শুক্রবার, ১৭ মে, ২০২৪ | ৩ জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩১ | ৮ জিলকদ, ১৪৪৫

মূলপাতা দেশজুড়ে

পঞ্চম শ্রেণি পাস করে হ্যাকিংয়ের মাস্টার! ১ মাসে আড়াই হাজার আইডি হ্যাক


রাজনীতি সংবাদ ডেস্ক প্রকাশের সময় :১২ এপ্রিল, ২০২২ ১২:৩৭ : পূর্বাহ্ণ
লিটন ইসলাম। ছবি: সংগৃহীত
Rajnitisangbad Facebook Page

ঢাকার আশুলিয়ার বাসিন্দা লিটন ইসলাম (২৮)। টেনেটুনে পঞ্চম শ্রেণি পাস করা লিটন কম্পিউটার চালনায় বেশ পারদর্শী ছিলেন। ফটোশপের ভালো কাজ জানতেন। একপর্যায়ে ফ্রিল্যান্সিংয়ের কাজ শুরু করেন। এই কাজ করতে গিয়ে তার মাথায় ফেসবুক আইডি হ্যাক করার চিন্তা আসে। তারপর থেকে শুরু করে আইডি হ্যাক। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে হ্যাকিংয়ে দক্ষতা বাড়ে তার। একপর্যায়ে হ্যাকিংয়ের মাস্টার বনে যান লিটন।

এক ভুক্তভোগীর ফেসবুক আইডি হ্যাকের মামলায় গ্রেপ্তারের পর ডিবি পুলিশ জানতে পারে, এই লিটন এক মাসে একাই হ্যাক করেছেন অন্তত আড়াই হাজার ফেসবুক আইডি! এসব আইডির মধ্যে দেশি-বিদেশি আইডিসহ বিভিন্ন বয়সের নারী-পুরুষ রয়েছেন।

এমনকি আইডিধারী ব্যক্তিদের জিম্মি করে তিনি হাতিয়ে নিয়েছেন লাখ লাখ টাকা। টাকা না দিলে দখলে থাকা আইডি থেকে রাষ্ট্রবিরোধী অপপ্রচার চালিয়ে জঙ্গি পরিচয় দেওয়ার ভয়ও দেখাতেন এই লিটন। ব্যক্তিগত গোপন ছবি ছড়ানোর হুমকিও ছিল তার টাকা হাতিয়ে নেওয়ার হাতিয়ার।

লিটনকে গ্রেপ্তারের পর খোদ ডিবি কর্মকর্তাই অবাক হয়েছেন। এত অল্প সময়ে আড়াই হাজার আইডি কীভাবে হ্যাক করেছে। তার নিয়ন্ত্রণে থাকা নারী-পুরুষের ব্যক্তিগত ছবি-ভিডিও দেখেও তারা বিস্মিত। শত শত ছবি- ভিডিও তার নিয়ন্ত্রণে। মানুষকে ব্ল্যাকমেইল করার মূল অস্ত্র ছিল এগুলো।

তবে ব্ল্যাকমেইল করে মানুষের কাছ থেকে ঠিক কত টাকা তিনি কামিয়েছেন তার হিসাব এখনো পাননি ডিবি কর্মকর্তারা।

এ ছাড়া আড়াই হাজার আইডির বাইরে আর কত আইডি হ্যাক করেছে তার হিসাব জানার চেষ্টা করছেন তদন্ত সংশ্লিষ্টরা। রিমান্ডে এনে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।

তবে ডিবি বলছে, আইডি হ্যাক করে লিটন অনেক তরুণীর সর্বনাশ করেছে।

ডিবি জানায়, কদমতলী থানার তথ্য প্রযুক্তি আইনের মামলায় আশুলিয়ার এনায়েতপুর এলাকায় অভিযান চালিয়ে লিটনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গ্রেপ্তারের সময় তার কাছ থেকে একটি সিপিইউ, দুটি মোবাইলফোন ও ১০টি সিম কার্ড উদ্ধার করা হয়েছে।

তার কাছ থেকে নানা ডিভাইস জব্দ করে তা যাচাই করে সাইবার গোয়েন্দারা দেখতে পান, অন্তত আড়াই হাজার আইডির ইউজার নেম ও পাসওয়ার্ড তার দখলে। এ তালিকায় অনেক ভিআইপি ও শিল্পপতিদের অ্যাকাউন্টও রয়েছে। রয়েছে বিদেশি নাগরিকদের আইডিও।

লিটনের গ্রামের বাড়ি মানিকগঞ্জের শিবালয় থানার নতুনপাড়া এলাকায়। তিনি ওই এলাকার আব্দুর রহিম ও আসমা বেগমের ছেলে। আশুলিয়ার এনায়েতপুর ডলফিন গেইট এলাকায় তিনি একাই থাকতেন।

