রবিবার, ২৪ নভেম্বর, ২০২৪ | ৯ অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ | ২১ জমাদিউল আউয়াল, ১৪৪৬

মূলপাতা আঞ্চলিক রাজনীতি

চট্টগ্রামের পলোগ্রাউন্ডে প্রধানমন্ত্রীর জনসভা: আ জ ম নাছিরের অগ্নিপরীক্ষা



রাজনীতি সংবাদ প্রতিবেদন প্রকাশের সময় :২৭ নভেম্বর, ২০২২ ৭:০৪ : অপরাহ্ণ

আগামী ৪ ডিসেম্বর চট্টগ্রামের পলোগ্রাউন্ড মাঠে জনসভার আয়োজন করছে চট্টগ্রাম মহানগর, উত্তর ও দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগ। পলোগ্রাউন্ডে স্মরণকালের বড় জমায়েত ঘটাতে প্রস্তুতি নিয়েছে আওয়ামী লীগ। কিন্তু এ জনসভাকে ঘিরে অগ্নিপরীক্ষার মুখোমুখি হতে যাচ্ছেন মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক সিটি মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন।

জনসভার স্থান নগরীতে হওয়ার কারণে সভায় আধিপত্য থাকবে মহানগর আওয়ামী লীগের। জনসভায় প্রত্যাশা অনুযায়ী বিপুল জনসমাগম হলে সংগঠনের ‘অভিভাবক’ হিসেবে কৃতিত্বের দাবিদার হবেন নাছির। কিন্তু কোনো কারণে সভায় জনসমাগম কম হলে কিংবা বিশৃঙ্খলা হলে আ জ ম নাছিরের দিকেই অভিযোগের তীর ছুটে যাবে বলে মনে করছেন সংগঠনটির নেতারা।

২০১৮ সালের ২১ মার্চ চট্টগ্রামের পটিয়া আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে প্রধানমন্ত্রীর জনসভা আয়োজন করা হয়েছিল চট্টগ্রাম মহানগর, উত্তর ও দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের উদ্যোগে। কিন্তু সাংগঠনিক সীমানার কারণে সেই জনসভায় আধিপত্য ছিল দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের। অথচ তখন জনসভাটি হওয়ার কথা ছিল নগরীতে। নগরীতে বড় মাঠ না থাকার কারণ দেখিয়ে সেই জনসভাটি নগরী থেকে পটিয়ায় নিয়ে যাওয়া হয়।

চার বছর পর এবার বন্দর নগরীতে হচ্ছে প্রধানমন্ত্রীর জনসভা। এর আগে ২০১২ সালের ২৮ মার্চ পলোগ্রাউন্ডে জনসভা করেছিলেন শেখ হাসিনা। সেই জনসভা আয়োজনের সময় নগর আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ছিলেন প্রয়াত এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী ও কাজী ইনামুল হক দানু।

এবার পলোগ্রাউন্ডের জনসভায় মহানগর আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে থাকবেন ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মাহতাব উদ্দিন চৌধুরী ও সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দীন।

জনসভায় সভাপতিত্ব করবেন মাহতাব উদ্দিন চৌধুরী ও পরিচালনা করবেন আ জ ম নাছির উদ্দীন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে নগর আওয়ামী লীগের সম্পাদক মন্ডলীর একজন সদস্য রাজনীতি সংবাদকে বলেন, তিন সাংগঠনিক জেলার ব্যানারে জনসভার আয়োজন হলেও সভায় কেন্দ্রবিন্দুতে থাকবে মহানগর। পটিয়ায় প্রধানমন্ত্রীর জনসভায় কর্তৃত্ব ছিল দক্ষিণ জেলার। জনসভা সফলের কৃতিত্বও পেয়েছিল দক্ষিণ জেলা। এবার পলোগ্রাউন্ডে জনসভা সফল হলে কৃতিত্ব পাবে মহানগর। কিন্তু কৃতিত্বের দাবিদার হয়ে থাকেন যারা নেতৃত্ব দেন তারা। তবে নগর আওয়ামী লীগের এখন নেতৃত্ব দিচ্ছেন কার্যত একজন। জনসভায় জমায়েত কম হলে কিংবা কোনো বিশৃঙ্খলা হলে তিনি প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারেন।

জানতে চাইলে মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দীন রাজনীতি সংবাদকে বলেন, ‘বাংলাদেশের মধ্যে আওয়ামী লীগের সবচেয়ে শক্তিশালী ইউনিট হলো চট্টগ্রাম মহানগর। চট্টগ্রাম মহানগর যে কতটা শক্তিশালী সেটা আমরা পলোগ্রাউন্ডে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর জনসভায় প্রমাণ করবো। পলোগ্রাউন্ড তো কানায় কানায় পূর্ণ করবোই, এর বাইরে নিউমার্কেট থেকে দেওয়ানহাট-লালখান বাজার হয়ে জিইসি পর্যন্ত অন্তত ১৫-২০ লাখ মানুষ জমায়েত করাই আমাদের টার্গেট।’

