে যাচ্ছে, যাচ্ছে, তার শেষ নাই। আমি বললাম, ঢাকা শহরের কোনো হাসপাতাল তো এতো দূরে না। আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন? কেউ কোনো জবাব দিল না। রাস্তা ভাঙাচোরা। আমি জানতে চাইলাম, ঢাকা শহরের কোনো রাস্তা তো এতো ভাঙাচোরা না। আপনারা কি আমাকে কোনো গ্রামের দিকে নিয়ে যাচ্ছেন নাকি? তারা কোনো জবাব দিলো না।’

সাবেক এই সেনা কর্মকর্তা বলেন, ‘এখন আমি যেটা অনুমান করতে পারি, রাস্তায় ছাত্রজনতা যেভাবে গাড়ি চেক করছিলো এজন্য তারা আমাকে গ্রামের রাস্তা দিয়ে নিয়ে গেছেন। পরে তারা বললেন, আপনি এখানে থাকেন। আমি বললাম, আপনারা না আমাকে হাসপাতালে নিয়ে যাবেন এটা কোথায় নিয়ে আসলেন? বলা হলো, আপনাকে পরে জানানো হবে।’

আবদুল্লাহিল আযমী বলেন, ‘৬ আগস্ট আমাকে একজন জানালেন, আজ আমাকে মুক্তি দেওয়া হতে পারে। একজন বললেন আপনার কাপড়ের সাইজ বলেন। আমি বললাম, আমি তো গার্মেন্টসের কাপড় পরি না, সাইজ বলতে পারবো না। পরে একটা কাপড় নিয়ে আসা হলো। যেটা আপনারা দেখেছেন মুক্তির পরে প্যান্ট-শার্ট। ওটা পরে দেখলাম ঠিক আছে। বাইরে কি হচ্ছে সে খবরই তো নাই আমার কাছে। পরে সোয়া ৯ টার দিকে আমাকে নিয়ে তারা রওনা হলো।’

সাবেক এই সেনা কর্মকর্তা বলেন, ‘টাঙ্গাইলের এলেঙ্গা সড়কের পাশে আমাকে নিয়ে তারা ছেড়ে দিলেন। বলা হলো গাড়ি আসবে গাড়িতে উঠে আপনি চলে যাবেন। তখন রাত পৌনে বারোটা বাজে। পরে তারা আমাকে টাকা দিলো। আমি জানতে চাইলাম, ঢাকায় যাওয়ার ভাড়া কত? তারা বললেন ঠিক জানি না। জানতে চাইলাম এখানে কত টাকা আছে। তারা বললেন পাঁচ হাজার টাকা। আমি বললাম, আমি আপনাদের টাকার মুখাপেক্ষী নই। এখান থেকে ঢাকার ভাড়া যতটুকু ততটুকু টাকা দেন। তারা বললেন আপনি যা করেন করেন, দান করেন, কিছু টাকা আপনাকে নিতে হবে। তাদের সঙ্গে এক সেকেন্ড কথা বলার আমার রুচি ছিল না। এরপর তারা আমাকে নামিয়ে দিয়ে চলে গেলেন।’

আবদুল্লাহিল আযমী বলেন, ‘আমি ঠিকমতো হাঁটতে পারছিলাম না। এরপর দেখলাম একটা গাড়ি আসছে। তখন আমি ঝাঁপিয়ে পড়ে বাসের মধ্যে উঠি। কিভাবে যে আমি ১০০ মিটারের মতো রাস্তায় দৌঁড়ে বাসে উঠেছি এখনো কল্পনা করতে পারি না। পরে বাসে উঠলাম। আমার স্ত্রী এবং চাচাতো ভাইয়ের ফোন নম্বর আমার মনে ছিল। একজনের থেকে ফোন নিয়ে তাদের ফোন করে বললাম। বাস আমাকে টেকনিক্যাল মোড়ে নামিয়ে দিলো। এরপর পরিবারকে সঙ্গে নিয়ে চিকিৎসা গ্রহণ করে ৮ তারিখ ভোরে বাসায় পৌঁছালাম।’

আরও পড়ুন:

শেখ মুজিব ৩ লাখকে ৩০ লাখ বলে ঘোষণা করেছিলেন: ব্রিগেডিয়ার আযমী

‘আয়নাঘর’ নিয়ন্ত্রণ করতেন তারিক আহমেদ সিদ্দিক

গুম-খুনের ‘মাস্টারমাইন্ড’ কে এই জিয়াউল আহসান

মন্তব্য করুন
Rajniti Sangbad


আরও খবর