ডিবির সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগের অর্গানাইজড ইনভেস্টিগেশন টিমের প্রধান অতিরিক্ত উপ-কমিশনার নাজমুল হক গণমাধ্যমকে বলেন, লিটন প্রথমে অনলাইনে ফিশিং লিংক তৈরি করে ছবি ও ভিডিও যুক্ত করে ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করতেন। শেয়ার করা লিংকে ইউজার নেম ও পাসওয়ার্ড দিয়ে লগইন করার চেষ্টা করা মাত্রই ওই পাসওয়ার্ড ও ইউজার নেম হ্যাকার লিটনের কাছে চলে যেত। এই হ্যাকার তখন পাসওয়ার্ড পরিবর্তন করে অ্যাকাউন্টটি দ্রুত তার নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নিতেন।

ডিবি সূত্র জানিয়েছে, ভুক্তভোগী ও মামলার বাদী আনোয়ার হোসেন (৫০) আমাদের কাছে অভিযোগ করেন, ২৭ ফেব্রুয়ারি রাত সাড়ে ১০টার সময় অলিউল্লাহ কাজী নামের অপরিচিত আইডির মেসেঞ্জার থেকে তার মেসেঞ্জারে ফিশিং লিংক পাঠায়। তিনি ওই লিংকে প্রবেশ করলে রিডাইরেক্ট করে অন্য ওয়েবপেইজে নিয়ে যায়। এটি দেখতে হুবহু ফেসবুক-এর মতো। তিনি ওই ওয়েব পেইজে তার আইডি ও পাসওয়ার্ড দিয়ে লগইন করার চেষ্টা করা মাত্রই আইডি চলে যায় হ্যাকারের নিয়ন্ত্রণে। পরে ওই আইডি থেকে হ্যাকার বিভিন্ন ধরনের মানহানিকর পোস্ট দেয়। হ্যাকার আনোয়ারের মেসেঞ্জারের মাধ্যমে জানায় তার আইডি হ্যাক করে নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে। তার সমস্ত ব্যক্তিগত তথ্য এবং ফেসবুক অ্যাক্টিভিটির স্ক্রিন রেকর্ডিং সংরক্ষণ করেছে। হ্যাকারের চাহিদামত টাকা দিলে আইডি ফিরিয়ে দিবে এবং কোনো ক্ষতি করবে না। আর যদি চাহিদামতো টাকা না দেয় তবে তার ব্যক্তিগত তথ্য ফেসবুক বন্ধদের ট্যাগ করে শেয়ার করে দিবে।

ভুক্তভোগী আনোয়ার হোসেন গণমাধ্যমকে বলেন, আমি একটি ফুড সাপ্লিমেন্ট কোম্পানির বিক্রয়কর্মী হিসেবে কাজ করি। ২৭শে ফেব্রুয়ারি আমার আইডি হঠাৎ করে হ্যাক হয়ে যায়। তারপর ওই হ্যাকার আমাকে প্রথমে মেসেঞ্জারে পরে আমার হোয়াটসঅ্যাপে কল দিয়ে নানা রকম হুমকি, ভয়ভীতি ও বকাবকি করতে থাকে। আমাকে হুমকি দিয়ে বলে যদি তার চাহিদামতো টাকা না দেই তবে আমাকে নাস্তিক, দেশদ্রোহী ও জঙ্গি বানিয়ে জেলে পাঠাবে। আমার পরিচিত ব্যক্তিদেরকেও আমার হয়ে টাকা চাইতে থাকে। আমি তাকে টাকা দেয়ার নাম করে ঘুরাতে থাকি। তারপর থানায় জিডি করি। যখন মামলার এজাহার লেখা চলছিল তখনো তিনি আমার সঙ্গে যোগাযোগ করে যাচ্ছিলেন। পরে আমি কৌশলে তার কাছ থেকে যোগাযোগের জন্য একটি মোবাইল নম্বর নিয়ে আসি। ওই মোবাইল নম্বরের সূত্র ধরে তাকে সাইবার টিম গ্রেপ্তার করে।

গোয়েন্দা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার (উত্তর এবং সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগ) মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ বলেন, লিটন চাঁদাবাজির জন্যই আইডি হ্যাক করতেন। শুধু বাংলাদেশ নয়, আমেরিকা-ইংল্যান্ডসহ বিভিন্ন দেশের নাগরিকদের আইডি হ্যাক করে অর্থ হাতিয়েছেন তিনি। মেয়েদের আইডি হ্যাক করে মেসেঞ্জার থেকে গোপন তথ্য নিয়ে জিম্মি করে টাকা হাতিয়েছেন। এই লিটনের খপ্পরে পড়ে নাকানি-চুবানি খেয়েছেন অনেক ভিআইপি ও শিল্পপতিও। তাকে গ্রেপ্তারের পর এমন তথ্য মিললেও তারা কিন্তু লোকলজ্জার ভয়ে আগে থেকে পুলিশের সহায়তা নেননি।

মন্তব্য করুন
Rajnitisangbad Youtube


আরও খবর