পলোগ্রাউন্ডের জনসভাকে অগ্নিপরীক্ষা মনে করছেন কিনা-জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সেটা আমি মনে করি না। কারণ আমি তো হাইব্রিড রাজনীতিবিদ না। আওয়ামী লীগের দুঃসময়ে রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হয়েছি। অনেক চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে আজকে এই জায়গায় এসেছি। আমার রাজনীতির বয়স এখন ৫০ বছর।’

এক প্রশ্নের জবাবে আ জ ম নাছির বলেন, ‘আমার কৃতিত্বের কিছু দেখছি না। চট্টগ্রাম মহানগরের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে আমাদের প্রাণপ্রিয় নেত্রীর জনসভাকে সফল করা আমার দায়িত্ব ও অঙ্গীকার।’

জানা গেছে, প্রধানমন্ত্রীর জনসভাকে ঘিরে চট্টগ্রাম মহানগর, উত্তর ও দক্ষিণ জেলা নেতৃবৃন্দের পারফরম্যান্স মূল্যায়ন করবে কেন্দ্র। জনসভায় তিন সাংগঠনিক জেলার জনসমাগম কী পরিমাণ হয় তা পর্যবেক্ষণ করা হবে।

আওয়ামী লীগের চট্টগ্রাম বিভাগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও জাতীয় সংসদের হুইপ আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন রাজনীতি সংবাদকে বলেন, ‘পলোগ্রাউন্ডে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর জনসভায় দেশের স্মরণকালের বড় জমায়েত ঘটাতে আমরা প্রস্তুতি নিয়েছি। জনসভায় উপস্থিতির বিষয়ে চট্টগ্রামের তিন সাংগঠনিক জেলাকে সুনির্দিষ্ট কোনো টার্গেট দেওয়া হয়নি। তবে জনসভাকে ঘিরে তিন সাংগঠনিক জেলার পারফরম্যান্স পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে।’

আবার প্রধানমন্ত্রীর ‘গুড বুকে’ স্থান পেতে পারেন নাছির

২০১৩ সালে নগর আওয়ামী লীগের সরাসরি সাধারণ সম্পাদক হওয়ার পর থেকে প্রধানমন্ত্রীর ‘গুড বুকে’ ছিলেন আ জ ম নাছির। সাধারণ সম্পাদক হওয়ার মাত্র দেড় বছরের মাথায় চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে তাকে মেয়র পদেও দলীয় মনোনয়ন দেন শেখ হাসিনা। কিন্তু গত সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র পদে মনোনয়ন বঞ্চিত হন নাছির।

প্রচার আছে, প্রধানমন্ত্রী নানা কারণে আ জ ম নাছিরের ওপর অসন্তুষ্ট হয়ে তাকে দ্বিতীয়বার মেয়র পদে মনোনয়ন দেননি। এরপর প্রধানমন্ত্রীর ‘গুড বুক’ থেকে বাদ পড়ে যান নাছির।

গত মেয়র নির্বাচনের পর নগর আওয়ামী লীগের নতুন কমিটি ঘোষণার কথা ছিল। নতুন কমিটিতে আ জ ম নাছিরকে সাধারণ সম্পাদক পদ থেকেও সরিয়ে দেওয়ার গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়েছিল। কিন্তু আগে তৃণমূলে সম্মেলনের উদ্যোগ নেওয়া হলে মহানগরের কমিটি হওয়ার সেই প্রক্রিয়া ভেস্তে যায়।

মেয়র হিসেবে আ জ ম নাছিরকে ‘প্রশ্নবিদ্ধ’ করা হলেও নগর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড নিয়ে তার বিরুদ্ধে দৃশ্যমান কোনো অভিযোগ নেই। বরং গতিশীল নেতৃত্বের জন্য সংগঠনের প্রতিপক্ষের নেতারাও তার প্রশংসা করেন।

বছর খানেক আগে নগর আওয়ামী লীগের একটি সভায় মাহতাব উদ্দিন চৌধুরী ও আ জ ম নাছিরের নেতৃত্বের ভূয়সী প্রশংসা করেন শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল।

