শনিবার, ২৩ নভেম্বর, ২০২৪ | ৮ অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ | ২০ জমাদিউল আউয়াল, ১৪৪৬

মূলপাতা চট্ট-মেট্টো

চট্টগ্রাম চেম্বারে এমপি লতিফের পরিবারতন্ত্রের জালে সৈয়দ নজরুল



রাজনীতি সংবাদ প্রতিবেদক, চট্টগ্রাম প্রকাশের সময় :২৪ মে, ২০২৪ ৭:১০ : অপরাহ্ণ

শতবর্ষের ঐতিহ্যবাহী বাণিজ্য সংগঠন চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্সে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য (এমপি) এম এ লতিফের পরিবারতন্ত্রের জাল আরও বিস্তৃত হয়েছে। তিনি ওয়েল গ্রুপের পরিচালক ও বিজিএমইএর প্রথম সহসভাপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামকে স্বজনপ্রীতি করে চট্টগ্রাম চেম্বারের পরিচালক পদে বসিয়েছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

গত ২১ মে চট্টগ্রাম চেম্বারের বোর্ড সভায় একজন পরিচালকের শূন্য পদে সৈয়দ নজরুল ইসলামকে মনোনীত করা হয়েছে।

সৈয়দ নজরুল ইসলাম চট্টগ্রাম-৮ আসনের (বোয়ালখালী-চান্দগাঁও) সংসদ সদস্য ও সিডিএর সাবেক চেয়ারম্যান আবদুচ ছালামের ছোট ভাই।

গত বছরের ৭ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রাম চেম্বারের নতুন পরিচালনা পর্ষদ দায়িত্ব গ্রহণ করে। নতুন কমিটি দায়িত্ব নেওয়ার এক সপ্তাহের মাথায় ১৩ সেপ্টেম্বর পরিচালক পদ থেকে পদত্যাগ করেন তরুণ শিল্পপতি সৈয়দ মোহাম্মদ তানভীর। তিনি প্যাসিফিক জিন্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক।

জানা গেছে, চট্টগ্রাম চেম্বার পরিবারতন্ত্র হয়ে উঠায় প্রতিবাদ হিসেবেই সৈয়দ তানভীর পদত্যাগ করেন। তার পদত্যাগের পর ব্যবসায়ী মহলে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। চট্টগ্রাম চেম্বারের ১১৭ বছরের ইতিহাসে নেতৃত্ব নিয়ে অনাস্থা প্রস্তাব, প্রকাশ্য বিরোধ থাকলেও কেউ পদত্যাগ করেননি।

৮ মাস পর সৈয়দ তানভীরের শূন্য পরিচালক পদে সৈয়দ নজরুলকে মনোনীত করেছে চট্টগ্রাম চেম্বার।

গত ২১ মে চট্টগ্রাম চেম্বারের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, বোর্ড সভায় সৈয়দ নজরুল ইসলামের নাম প্রস্তাব করা হলে সকলের সম্মতিক্রমে শূন্য পরিচালক পদে তাকে মনোনীত করা হয়।

কিন্তু চট্টগ্রাম চেম্বারের সিনিয়র সহসভাপতি তরফদার মো. রুহুল আমিন রাজনীতি সংবাদকে জানিয়েছেন, সৈয়দ নজরুল ইসলামকে পরিচালক পদে মনোনীত করার বিষয়টি তিনি জানেনই না!

গতকাল বৃহস্পতিবার তরফদার রুহুল আমিন রাজনীতি সংবাদকে বলেন, ‘আমি বোর্ড সভায় ছিলাম না। কাকে পরিচালক করা হয়েছে সেটা আমি শুনিনি।’

অভিযোগ পাওয়া গেছে, সৈয়দ নজরুল ইসলামকে চেম্বারের পরিচালক করার পেছনে চট্টগ্রাম-১১ আসনের (বন্দর-পতেঙ্গা) এমপি এম এ লতিফের ভূমিকা ছিল। মাস খানেক আগে এমপি লতিফের বড় সম্বন্ধীর (স্ত্রীর বড় ভাই) মেয়েকে বিয়ে করেছেন সৈয়দ নজরুল। এ কারণে এমপি লতিফ স্বজনপ্রীতি করে তাকে চেম্বারের পরিচালক পদে বসিয়েছেন।

এ বিষয়ে জানতে চট্টগ্রাম চেম্বারের সভাপতি ওমর হাজ্জাজের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে তাকে পাওয়া যায়নি।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে সৈয়দ নজরুল ইসলাম রাজনীতি সংবাদকে প্রথমে বলেন, ‘পরিচালক পদটা উনারা আমাকে দিয়েছেন। আমি যেহেতু জাতীয়ভাবে ট্রেড পলিটিক্সের নেতৃত্ব দিচ্ছি, তাই চট্টগ্রাম চেম্বার হয়তো মনে করছে, আমার মতো হাই প্রোফাইল লোক থাকলে তাদের জন্য ভালো হবে।’

ব্যবসায়ীদের অনেকে বলছেন, আপনি এমপি লতিফ সাহেবের সম্বন্ধীর মেয়েকে বিয়ে করার কারণে আপনাকে চেম্বারের পরিচালক করা হয়েছে। বিষয়টা আপনি কীভাবে দেখছেন?

