প্রভাষ আমিন প্রকাশের সময় :২৩ মে, ২০২১ ১১:০৪ : অপরাহ্ণ
রোজিনা ইসলামকে সচিবালয়ে ছয় ঘণ্টা আটকে রেখে গ্রেপ্তার, কারাগারে পাঠানো, জামিন ঝুলিয়ে রাখার প্রতিবাদে দেশজুড়ে যে স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলন গড়ে উঠেছিল তা আসলেই নজিরবিহীন।
সাংবাদিকদের সবকটি সংগঠন তো মাঠে নেমেছেই; সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও গড়ে উঠেছে প্রবল জনমত। শিক্ষক, আইনজীবী, সুশীল সমাজের অনেকেই তাদের প্রতিবাদ জানিয়েছেন।
আন্দোলনটি প্রথম আলোর সিনিয়র রিপোর্টার রোজিনা ইসলামের গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে হলেও এখন আর সেটি ব্যক্তি পর্যায়ে নেই। সবাই এখন মতপ্রকাশের স্বাধীনতার প্রশ্নে ঐক্যবদ্ধ। এমনিতে বাংলাদেশের সাংবাদিক-সুশীল সমাজ নানান দলে বিভক্ত। রাজনৈতিকভাবেও সবাইকে সহজেই আলাদা করা যায়। কিন্তু কখনো কখনো পরিস্থিতি সবাইকে এক করে ফেলে। রোজিনার গ্রেপ্তার দেশে তেমনই এক পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। অবশেষে রোববার রোজিনা ইসলাম শর্তসাপেক্ষে জামিন পেয়েছেন।
তবে শুরুটা এত সহজ ছিল না। বরং অন্য সব ঘটনার মতো আমাদের মনে দ্বিধা ছিল, সংশয় ছিল; এমনকি দ্বিধা ছিল রোজিনা ইসলামের প্রতিষ্ঠান প্রথম আলোর মধ্যেও।
ঘটনা শুরু হয়েছে বিকাল ৩টায়। প্রথম আলো তাদের অনলাইনে প্রথম নিউজ করেছে রাত ৯টা ৪১ মিনিটে। অন্য সব ঘটনায় প্রথম আলোর অনলাইন খুব দ্রুত নিউজ দেয়। আমার মোবাইলে সবসময় অনেক নিউজ পোর্টালের সাথে প্রথম আলোর সাইটও খোলা থাকে। আপডেট পেতে আমি প্রথমেই প্রথম আলোয় ঢু মারি। সেদিন আমি বারবার ঘটনা জানার জন্য প্রথম আলোয় ঢুকে নিরাশ হয়েছি।
ভাবুন, ব্যক্তিটি যদি রোজিনা নাও হতেন, এমনকি সাংবাদিক কেউও না হতেন; একজন নারীকে সচিবালয়ের একটি কক্ষে ছয় ঘণ্টা আটকে রেখে শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতন করা হলে; প্রথম আলো সেটা নিউজ করতো না? তাহলে প্রথম আলো তাদের অন্যতম সেরা রিপোর্টারের ব্যাপারে প্রায় ৭ ঘণ্টা নির্বিকার থাকলো কীভাবে?
আমি আসলে রোজিনা ইস্যুতে প্রথম আলোর অবস্থানটি বুঝতে চাইছিলাম। তাদের এত দ্বিধা, এত বিলম্বের কারণটি বোঝার চেষ্টা করছিলাম। দুইটা ব্যাপার হতে পারে, এই ৬/৭ ঘণ্টা সময়ে প্রথম বিষয়টি সমঝোতার চেষ্টা করেছে।
কিন্তু খোঁজ নিয়ে জেনেছি, তেমন কোনো চেষ্টা ছিল না। থাকলেও সেটার দৃশ্যমান কোনো প্রতিফলন ছিল না। রোজিনা ইসলামকে যে ছয় ঘণ্টা সচিবালয়ে আটকে রাখা হয়েছিল, সারাক্ষণ সেখানে বিভিন্ন গণমাধ্যমের সাংবাদিকরা উপস্থিত ছিলেন। কিন্তু সিনিয়র কেউ তো দূরের কথা, প্রথম আলোর তেমন কাউকে দেখাই যায়নি। প্রথম আলোর একজন রিপোর্টার ভুল করুক, শুদ্ধ করুক, চুরি করুক; তাকে সচিবালয়ে আটকে রাখার খবর শুনে প্রথম আলোর সিনিয়ররা সেখানে ছুটে গেলেন না কেন?
