শনিবার, ২৩ নভেম্বর, ২০২৪ | ৮ অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ | ২০ জমাদিউল আউয়াল, ১৪৪৬

মূলপাতা দেশজুড়ে

‘ডিবির হারুন এসে বলেন, একে বাঁচিয়ে রাখছো কেন? ক্রসফায়ারে দে’


ডিবি পুলিশের হেফাজতে ভয়াবহ নির্যাতনের বর্ণনা দিলেন সমন্বয়ক নূর নবী (চেয়ারে বসা বাঁ থেকে দ্বিতীয় কালো শার্ট পরিহিত হাতে ব্যান্ডেজ)। ছবি: সংগৃহীত

রাজনীতি সংবাদ ডেস্ক প্রকাশের সময় :৯ আগস্ট, ২০২৪ ১০:৪৭ : অপরাহ্ণ

‘‘উলঙ্গ অবস্থায় আমাকে ডিবির রুমে নিয়ে চোখ খুলে দেওয়া হয়। বিকেল সাড়ে ৪টায় ডিবির হারুন এসে বলেন, ‘একে বাঁচিয়ে রাখছো কেন? একে ক্রসফায়ার দে।’ এরপর ডিবির লালবাগ শাখা আমাকে ধরে নিয়ে যায়। আমার দুই হাঁটু পিটিয়ে ওরা ভেঙে ফেলে। ওই হাঁটুর ওপর তারা আমাকে বসায়ে রাখে। আমি ভাবছি আমাকে মেরেই ফেলবে। তারা আমার মাথায় বন্দুক তাক করে বলে, ‘একে মেরেই ফেলবো।’’

কথাগুলো বলছিলেন কোটা সংস্কার আন্দোলনে আটক হওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় (জবি) শাখার সমন্বয়ক নূর নবী।

জামিনে মুক্ত হয়ে আজ শুক্রবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের সামনে সাংবাদিকদের কাছে নির্যাতনের বর্ণনা দেন তিনি।

নূর নবী বলেন, ‘আমাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের গেট থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছয় দফা দাবি নিয়ে এসেছিলাম। এডিসি বদরুল আমাকে ডেকে আলাদা করেন। ডিবির পাঁচটা গাড়ি এসেছিল। তারা শুধু আমাকে এখান থেকে উঠিয়ে মিন্টো রোডের ডিবি কার্যালয়ে নিয়ে যায়। গাড়িতে উঠিয়েই আমাকে মার শুরু করে। যখন আমাকে ডিবি অফিসে নেওয়া হয়, তখন ভেবেছিলাম গাড়িতে যে টর্চার করা হয়েছে এর চেয়ে বেশি টর্চার আর হতে পারে না। কিন্তু এর চেয়ে পাশবিক নির্যাতন যে তারা করতে পারে-তা আমার কল্পনায় ছিল না!’

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের জবি শাখার এই সমন্বয়ক বলেন, ‘ডিবিতে নেওয়ার পর আমাকে প্রস্রাব করতে বলে। প্রস্রাব করতেই বৈদ্যুতিক শক খেয়েছি আমি। দাঁড়ানো অবস্থা থেকে আমি পড়ে গেছি। হাতে একটা ইনজেকশন দিয়েছে আমার। ওরা আমার অণ্ডকোষে জোরে জোরে আঘাত করেছে। বারবার আমার মনে হচ্ছিল, আমি মরে যাচ্ছি না কেন! তারা বারবার আমার কাছে সমন্বয়কদের নাম জানতে চাচ্ছিল। তারা আমার কাছ থেকে বিএনসিসির কার্ড পায়। পরে নিজেদের মধ্যে বলে, “সে এতো শক্ত কেন? এ জঙ্গি, জঙ্গি ট্রেনিং নিয়েছে।” আমি এটা বলতে পারিনি যে, ‘‘আমি সেনা মহড়ায় অংশ নিয়েছি, আমি অন্তত জঙ্গি হতে পারি না।”

নির্যাতনের বর্ণনা দিয়ে নূর নবী আরও বলেন, ‘তারা আমাকে ডিবি কার্যালয়ে নিয়ে একটি চেয়ারে বসিয়ে আমার সব কাপড়চোপড় খুলে ফেলে। সেই চেয়ারে বসিয়ে গালি দিচ্ছিল। তখন পাশের অন্যদের কথা শুনে বুঝতে পারি যে ডিসি আসছে। তখন আমাকে চেয়ার থেকে উঠিয়ে নিচে শোয়ায়। চিৎ করে শুইয়ে আমাকে বলে, ‘‘তোর এক হাত তো ছাত্রলীগ ভেঙেছে, আরেক হাত আমরা ভেঙে দেব।” রুটি যেভাবে বেলে, ঠিক সেভাবে আমার হাঁটু থেকে নাভি পর্যন্ত লাঠি দিয়ে চাপ দেয়। আমাকে কান্না করতে পর্যন্ত দেয়নি। আমি ভাবছিলাম যে এরা মানুষ না। মেরে মেরে আমাকে বারবার বলছিল, ‘‘তোর তথ্য আমরা অনেক দিন শুনেছি, ক্যাম্পাস থেকে কয়েকজন তোর কথা আগেই বলেছে। তুই জঙ্গি, তুই শিবির।” ভেবেছিলাম আমার পায়ের অংশ পচে যাবে বা কেটে ফেলতে হবে!”’

