‘কী চাস তোরা? বেয়াদবি করছিস কেন?’ গর্জে ওঠে বজ্রকণ্ঠ। পাহাড়সম ব্যক্তিত্বের সামনে পড়ে ঘাবড়ে যায় ঘাতক ল্যান্সার মহিউদ্দীন। কাঁপতে কাঁপতে হাত থেকে পিস্তল পড়ে যায়। ‘স্টপ! দিস বাস্ট্রার্ড হ্যাজ নো রাইট টু লিভ।’
গর্জে ওঠে ঘাতক নূর চৌধুরীর স্বয়ংক্রিয় স্টেনগান। মাত্র সাত ফুট দূর থেকে ১৮টি গুলি এসে ঝাঁজরা করে দেয় ধ্রুবতারা দেহ। কৃষ্ণগহ্বরের রাতে বৃষ্টির মতো গুলিতে ঝাঁজরা ছয় ফুট দুই ইঞ্চির বিশাল দেহ মুখ-থুবড়ে পড়ে সিঁড়িতে।
বুকের ডান দিকে গুলির বিরাট ছিদ্র। যে উঁচু করা তর্জনী ছিল পাকিস্তানের ভয়ের কারণ, আর সন্তানসম বাঙালির আস্থার প্রতীক-ঘাতকের ব্রাশফায়ারে উড়ে যায় সেই তর্জনীটি।
আজ শোকাবহ ১৫ আগস্ট, জাতীয় শোক দিবস। মানব সভ্যতার ইতিহাসে ঘৃণ্য ও নৃশংসতম হত্যাকাণ্ডের কালিমালিপ্ত বেদনাবিধূঁর শোকের দিন।
৪৭ বছর আগে এ দিনে কাকডাকা ভোরে বিপথগামী কিছু সেনাসদস্য ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়িতে স্বাধীনতার স্থপতি, মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করে।
পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট সুবেহ সাদিকের সময় যখন ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে নিজ বাসভবনে সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে বুলেটের বৃষ্টিতে ঘাতকরা ঝাঁঝরা করে দিয়েছিল, তখন যে বৃষ্টি ঝরছিল, তা যেন ছিল প্রকৃতিরই অশ্রুপাত। ভেজা বাতাস কেঁদেছে সমগ্র বাংলায়।
ঘাতকদের উদ্যত অস্ত্রের সামনে ভীতসন্ত্রস্ত বাংলাদেশ বিহবাল হয়ে পড়েছিল শোকে আর অভাবিত ঘটনার আকস্মিকতায়। কাল থেকে কালান্তরে জ্বলবে এ শোকের আগুন।
বাঙালির মুক্তির মহানায়ক স্বাধীনতা সংগ্রাম শেষে যখন ক্ষত-বিক্ষত অবস্থা থেকে দেশটির পুনর্গঠন ও অর্থনৈতিক মুক্তি নিশ্চিত করতে চেয়েছিলেন তখনই ঘটানো হয় ইতিহাসের নির্মম এ ঘটনা।
বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাত অনুযায়ী, ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডের নেতৃত্বে ছিল কর্নেল ফারুক। তারই পরিকল্পনায় প্রায় ১৫০ জন সৈন্যের বড় বড় তিনটি দল সাজানো হয়। তিনটি দলের প্রধান টার্গেট শেখ মুজিব, আবদুর রব সেরনিয়াবাত ও শেখ মণির বাড়ি।
জাতির পিতা হত্যাকাণ্ডের জঘন্যতম ঘটনার দায়িত্ব দেয়া হয় মেজর নূর ও মহিউদ্দিনকে। তাদের সঙ্গে ছিল এক কোম্পানি ল্যান্সার। সেরনিয়াবাতের বাড়ি আক্রমণ করার দায়িত্ব নেয় ডালিম। আর খুনি ফারুকের অত্যন্ত আস্থাভাজন রিসালদার মুসলেহউদ্দিনকে দেয়া হয় শেখ মণির বাড়ি আক্রমণের।
খুনিদের ওপর নির্দেশ ছিল সবাইকে হত্যা করার। এছাড়া খুনিদের বাধাদানকারী বা পরে বিপদের কারণ হতে পারে এমন যে কাউকেই নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার নির্দেশ দিয়েছিল কর্নেল ফারুক। হত্যাকাণ্ডে বাধা আসতে পারে এমন স্থানেও কিছু সৈন্য মোতায়েন ও ট্যাংক প্রস্তুত করে রাখে হায়েনারা।
ভোর ৪টা ৮ মিনিটে রক্তপিপাসু ঘাতক চক্র তিন দলে বিভক্ত হয়ে বেরিয়ে পড়ে। এছাড়া রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে ৩০টি ট্যাংক অবস্থান নেয়। ভোর ৫টার মধ্যেই ঘেরাও করে ফেলে ৩২ নম্বর বাড়ি এবং আশপাশের এলাকা।