এ প্রশ্নের জবাবে সৈয়দ নজরুল ইসলাম বলেন, ‘আত্মীয়তার কারণে নয়, যোগ্যতা বিবেচনায় আমাকে এই পদ দেওয়া হয়েছে। এটা হুট করে হয়নি। গত ৫-৬ বছর ধরে আমি চেম্বারের পরিচালক হওয়ার জন্য চেষ্টা করেছি। কিন্তু বয়স কম হওয়ার কারণে হতে পারিনি। হয়তো অনেকে বলতে পারেন, এখন আত্মীয়তার কারণে এটা দ্রুত হয়ে গেছে। কিন্তু এটা আমার দীর্ঘদিনের আগ্রহের কারণে হয়েছে।’

আপনার চেয়ে বয়সে অনেক ছোট এশিয়ান গ্রুপের ডেপুটি ম্যানেজিং ডিরেক্টর সাকিফ আহমেদ সালাম ২০১৯ সালে চট্টগ্রাম চেম্বারের পরিচালক হয়েছিলেন। তাহলে আপনাকে কেন করা হয়নি?

এ প্রশ্নের উত্তরে সৈয়দ নজরুল ইসলাম বলেন, ‘ও (সাকিফ) যেভাবে সেখানে গেছে, আমি সেভাবে যেতে পারিনি।’

ব্যবসায়ী মহলের মতে, দেশের শীর্ষস্থানীয় ট্রেড বডি চট্টগ্রাম চেম্বার এখন এমপি লতিফের পারিবারিক প্রতিষ্ঠানে রূপ নিয়েছে।

চট্টগ্রাম চেম্বারের সদস্যদের অনেকে বলছেন, সৈয়দ নজরুল পরিচালক হওয়াতে চেম্বারে এমপি লতিফের আধিপত্যের জাল আরও বিস্তৃত হয়েছে। তিনি যেভাবে চেম্বারে পরিবারতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছেন, তা নজিরবিহীন।

চট্টগ্রাম চেম্বারের বর্তমান ২৪ সদস্যের পরিচালনা পর্ষদের মধ্যে এমপি লতিফের দুই ছেলেসহ ছয়জন তার নিকটাত্মীয়।

এমপি লতিফের তৃতীয় সন্তান ৩২ বছর বয়সী ওমর হাজ্জাজ গত বছরের ৮ আগস্ট বিনাভোটে চট্টগ্রাম চেম্বারের সভাপতি হন। তার আরেক ছেলে ওমর মুক্তাদিরকে পরিচালক করা হয়েছে।

এ ছাড়া পরিচালক মোহাম্মদ আদনানুল ইসলাম হলেন এমপি লতিফের আপন ভাগিনা। আরেক পরিচালক মোহাম্মদ মনির উদ্দিন হলেন এমপি লতিফের মেঝো সম্বন্ধীর (স্ত্রীর বড় ভাই) মেয়ের জামাই। অপর পরিচালক আবু সুফিয়ান চৌধুরী হলেন এমপি লতিফের ভাগ্নি জামাই। সর্বশেষ শূন্য পরিচালক পদে স্থান পাওয়া সৈয়দ নজরুল ইসলাম হলেন এমপি লতিফের বড় সম্বন্ধীর (স্ত্রীর বড় ভাই) মেয়ের জামাই।

চেম্বারের পরিচালনা পর্ষদের বাকি ১৮ জন সদস্যও এমপি লতিফের ঘনিষ্ঠ হিসেবেই পরিচিত।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে চট্টগ্রাম চেম্বারের একজন পরিচালক রাজনীতি সংবাদকে বলেন, চেম্বারের পরিচালনা পর্ষদে এমপি লতিফ তার নিকটাত্মীয়দের পাল্লা ভারী করার উদ্দেশ্য হলো, ক্ষমতা আরও পাকাপোক্ত করা। অবস্থদৃষ্টে মনে হচ্ছে, পরবর্তী পরিচালনা পর্ষদে এমপি লতিফের নিকটাত্মীয়দের মধ্য থেকেই দুই সহসভাপতি নির্বাচিত হবে।

আরেকজন পরিচালক নাম প্রকাশ না শর্তে রাজনীতি সংবাদকে বলেন, এমপি লতিফ চেম্বারের সবকিছু অদৃশ্যভাবে নিয়ন্ত্রণ করেন। চেম্বারের পরিচালনা পর্ষদ আছে নামে। বোর্ড সভায় কোনো সিদ্ধান্তের বিষয়ে পরিচালকদের কেউ যুক্তিগত কারণেও দ্বিমত পোষণ করার সাহস পায় না।

