রাজনীতি সংবাদ প্রতিবেদক, চট্টগ্রাম প্রকাশের সময় :১৭ জুলাই, ২০২৪ ১১:২৮ : পূর্বাহ্ণ
চট্টগ্রাম নগরীর মুরাদপুরে গতকাল মঙ্গলবার (১৬ জুলাই) কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের সঙ্গে যুবলীগ ও ছাত্রলীগ কর্মীদের কয়েক ঘণ্টাব্যাপী সংঘর্ষে অস্ত্র হাতে চার ব্যক্তিকে গুলি ছুড়তে দেখা যায়। এতে তিনজন নিহত হন। আহত হন অন্তত ৩০ জন। গুলি করা সেই চার অস্ত্রধারী ব্যক্তির পরিচয় পাওয়া গেছে।
এদের একজন মো. ফিরোজ আলম, তিনি মুরাদপুরে যুবলীগ নেতা হিসেবে নিজেকে পরিচয় দেন।। অন্যজন মো. দেলোয়ার স্বেচ্ছাসেবক লীগের নেতা হিসেবে পরিচিত। হেলমেট পরা ফিরোজ রিভলবার নিয়ে এবং দেলোয়ার শটগান নিয়ে গুলি করেন। বাকি দুজনের নাম মিঠু ও জাফর। যুবলীগের নেতা হিসেবে পরিচিত এ দুজনকে রিভলবার নিয়ে গুলি করতে দেখা গেছে।
পুলিশের একটি সূত্র জানিয়েছে, সংঘর্ষের সময় এই চারজনের গুলিতে তিনজন গুলিবিদ্ধ হন। তারা তিনজনই মারা গেছেন।
নিহত তিনজনের মধ্যে ওয়াসিম আকরাম চট্টগ্রাম কলেজ ছাত্রদলের যুগ্ম আহ্বায়ক। তিনি কক্সবাজারের পেকুয়া উপজেলার মেহেরনামা এলাকার সবুর আলমের ছেলে। অপরজন ফারুক, তিনি পথচারী ছিলেন। ফারুকের বাড়ি কুমিল্লায়। তিনি ফার্নিচারের দোকানে চাকরি করতেন। সন্ধ্যায় মৃত ঘোষণা করা আরেকজন চট্টগ্রাম নগরের ওমরগণি এমইএস কলেজের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী মো. ফয়সাল আহমেদ শান্ত।
আরও পড়ুন: চট্টগ্রামে যুবলীগ-ছাত্রলীগের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষে নিহত ৩
গতকাল দুপুর ২টা থেকে ষোলোশহর স্টেশনে অবস্থান নেন যুবলীগ ও ছাত্রলীগের কর্মীরা। অন্যদিকে মুরাদপুরে অবস্থান নেন কোটাবিরোধী শিক্ষার্থীরা। বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে দুই নম্বর গেট থেকে একটি মিছিল যায় মুরাদপুরের দিকে। কোটাবিরোধী শিক্ষার্থীরা তাদের ধাওয়া দিলে পিছু হটেন তারা।
এরপর দ্বিতীয় দফায় দুই নম্বর গেট থেকে আসা যুবলীগ ও ছাত্রলীগের একটি মিছিল থেকে আন্দোলনকারীদের আবার ধাওয়া দেওয়া হয়। প্রত্যক্ষদর্শী কয়েকজন এবং সেখানে থাকা সাংবাদিকরা জানান, মুরাদপুর সাদিয়া কিচেন রেস্টুরেন্টের পাশ থেকে এ সময় যুবলীগ ও ছাত্রলীগের কয়েকজন গুলি ছুড়তে ছুড়তে আন্দোলনকারীদের ধাওয়া দেন এবং বিস্ফোরণ ঘটানো হয় ককটেলের।
এ সময় মিছিল থেকে গুলি করতে দেখা যায় যুবলীগ নেতা ফিরোজকে। একপর্যায়ে গুলি থামিয়ে তাঁকে বলতে শোনা যায়, ‘গুলি দে, গুলি দে’। কিছুক্ষণ পর একজন গুলি এনে দেন তাকে। গুলি ভরে আবারও শিক্ষার্থীদের লক্ষ্য করে গুলি ছোড়েন ওই যুবক।
এ বিষয়ে ফিরোজ আলম একটি সংবাদমাধ্যমের কাছে শিক্ষার্থীদের মিছিলে গুলি করার কথা অস্বীকার করেন। তিনি বলেন, ‘রিভলবার হাতে ওই ব্যক্তি আমি না।’
তবে যুবলীগের বেশ কয়েকজন নেতাকর্মী জানিয়েছেন, রিভলবার হাতে ওই ব্যক্তি ফিরোজই।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, যুবলীগের ফিরোজ একসময় শিবিরের ক্যাডার ছিলেন। মুরাদপুরের ত্রাস হিসেবে পরিচিত তিনি। তার বিরুদ্ধে থানায় একাধিক হত্যা মামলা রয়েছে।
২০১৫ সালের ডিসেম্বরে নগরীতে বিলবোর্ড টাঙিয়ে আলোচনায় আসেন ফিরোজ। ওইসময় যুবলীগের মিছিল–সমাবেশে সামনের সারিতে দেখা যেতো তাকে। ২০১১ এবং ২০১৩ সালে তিনি অস্ত্রসহ দুবার পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হন।
