মুখ খুললেন র‍্যাবের ক্রসফায়ারে নিহত একরামের স্ত্রী, বললেন ‌দুই মন্ত্রী…

ছয় বছর পর মুখ খুললেন র‍্যাবের ক্রসফায়ারে নিহত কক্সবাজারের টেকনাফ পৌরসভার সাবেক কাউন্সিলর ও টেকনাফ যুবলীগের সাবেক সভাপতি একরামুল হকের স্ত্রী আয়েশা বেগম।

তিনি বলেন,  ‘আমার স্বামী মাদক ব্যবসার সঙ্গে কখনো জড়িত ছিলেন না। তবু মাদকের সঙ্গে জড়িয়ে হত্যা করা হয়েছিল। কী অপরাধ ছিল তার? কেন এমন নৃশংসভাবে হত্যা করা হলো? আজ পর্যন্ত ভয়ে বিচার চাইতে পারিনি। দুই মন্ত্রী ফোন করে আমাকে চুপ থাকতে বলেছিলেন। তাই চুপ হয়ে বসেছিলাম।এখন ভয় কেটে গেছে। এবার মামলা করবো।’

২০১৮ সালের ২৬ মে রাতে কক্সবাজারের টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ রোডের নোয়াখালীপাড়ায় মাদকবিরোধী অভিযানে র‍্যাবের ক্রসফায়ারে নিহত হন একরাম।

ওই বছরের ৩১ মে কক্সবাজারে এক সংবাদ সম্মেলনে আয়েশা এ হত্যাকাণ্ডকে ‘ঠান্ডা মাথায় হত্যা’ উল্লেখ করে ঘটনার বিচার বিভাগীয় তদন্তের দাবি জানিয়েছিলেন।

গত বুধবার (১৪ আগস্ট) বিকেলে টেকনাফ পৌরসভার কায়ুকখালী পাড়ায় একটি দোতলা বাড়ির জরাজীর্ণ কক্ষে একটি সংবাদমাধ্যমের প্রতিনিধির সঙ্গে কথা হয় একরামের স্ত্রী আয়েশার।

কক্ষটির দেয়ালে মার্কার কলমে লেখা আছে, ‘মানুষ মানুষকে গুলি করে মারে’, ‘নির্দোষ মানুষ কেন মরে’, ‘আব্বু তুমি বাড়িতে কবে আসবা’, ‘আমাদের আব্বু হত্যার কি কোনও বিচার পাবো না?’-এমন নানা কথা। স্কুলপড়ুয়া তাহিয়াত হক ও নাহিয়ান হক তাদের বাবা একরামুল হক হত্যার বিচার চেয়ে দেয়ালে নানা প্রশ্ন লিখেছে। যা আজও নানা প্রশ্ন তৈরি করে রেখেছে।

স্বামী মারা গেছে আজ ছয় বছর দুই মাস ১৯ দিন হয়েছে উল্লেখ করে একরামের স্ত্রী বলেন, ‘এখনও বিচারের অপক্ষোয় আছি। তখন হুমকি ও ভয়ের কারণে মামলা করতে পারিনি। এখন আমার ভয় কেটে গেছে। অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হওয়ায় বিচার পাওয়ার আশায় বুক বেঁধেছি। এই সরকারের সহায়তায় আমি এবার স্বামী হত্যার মামলা করতে চাই। যাতে স্বামী হত্যার বিচার পাই।’

আয়েশা বেগম বলেন, ‘‘স্বামীকে হত্যার পর আমরা গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলায়, মামলা করতে চাওয়ায় আমাদের পরিবারকে অনেক হয়রানির মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। সদ্য বিদায়ী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করে বিচার চাওয়ার কথা বললে সাবেক সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের এবং সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল আমাকে ফোন করেছিলেন। এই দুই মন্ত্রী আমাকে গণমাধ্যমের সঙ্গে যেন কথা না বলি সেটা বলে দিয়েছিলেন। আমাকে আশ্বস্ত করে বলেছিলেন, ‘চুপ থাকেন, আমরা আপনার দাবির বিষয়টি দেখছি। কিন্তু পরে কিছুই হয়নি।’’

একরামের স্ত্রী বলেন, ‘এই হত্যাকাণ্ড দেশজুড়ে আলোচিত। শেখ হাসিনার নজরে এলেও তিনি কোনো পদক্ষেপ নেননি। এই হত্যার দায় কি তিনি এড়াতে পারেন? পারেন না। কারণ আমার স্বামী উপজেলা যুবলীগের সভাপতি ছিলেন। দলের একজন কর্মীকে এভাবে হত্যার পরও কোনো ব্যবস্থা নেননি তিনি। এমনকি মামলা পর্যন্ত করতে পারিনি আমি।’