অভিযোগ আছে, দীর্ঘদিন ধরে চট্টগ্রাম চেম্বারকে আড়ালে থেকে নিয়ন্ত্রণ করেন সংগঠনটির সাবেক সভাপতি এম এ লতিফ। ২০০৮ সালে তিনি প্রথমবার আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর চেম্বারে প্রভাব বিস্তার করা শুরু করেন। গত ১৫ বছর ধরে তিনি পর্দার আড়ালে থেকে চেম্বারের নেতৃত্ব নির্ধারণ করে আসছেন। তার প্যানেল থেকেই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচনের সুযোগ আছে। এর বাইরে কেউ পরিচালক পদে নির্বাচিত হতে পারেন না।

চট্টগ্রাম চেম্বারের একটি সূত্র জানিয়েছে, লতিফের ম্যাকানিজমের কারণে চেম্বারের ভোট বন্ধ হয়ে গেছে। চেম্বারের ৬ হাজার ৬২৩ জন সদস্যের মধ্যে প্রায় দেড় হাজার সদস্য লতিফের একক নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। এ ছাড়া আরও এক চতুর্থাংশ সদস্য তার প্যানেলের নেতাদের নিয়ন্ত্রণে আছে। অর্ধেক ভোটার লতিফের প্যানেলের নিয়ন্ত্রণে থাকায় নির্বাচনে তিনি ফ্যাক্টর হয়ে দাঁড়ান। যে কারণে তার প্যানেলের বিরুদ্ধে কেউ প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সাহস করে না। লতিফের এই ম্যাকানিজমের কারণে গত ১৫ বছর ধরে চেম্বারের ভোট হয় না।

ছালামের পরিবারের সঙ্গে লতিফের আত্মীয়তা নিয়ে নানা আলোচনা
চট্টগ্রাম-৮ আসনের সংসদ সদস্য ও নগর আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ আবদুচ ছালামের পরিবারের সঙ্গে এম এ লতিফের আত্মীয়তার বন্ধন নিয়ে চট্টগ্রামের রাজনৈতিক ও ব্যবসায়িক মহলে নানা আলোচনা চলছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে, সৈয়দ নজরুল ইসলামকে আত্মীয়তার বন্ধনে আবদ্ধ করে এমপি লতিফ এক ঢিলে দুই পাখি শিকার করেছেন। সৈয়দ নজরুলকে পরিচালক করে তিনি একদিকে চট্টগ্রাম চেম্বারে তার আধিপত্যের জাল বিস্তৃত করেছেন, অন্যদিকে আবদুচ ছালামকে নিয়ে মহানগর আওয়ামী লীগে একটা বলয় তৈরি করতে যাচ্ছেন।

জানা গেছে, আবদুচ ছালাম সিডিএর চেয়ারম্যান থাকাকালে চেম্বারের নির্মিত ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের একটা বিষয় নিয়ে তার সঙ্গে এমপি লতিফের দ্বন্দ্ব হয়েছিল। সেই দ্বন্দ্ব ভুলে দুজন সম্প্রতি আত্মীয়তার বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছেন।

দলীয় একটি সূত্র জানিয়েছে, নগর আওয়ামী লীগের আসন্ন সম্মেলনকে ঘিরে আ জ ম নাছির উদ্দীনকে ঠেকাতে লতিফ-ছালাম আত্মীয়তার বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছেন।

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এম এ লতিফ ও আবদুচ ছালামের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে অবস্থান নিয়েছিলেন নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দীন। চট্টগ্রাম-১১ আসনে এম এ লতিফের প্রতিদ্বন্দ্বী জিয়াউল হক সুমন ও চট্টগ্রাম-৮ আসনে আবদুচ ছালামের প্রতিদ্বন্দ্বী বিজয় কুমার চৌধুরীকে সমর্থন দিয়েছিলেন আ জ ম নাছির।

দলীয় সূত্রটি জানিয়েছে, সংসদ নির্বাচনে বিরোধিতার জের ধরে আ জ ম নাছিরকে নগর আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব থেকে সরানোর মিশনে নেমেছেন লতিফ ও ছালাম।

এ বিষয়ে জানতে এম এ লতিফ ও আবদুচ ছালামের সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করে তাদের পাওয়া যায়নি।

জানতে চাইলে সৈয়দ নজরুল ইসলাম রাজনীতি সংবাদকে বলেন, ‘নগর আওয়ামী লীগের কোনো রাজনৈতিক সমীকরণের মধ্যে আমি নেই। আমি ট্রেড পলিটিক্স করি।’

আরও পড়ুন:

মাসে কোটি টাকা আয় করেও ট্যাক্স দেয় না চট্টগ্রাম চেম্বার

‘চাপে’ পড়ে ২ কোটি ১৫ লাখ টাকা ট্যাক্স দিলো চট্টগ্রাম চেম্বার

মন্তব্য করুন
Rajniti Sangbad


আরও খবর