শনিবার, ২৩ নভেম্বর, ২০২৪ | ৮ অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ | ২০ জমাদিউল আউয়াল, ১৪৪৬

মূলপাতা জাতীয়

‘আয়নাঘর’ নিয়ন্ত্রণ করতেন তারিক আহমেদ সিদ্দিক


সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নিরাপত্তা উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব.) তারিক আহমেদ সিদ্দিক।

রাজনীতি সংবাদ ডেস্ক প্রকাশের সময় :১৯ আগস্ট, ২০২৪ ১১:৪১ : পূর্বাহ্ণ

আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর নিখোঁজ থাকার পর তিনজন ফিরে এসেছেন, যাদের দীর্ঘদিন কোনো হদিস ছিল না। এরপরই আবার আলোচনায় আসে ‘আয়নাঘর’ (গোপন বন্দিশালা)। এর আগেই এই ‘আয়নাঘর’ আলোচনায় এসেছে। কিন্তু এটা বাস্তবে আছে কি না, তা নিয়ে তখন অনেকেরই সংশয় ছিল। কিন্তু ফিরে আসা ব্যক্তিরা গণমাধ্যমে মুখ খোলার পর জানা গেল, বাস্তবে ‘আয়নাঘর’ আছে, যেখানে গুম করে রাখা হয় এবং নির্যাতন করা হয়।

নাম প্রকাশ না করে পুলিশ সদর দপ্তরের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা জানান, রাজধানীর কচুক্ষেত, উত্তরা ও মিন্টো রোডে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ইউনিটে ‘আয়নাঘর’ ছিল। ‘আয়নাঘর’ নিয়ে তারা এখন বেকায়দায় পড়েছেন। এটি নিয়ে দেশ-বিদেশে সমালোচনার ঝড় বইছে। সরকার পতনের আগপর্যন্ত এখানে কয়েকশ মানুষ আটক ছিল বলে তারা তথ্য পেয়েছেন।

আলোচিত ‘আয়নাঘর’ তৈরিতে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নিরাপত্তা উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব.) তারিক আহমেদ সিদ্দিক মুখ্য ভূমিকা পালন করেছিলেন বলে অভিযোগ উঠেছে।

ক্ষমতার পটপরিবর্তনের পর আয়নাঘরে নির্যাতনের ঘটনায় জড়িতদের শনাক্ত করতে মাঠে নেমেছেন আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যরা। এর মধ্যে পুলিশ-র‌্যাব ও ডিজিএফআইয়ের অন্তত ১৫ জন শীর্ষ কর্তার নাম এসেছে। এ তালিকা আরও বাড়তে পারে বলে পুলিশের একটি সূত্র জানিয়েছে।

এই ১৫ কর্মকর্তার মধ্যে কেউ এখনো চাকরিতে আছেন, কেউ অবসরে গেছেন। কয়েকজন আছেন দেশের বাইরে।

এর মধ্যে আয়নাঘরকান্ডে সমালোচিত ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টারের (এনটিএমসি) সাবেক মহাপরিচালক মেজর জেনারেল জিয়াউল আহসানকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এর আগে তাকে বাহিনী থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। তিনি নিজেও আট দিন আয়নাঘরে ছিলেন বলে আদালতকে জানিয়েছেন।

পুলিশের ওই সূত্রটি বলেছে, ‘আয়নাঘর’ মূলত তৈরি হয়েছে ২০০৯ সালে। তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার বিরোধী দলের নেতাদের অপহরণ করে বছরের পর বছর ধরে ‘আয়নাঘরে’ রাখতো। আবার কাউকে মেরেও ফেলা হয়েছে। এ বিষয়টি আওয়ামী লীগ সরকারের শীর্ষকর্তারা অবহিত ছিলেন। এসব কর্মকান্ড করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর শীর্ষ কর্তারা পদোন্নতি পাওয়া থেকে শুরু করে পুরস্কৃতও হয়েছেন।

সাবেক সেনা কর্মকর্তা জিয়াউল আহসানকে গত ১৫ আগস্ট রাতে গ্রেপ্তার করার পর আয়নাঘরসহ নিখোঁজ হওয়া ব্যক্তিদের বিষয়ে ব্যাপক জিজ্ঞাসবাদ করা হচ্ছে। বর্তমানে তিনি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় নিউমার্কেট এলাকায় হকার শাহজাহান হত্যা মামলায় আট দিনের রিমান্ডে আছেন। তার বিরুদ্ধে রয়েছে খুন, গুম ও অসংখ্য ব্যক্তির ফোনে আড়িপাতার অভিযোগ।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একটি সংস্থার এক কর্মকর্তা বলেন, গোয়েন্দাদের জেরার মুখে জিয়াউল আহসানও তারিক আহমেদ সিদ্দিকের নাম বলেছেন। জিয়াউল আহসান দীর্ঘদিন র‌্যাবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ২০২২ সাল থেকে এনটিএমসির মহাপরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন।

বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ভিন্নমত এবং বিরোধী রাজনৈতিক দল দমন করার জন্য গুমের মতো অপরাধ সংঘটিত হয়। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ থেকে শুরু করে ব্যবসায়িক প্রতিপক্ষ পর্যন্ত গুমের ঘটনা ঘটে। ২০২২ সালের ডিসেম্বরে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে যুক্তরাষ্ট্র র‌্যাব ও বাহিনীটির কয়েকজন কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয়।

এনটিএমসি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন হলেও এটির নিয়ন্ত্রণ ছিল তারিক আহমেদ সিদ্দিকর হাতে। জিয়াউল এনটিএমসির দায়িত্বে থাকাকালে একের পর এক কল রেকর্ড ফাঁস করেন। রাজনৈতিক ব্যক্তি থেকে শুরু করে আওয়ামী লীগ সরকারের জন্য হুমকি এমন সব ব্যক্তির স্পর্শকাতর কল রেকর্ড তার নির্দেশে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দিতেন বলে তথ্য পাওয়া গেছে বলে ওই কর্মকর্তা জানান।

তবে জিয়াউল আহসান গত শুক্রবার আদালতে রিমান্ড শুনানিতে ‘আয়নাঘরের’ সঙ্গে তার সম্পৃক্ততার কথা অস্বীকার করে নিজেকে নির্দোষ দাবি করেন। তিনি বলেন, ৭ আগস্ট তাকে তুলে নিয়ে ‘আয়নাঘরে’ রাখা হয়েছিল।

নাম প্রকাশ না করে পুলিশ সদর দপ্তরের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, ‘আয়নাঘর’ নিয়ে তারা বেকায়দায় আছেন। এটি নিয়ে দেশ-বিদেশে সমালোচনার ঝড় বইছে।

উল্লেখ্য, ২০১২ সালের ১৭ এপ্রিল বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক (সিলেট) এম ইলিয়াস আলী বনানী এলাকা থেকে নিখোঁজ হন। ২০১০ সালের ২৫ জুন নিখোঁজ হন বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য ও সাবেক কাউন্সিলর চৌধুরী আলম। তেজগাঁওয়ের ২৫ নম্বর ওয়ার্ড (সাবেক ৩৮) বিএনপির সাধারণ সম্পাদক সাজেদুল ইসলাম সুমনসহ সাতজন নিখোঁজ হন।

সংশ্লিষ্টরা জানান, ২০০৯ থেকে ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত ঢাকাসহ সারা দেশ থেকে ৭০৮ জন অপহরণের পর ‘নিখোজ’ হয়েছেন বলে মানবাধিকার সংস্থা অধিকার বলেছে। তাদের নিখোঁজের ঘটনায় র‌্যাব, পুলিশ, ডিবি, আনসার, ইন্ডাস্ট্রিয়াল পুলিশ, সিআইডি ও ডিজিএফআইসহ অন্য সংস্থা জড়িত।

গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে ভারতে চলে যাওয়ার পর অনেক স্বজনের দাবির মুখে তিনজন বন্দিকে মুক্ত করে দেওয়া হয়। এর মধ্যে রয়েছেন ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টের (ইউপিডিএফ) নেতা মাইকেল চাকমা। তিনি নিখোঁজ হয়েছিলেন ২০১৯ সালের ৯ এপ্রিল। গত ৭ আগস্ট তিনি ছাড়া পান।

এর আগে মুক্তি পেয়ে বাসায় ফেরেন সাবেক সেনা কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (বরখাস্ত) আবদুল্লাহিল আমান আযমী ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী আহমাদ বিন কাসেম (আরমান)। ২০১৬ সালের ৯ আগস্ট আহমদ বিন কাসেমকে মিরপুর ডিওএইচএস থেকে এবং ওই বছরের ২৩ আগস্ট আবদুল্লাহিল আমান আযমীকে গুম করা হয়েছিল।

‘আয়নাঘরে’ নর্থসাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ও শিক্ষাবিদ মোবাশ্বের হাসান, সাবেক রাষ্ট্রদূত মারুফ জামান, ব্যবসায়ী অনিরুদ্ধ কুমার রায়ও ছিলেন।

আরও পড়ুন: গুম-খুনের ‘মাস্টারমাইন্ড’ কে এই জিয়াউল আহসান

মন্তব্য করুন
Rajniti Sangbad


আরও খবর