নওফেলের অনুসারী নগর যুবলীগের সাবেক একজন যুগ্ম আহ্বায়ক (যিনি এখন আওয়ামী লীগের সদস্য) নাম প্রকাশ না করার শর্তে রাজনীতি সংবাদকে বলেন, মহিউদ্দিন চৌধুরীর মৃত্যুর পরও তিনি (আ জ ম নাছির) সংগঠনকে গতিশীল রেখেছেন। তিনি এখন কোনো বিশৃঙ্খলা ছাড়া তৃণমূলে সম্মেলন করছেন। দলীয় সব কর্মসূচি তিনি স্বতস্ফূর্তভাবে পালন করেন। তিনি মেয়রের দায়িত্ব পালনকালে শত ব্যস্ততার মধ্যেও সংগঠনের সব কর্মসূচি নিয়মিতভাবে পালন করেছেন। আর নগর আওয়ামী লীগের মতো একটা সংগঠন পরিচালনায় যে আর্থিক সক্ষমতার প্রয়োজন তা আ জ ম নাছির ছাড়া অন্য কোনো নেতার পক্ষে যোগান দেওয়ার সামর্থ নেই। সবকিছু মিলিয়ে নগর আওয়ামী লীগে তার নেতৃত্বের বিকল্প নেই।

আগামী ১৮ ডিসেম্বর নগর আওয়ামী লীগের ত্রি-বার্ষিক সম্মেলন হওয়ার কথা রয়েছে।

নগর আওয়ামী লীগ নেতাদের অনেক মনে করছেন, আ জ ম নাছির পলোগ্রাউন্ডের অগ্নিপরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলে তিনি আবার প্রধানমন্ত্রীর ‘গুড বুকে’ স্থান পেতে পারেন। এতে তিনি আবারও নগর আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্বে আসতে পারেন।

জানতে চাইলে মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দীন রাজনীতি সংবাদকে বলেন, ‘আমি সাধারণ সম্পাদক হওয়ার আগে দীর্ঘ সময় পদবী ছাড়া মহানগর আওয়ামী লীগের রাজনীতি করেছি। আমি কখনো পদের জন্য রাজনীতি করি না। আমাদের নেত্রী সংগঠনের জন্য যাকে যোগ্য মনে করবেন তাকে নেতৃত্বে আনবেন।’

জানা গেছে, আওয়ামী লীগের এখন যেসব জেলা-মহানগর কমিটির সম্মেলন হচ্ছে সেখানে পুরনো নেতৃত্বই বহাল রাখা হচ্ছে। মূলত আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে অভিজ্ঞতার কারণে পুরনো নেতৃত্বের প্রতি আস্থা রাখছে আওয়ামী লীগ।

আওয়ামী লীগের কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নগর আওয়ামী লীগের সম্মেলনে ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মাহতাব উদ্দিন চৌধুরীকে ভারমুক্ত করা হতে পারে। মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক প্রয়াত জহুর আহমদ চৌধুরীর ছেলে হিসেবে তার প্রতি প্রধানমন্ত্রীর ‘সহানুভূতি’ রয়েছে। সে হিসেবে শেষ বয়সে মাহতাব উদ্দিনকে ভারমুক্ত করে সম্মান দেওয়া হতে পারে। কিংবা তাকে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামন্ডলীর সদস্য করে তার জায়গায় অন্য কাউকে দায়িত্ব দেওয়া হতে পারে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে আওয়ামী লীগের একজন কেন্দ্রীয় নেতা প্রশ্ন রাখেন, চট্টগ্রাম উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এম এ সালাম ও আ জ ম নাছিরের বয়স সমান। দুজনের বয়স ৬৬ বছর। উত্তর জেলায় এম এ সালাম সভাপতি হতে পারলে মহানগরে আ জ ম নাছিরকে কেন সভাপতি করা হবে না?

একটি গোয়েন্দা সংস্থার ভাষ্যমতে, নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে আ জ ম নাছিরের কর্মকাণ্ড ইতিবাচক। গত সিটি করপোরশেন নির্বাচনে তিনি মনোনয়ন না পাওয়া সত্ত্বেও দলের সিদ্ধান্তের প্রতি আনুগত্য দেখিয়েছেন। তিনি ভোটের মাঠে তার অনুসারী কাউন্সিলর প্রার্থীদের জন্য কোনো প্রভাব বিস্তার করেননি।

চট্টগ্রাম-৮ (বোয়ালখালী চান্দগাঁও) আসনের উপনির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী মোছলেম উদ্দিনের বিজয়ের পেছনে তিনি সক্রিয় ভূমিকা রাখেন। এমনকি গত জাতীয় নির্বাচনে চট্টগ্রাম-৯ (কোতোয়ালী) আসনে মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলের জন্যও তিনি অক্লান্ত পরিশ্রম করেন।

গত সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আ জ ম নাছিরের কপাল পুড়লেও সামনে নগর আওয়ামী লীগের সম্মেলনে আবার তার কপাল খুলে যেতে পারে বলে ধারণা করছেন দলীয় নেতারা।

আরও পড়ুন: ১০ ডিসেম্বরের গণসমাবেশ নয়াপল্টনে, সোহরাওয়ার্দীতে নয়: বিএনপি

মন্তব্য করুন
Rajniti Sangbad


আরও খবর