পুলিশ জানায়, ২০১১ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি রাতে নগরের প্রবর্তক মোড়ে একটি রোগ নির্ণয়কেন্দ্র থেকে সন্ত্রাসীরা ১১ লাখ টাকা লুট করে নেয়, মারধর করা হয় একজন চিকিৎসককে। ডাকাতি ঘটনার পরদিন নগরের বায়েজিদ থানার কয়লাঘর এলাকা থেকে ফিরোজ ও মনিরুজ্জামানকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এরপর ২০১৩ সালের ১৯ জুলাই অস্ত্রসহ ফিরোজকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তখন ফিরোজের পাঁচলাইশের আস্তানা থেকে ১২ রাউন্ড গুলিভর্তি দুটি বিদেশি পিস্তল, তিনটি গুলিসহ একটি ম্যাগাজিন, একটি একনলা বন্দুক, একটি বন্দুকের ব্যারেল, তিনটি কার্তুজ, দুটি চাপাতি উদ্ধার করা হয়।
সর্বশেষ চট্টগ্রামের আলোচিত স্কুলছাত্রী তাসফিয়া আমিন হত্যা মামলার অন্যতম আসামি ছিলেন এই যুবলীগ নেতা।
এদিকে আরেক অস্ত্রধারী স্বেচ্ছাসেবক লীগের নেতা হিসেবে পরিচিত দেলোয়ার ২০১৬ সালের ১৯ জুন চট্টগ্রাম কলেজ সড়কে ছাত্রলীগের দুপক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ চলাকালে গুলি ছুড়েছিলেন।
যুবলীগ নেতার গাড়িতে করে ‘অস্ত্র’ আনার অভিযোগ
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক বেসরকারি টেলিভিশনের প্রতিবেদক একটি সংবাদমাধ্যমকে বলেছেন, দ্বিতীয় দফায় দুই নম্বর গেট থেকে আসা মিছিল থেকে যুবলীগ ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা যখন শিক্ষার্থীদের ধাওয়া দেয়, তখন একটি সাদা রঙের প্রাইভেটকার তাদের পিছনে ছিলো। অস্ত্রধারীরা হেলমেট পরে গুলি ছুড়তে ছুড়তে সামনের দিকে যাচ্ছিলেন। এ সময় সেই সাদা রঙের প্রাইভেটকার থেকে কয়েকটি ব্যাগ নামানো হয়।
একটি ভিডিও ফুটেজে দেখা গেছে, গুলি ছোড়া ঘটনার সময় গাড়িটির অবস্থান ছিলো যুবলীগ-ছাত্রলীগ কর্মীদের শেষ ভাগে। এই সময় শর্টগান হাতে একজনকে দেখা গেছে। এ ছাড়া, যুবলীগের নেতাকর্মীরা গাড়ির পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন। এরপর সেই ব্যাগগুলো কাঁধে নেন বেশ কয়েকজন। এরপর গাড়িটি চলে যায়।
জানা গেছে, গাড়িটির রেজিস্ট্রেশন নম্বর ‘চট্ট মেট্রো-গ ১৪-৩২২১’। গাড়িটি যুবলীগ নেতা হিসেবে পরিচিত গাজী জাফর উল্লাহর। ২০১৩ সালের ২৪ জুন সিআরবিতে জোড়া খুনের ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলার অভিযোগপত্রে ৬৪ নম্বর আসামি হেলাল আকবর চৌধুরী বাবরের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত তিনি।
গাড়িটি জাফর উল্লাহর প্রতিষ্ঠান ‘এসএনবি ট্রেড করপোরেশন’র নামে রেজিস্ট্রেশন করা।
নগর যুবলীগের একাধিক সূত্রে জানা যায়, জাফর উল্লাহ নিরাপত্তা বাহিনীর কাজের ঠিকাদারি করেন। তিনি চট্টগ্রাম ওমরগণি এমইএস কলেজের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে মঙ্গলবার রাতে জাফর উল্লাহ একটি সংবাদমাধ্যমকে বলেন, ‘গাড়িটি আমার। আজকে দলের ছেলেরা আমার গাড়িটি ব্যবহার করার জন্য দুইবার নিয়ে গিয়েছিল। একবার সকালে, আরেকবার দুপুরে। তারা কী কাজে নিয়েছে সেটা জানি না।’
সংঘর্ষের সময় অস্ত্রধারীদের পাশে একাধিক ব্যাগ নামানোর বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমার ড্রাইভার এ বিষয়ে কিছু জানায়নি। ওই সময় আমি ব্যবসার কাজে বাইরে ছিলাম।’
প্রসঙ্গেত, ২০১৬ সালের ১৯ জুন চট্টগ্রাম কলেজ সড়কে ছাত্রলীগের দুপক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ চলাকালে গোলাগুলিতে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন সন্ত্রাসী জাফর উল্লাহ। সেদিন তার নির্দেশে প্রকাশ্যে পিস্তল নিয়ে গুলি ছুঁড়তে দেখা গেছে তার সহযোগী দেলোয়ারকে।
ওই সংঘর্ষের ঘটনায় জাফর উল্লাহকে প্রধান আসামি করে চকবাজার থানায় মামলা করেছিলেন চট্টগ্রাম কলেজের আনোয়ার হোসেন নামের এক ছাত্রলীগ নেতা।
পুলিশ সূত্র জানায়, জাফর উল্লাহ ১৯৯৬ সালে আজাদ আলী খান হত্যা মামলার আসামি ছিলেন।
আরও পড়ুন: মহসিন কলেজে সন্ত্রাসী জাফরের ‘শোডাউন’, কক্ষে ‘ডেকে নিয়ে’ পিঠা খাওয়ালেন শিক্ষক!