আয়েশা বেগম বলেন, ‘হত্যাকাণ্ডে র‌্যাব জড়িত। তখন র‌্যাব ও ডিজিএফআইয়ের দায়িত্বরত কর্মকর্তা যারা ছিলেন, তাদের আইনের আওতায় আনা গেলে এই হত্যার রহস্য বেরিয়ে আসবে। ইতোমধ্যে আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি, দেশের পরিস্থিতি আরেকটু স্বাভাবিক হলে হত্যা মামলা করবো। বর্তমানে দুই মেয়েকে নিয়ে খুব কষ্টে দিন পার করছি। বৃষ্টি হলে এই ঘরে পানি পড়ে। ঘুমানো কষ্টকর। তবু কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই আমাদের।’

স্বামীর স্মৃতিচারণ করে অশ্রুভেজা চোখে আয়েশা বেগম বলেন, ‘হত্যার পর ঘটনাস্থলে পাওয়া স্বামীর চশমাটি একজন বৃদ্ধ লোক এসে একদিন বাসায় দিয়ে গেছেন। সেই চশমায় এখনও রক্তের দাগ লেগে আছে। এর চেয়ে বেদনার কী হতে পারে। প্রতিদিন স্বামীসহ আমরা চার জন একসঙ্গে খেতে বসতাম। কিন্তু এখন খাওয়ার সময় তার কথা খুব মনে পড়ে খুব। তার পছন্দের খাবারগুলো রান্না করলে তাকে মনে পড়ে। এমনকি মেয়েরা তাদের বাবার পছন্দের কোনো খাবার রান্না করলে কান্না করে, কষ্ট পায়। কষ্ট নিয়ে বেঁচে আছি আমরা।’

একরামের স্বজনরা জানান, হত্যাকাণ্ডের দুই দিন আগে টেকনাফে গুজব ছড়িয়েছিল, একরামুল ক্রসফায়ারে নিহত হয়েছেন। ঘটনার দিন একটি গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন অনবরত একরামুলকে বিরক্ত করছিলেন। বারবার বলছিলেন, একরামুল যেন তাদের একখণ্ড জমি কেনায় সহযোগিতা করেন। তাদের চাপাচাপিতেই একরামুল বাধ্য হয়ে বাসা থেকে বের হন। জমির বিষয়টা ছিল অজুহাত।

শেষ কথোপকথনে যা ছিল

হত্যাকাণ্ড ঘটার সময় মেয়েদের সঙ্গে একরামুল হকের কথোপকথন শোনা যায় ফোনে থেকে যাওয়া রেকর্ডে। একরামের প্যান্টের পকেটে থাকা ফোনে মেয়ে ফোন করলে চাপ পড়ে রিসিভ হয়ে যায়। একরামের স্ত্রী আয়েশা বেগমের মুঠোফোনে রেকর্ড হয়ে যায় গুলির শব্দ, শোরগোল। এই অডিও ভাইরাল হলে ঘটনাটি দেশজুড়ে আলোচনায় আসে তখন।

একরাম যে কথিত ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হন, তার পাঁচ দিন পর আয়েশা কক্সবাজারে সংবাদ সম্মেলন করে একরামের সঙ্গে তার ও মেয়েদের শেষ কথোপকথনের অডিও রেকর্ড প্রকাশ করেন। এর একটি অংশ ছিল এ রকম:

মেয়ে: হ্যালো আব্বু!

একরাম: জি আম্মু। আম্মু আমি হ্নীলা যাচ্ছি।

মেয়ে: কেন?

একরাম: জরুরি কাজে যাচ্ছি। …মেয়ে আবার জিজ্ঞাসা করে, কেন?

একরাম: যাচ্ছি আম্মু…(কান্নার স্বরে কথা)।

মেয়ে: যাচ্ছ; তুমি কান্না করতেছ যে…?

এর কিছুক্ষণ পর গুলির শব্দ ও গোঙানির আওয়াজ শোনা যায়।

এই অডিও অনলাইনে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। বাবা-মেয়ের শেষ কথোপকথন শুনে এবং একরাম নিহত হওয়ার খবরটি জেনে মানুষ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করে। শুরু হয় সমালোচনা।

আরও পড়ুন: ৮ দিনের রিমান্ডে সাবেক সেনা কর্মকর্তা জিয়াউল আহসান