আনুমানিক সাড়ে ৫টার দিকে বঙ্গবন্ধু ভবনে আক্রমণ করে। গোলাগুলির মধ্যে বিভিন্ন দিকে ফোন করে সাহায্য চান বঙ্গবন্ধু। পুলিশ কন্ট্রোল রুমে কেউ ফোন ধরছিল না। মিলিটারি সেক্রেটারি কর্নেল জামিল ফোন পেয়ে তাৎক্ষণিক ছুটে এসে সৈন্যদের গুলিতে নিহত হন।
সেনাপ্রধান জেনারেল সফিউল্লাহর কাছে সহায়তা চাইলে তিনি বলেন, ‘স্যার আই এম ডুয়িং সামথিং। ক্যান ইউ গেট আউট অব দ্য হাউস।’ ভোর আনুমানিক ৫টা ৫০ মিনিটে বৃষ্টির মতো গুলিতে ঝাঁজরা বঙ্গবন্ধু সিঁড়িতে গড়িয়ে পড়েন।
ঘাতকরা শুধু বঙ্গবন্ধুকেই হত্যা করেনি, তাদের হাতে একে একে প্রাণ হারিয়েছেন বঙ্গবন্ধুর স্ত্রী বেগম ফজিলাতুন নেছা, বঙ্গবন্ধুর বড় ছেলে শেখ কামাল, শেখ জামাল ও তাদের স্ত্রী সুলতানা কামাল ও রোজি জামাল। ঘাতকদের নিষ্ঠুরতা থেকে রেহাই পায়নি বঙ্গবন্ধুর কনিষ্ঠ পুত্র শিশু শেখ রাসেল।
পৃথিবীর এই জঘন্যতম হত্যাকাণ্ড থেকে বাঁচতে পারেননি বঙ্গবন্ধুর ছোট ভাই শেখ নাসের, ভগ্নিপতি আবদুর রব সেরনিয়াবাত, তার ছেলে আরিফ, মেয়ে বেবি ও সুকান্তবাবু, বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ও বর্তমান ঢাকা দক্ষিণের মেয়র ব্যারিস্টার ফজলে নূর তাপসের বাবা শেখ ফজলুল হক মণি, তার অন্তঃস্বত্ত্বা স্ত্রী আরজু মনি এবং আবদুল নাঈম খান রিন্টু ও কর্নেল জামিলসহ পরিবারের ১৬ সদস্য ও ঘনিষ্ঠজন।
এ সময় বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা বিদেশে থাকায় ঘাতকদের হাত থেকে প্রাণে রক্ষা পান।
ইতিহাসের বর্বরোচিত এ হত্যাকাণ্ডের পরে সারা বিশ্বে নেমে আসে শোকের ছায়া। পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে আসতে থাকে বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর প্রতিবাদে বিক্ষোভ।
এ ঘটনার পর নোবেলজয়ী পশ্চিম জার্মানীর নেতা উইলি ব্রানডিট বলেন, ‘মুজিবকে হত্যার পর বাঙালিদের আর বিশ্বাস করা যায় না। যে বাঙালি শেখ মুজিবকে হত্যা করতে পারে তারা যে কোনো জঘন্য কাজ করতে পারে।’
ভারতীয় বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ নাগরিক ও বিশিষ্ট সাহিত্যিক নীরদ সি চৌধুরী বাঙালিদের ‘বিশ্বাসঘাতক’ হিসেবে বর্ণনা করে বলেন, ‘বাঙালি জাতির স্বপ্নদ্রষ্টা শেখ মুজিবকে হত্যার মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতি বিশ্বের মানুষের কাছে নিজেদের আত্মঘাতী চরিত্রই তুলে ধরেছে।’
বঙ্গবন্ধুর নির্মম হত্যাকাণ্ডের দীর্ঘ ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব নিয়ে কুখ্যাত ইনডেমনিটি আইন বাতিল করে। জাতির পিতা ও তার পরিবারবর্গের নিষ্ঠুর বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ডের বিচারকার্য শুরু হয়। ২০১০ সালের ২৭ জানুয়ারি দীর্ঘ ৩৪ বছরেরও বেশি সময় পর সেই কলঙ্ক থেকে জাতির দায়মুক্তি ঘটে। বঙ্গবন্ধু হত্যার চ‚ড়ান্ত বিচারের রায় অনুযায়ী ওই দিন মধ্যরাতের পর পাঁচ খুনির ফাঁসি কার্যকর হয়। এর মধ্য দিয়ে জাতির পিতা হত্যা, ষড়যন্ত্র এবং অবৈধ ক্ষমতা দখলের ঘৃণ্য ও তমসাচ্ছন্ন অধ্যায়ের অবসান ঘটেছে।
জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পৃথক বাণী দিয়েছেন।
জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষ্যে আগস্ট মাসের প্রথম দিন থেকেই আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনসহ বিভিন্ন সামাজিক সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক সংগঠন বিস্তারিত কর্মসূচি পালন করছে।