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের জবি শাখার এই সমন্বয়ক বলেন, ‘ওরা আমাকে ১৫ তারিখ (জুলাই) থেকে ট্র্যাক করছিল। আমি আমার মায়ের কাছ থেকে ১৭ তারিখ বিদায় নিয়েছিলাম। বলেছিলাম, আমি মরে গেলে কেঁদো না। আর বেঁচে থাকলে বিকেলে ফোন দেব। এই ভয়েস রেকর্ডটা তাঁরা শুনিয়ে শুনিয়ে মেরেছে।’

কারাগারে নির্মম অত্যাচারের কথা বর্ণনা করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের জবি শাখার এই সমন্বয়ক বলেন, ‘কারাগারে আমি অনেক গার্ডকে কান্না করে বলেছি, আমাকে হাসপাতালে নেন। আমাকে নেয়নি। আমি এক প্যান্টে আট দিন পড়ে ছিলাম। আমাকে পরিবারের সঙ্গে দেখা করতে দেয়নি। আমাকে আমদানিতে (কারাগারের আমদানি কক্ষ) পাঠায় দিছে। আমি একদিক হয়েও শুয়ে থাকতে পারতাম না। আমি অনেক চেষ্টা করেছি ডাক্তারের কাছে যাওয়ার, পারি নাই। শেষে ২৭ তারিখে আমাকে এমসিতে নেওয়া হয়। ডাক্তার দেখে বলে ওকে ইমার্জেন্সি হাসপাতালে নিতে হবে। ঢাকা মেডিকেল বা পঙ্গুতে রেফার করে। তবুও আমাকে হাসপাতালে নেওয়া হয়নি।’

নূর নবী বলেন, ‘কারাগারে যখন অন্য ছাত্ররা জানতে পারে, আমি সমন্বয়ক। তখন তারা আমার সঙ্গে দেখা করতে আসে। আমি একটু সাহস পাই। পানিতে মরিচ দিয়ে রাখা হতো, যেন পানি খেতে না পারি, গোসল করতে না পারি। স্যারেরা যখন দেখা করতে আসেন, তখন আমাকে একপর্যায়ে বলা হয়, আমাকে টাওয়ারে আলাদা এক ঘরে পাঠিয়ে দেওয়া হবে। তখন আমি সবাইকে আমার কাছে আসতে বারণ করি। আমি নিজেকে একঘরে করে রাখি।’

সাজানো মামলা দেওয়ার ঘটনা বর্ণনায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের জবি শাখার এই সমন্বয়ক বলেন, ‘‘তারা আমাকে বলে, ‘‘তোকে ক্রসফায়ার দেব। তুই রেডি হয়ে নে।” আমরা ছয়জন ছিলাম মোট। রমনায় নিয়ে আমাদের চোখ খুলে দেওয়া হলো। আমার হাতে পেট্রলবোমা ধরায়ে দিল। ভিডিও করা শুরু করল। তারা যে মামলা সাজাবে আমি ভাবতেও পারিনি। দেশের ডিটেকটিভ ব্রাঞ্চ এমন পর্যায়ে যাবে ভাবিনি। ডিটেকটিভ ব্রাঞ্চ দেশের মানুষের আস্থার জায়গা হওয়া উচিত ছিল। যা–ই হোক, তারা আমাকে মেরে ফেলেনি। আমি বেঁচে ফিরেছি। স্বাধীন দেশে আবার ফিরতে পেরেছি। এটা আমাদের দ্বিতীয় স্বাধীনতা।’’

নূর নবী বলেন, ‘আমার হাত ভেঙে গেছিল। হাড় ভেঙে টুকরা–টুকরা হয়ে গিয়েছিল। কোনো রকম এক্স–রে ছাড়াই খুব বাজেভাবে অপারেশন করা হয়েছিল।’

আরও পড়ুন: সাবেক ডিবিপ্রধান হারুন এখন কোথায়?

মন্তব্য করুন
Rajniti Sangbad


আরও খবর