রোজিনা যেহেতু পেশাগত কাজে গিয়ে বিপদে পড়েছে, তার পাশে দাঁড়ানোর প্রথম দায়িত্ব তো তার প্রতিষ্ঠানেরই। রোজিনা ইসলামকে থানায় নিয়ে যাওয়ার পর থানার সামনে অবস্থান নিয়ে যারা স্লোগান দিয়েছেন, তাদের মধ্যেও প্রথম আলোর তেমন কাউকে দেখা যায়নি। পরে অবশ্য তার পরিবারের সদস্য এবং প্রথম আলোর সিনিয়রদের মধ্যে আনিসুল হক থানায় যান।
আনিসুল হককে থানা-আদালত-সচিবালয়-মানববন্ধন সব জায়গায় দেখা গেছে। তবে আনিসুল হকের এই ছুটে বেরানোটা যতটা না প্রাতিষ্ঠানিক, তারচেয়ে অনেক বেশি ব্যক্তিক। আনিসুল হক একজন সংবেদনশীল ও মানবিক মানুষ। রোজিনাকে কারাগারে পাঠানোর পর তার কান্না আমাদের সবার হৃদয় ছুঁয়েছে। আমি নিশ্চিত রোজিনা বিপদে পড়ায় আনিসুল হক যেভাবে ছুটে গেছেন, আমি যে ২০ বছর আগে প্রথম আলো ছেড়েছি, আমি বিপদে পড়লেও তিনি ছুটে যাবেন।
তবে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে প্রথম আলোর প্রাথমিক দ্বিধার কোনো যৌক্তিক ব্যাখ্যা আমার কাছে নেই। হতে পারে প্রথম দিকে তারা রোজিনার দায় নিতে চায়নি। দায় না নেয়ার অতীত উদাহরণ অবশ্য প্রথম আলোর আছে। ১/১১-এর সময় প্রথম আলোর রম্য ম্যাগাজিন আলপিনে কার্টুন ছাপার অপরাধে কার্টুনিস্ট আরিফকে কারাগারে যেতে হয়েছিল। আরিফ কার্টুন আঁকতে পারে। কিন্তু যারা ছেপেছিল, দায় তো তাদের। কিন্তু তারা কেউ দায় নেননি। হুজুরদের কাছে তওবা করে, আর কার্টুনিস্ট আরিফকে ভুলে গিয়ে প্রথম আলো নিজেদের বিপদ থেকে উদ্ধার করেছিল। আর প্রথম আলো পাশে দাঁড়ায়নি বলে সেই তরুণ কার্টুনিস্টকে শেষ পর্যন্ত দেশ ছাড়তে হয়েছিল। হুজুরদের ভয়ে প্রকাশ্যে প্রথম আলো হয়তো সেই কার্টুনিস্টের পাশে দাঁড়াতে পারেনি। কিন্তু চাইলে গোপনে তাকে সাহায্য করতে পারতো। তওবা করা, মুচলেকা দেওয়া, সত্য রিপোর্ট করেও আদালতে গিয়ে নিঃশর্ত ক্ষমা চেয়ে আসার ইতিহাস প্রথম আলোর অনেক আছে।
শুধু প্রথম আলো নয়, রোজিনা ইস্যুতে শুরুতে দ্বিধা ছিল আমাদের সাংবাদিক নেতাদেরও। অবশ্যই সবার আগে প্রথম আলোর ছুটে যাওয়া উচিত ছিল। কিন্তু প্রেসক্লাব থেকে সিনিয়র সাংবাদিক ও নেতারা যদি দ্রুততম সময়ে সচিবালয়ে ছুটে যেতেন, তাহলে ঘটনাটি সেখানেই শেষ হয়ে যেতে পারতো। রোজিনার ফোন কেড়ে নেওয়া হয়েছিল বলে তিনি ঊর্ধ্বতন কারো সাথে যোগাযোগ করতে পারেননি। কিন্তু প্রথম আলোর সিনিয়র কেউ বা সিনিয়র নেতারা শুরুতে উদ্যোগ নিলে বিষয়টি হয়তো এতদূর গড়াতো না। কিন্তু প্রথম কোনো সিনিয়র নেতাকে সক্রিয় দেখা যায়নি।
নেতারা হয়তো লাভ-ক্ষতির হিসাব কষছিলেন-আন্দোলন করতে গেলে সরকার মাইন্ড করে কি না, সুযোগ-সুবিধা কমে যায় কি না, প্রথম আলোর পাশে দাঁড়াবো কি না ইত্যাদি ইত্যাদি দ্বিধার বেড়ি হয়তো তাদের আটকে রেখেছিল। এই দ্বিধারও একটা ব্যাখ্যা আছে। প্রথম আলোর ব্যাপারে অনেকেরই অনেক রকম দ্বিধা আছে। আজ প্রথম আলোর একজন সিনিয়র রিপোর্টারের পেছনে গোটা সাংবাদিক সমাজ ঐক্যবদ্ধ। কিন্তু রিপোর্টারটি যদি প্রথম আলোর না হয়ে ভোরের আলোর হতো, প্রথম আলোতে তা এক লাইনও ছাপা হতো না।
অতীতে অনেকবার দেখা গেছে, বিভিন্ন ইস্যুতে সাংবাদিকরা আন্দোলন-সংগ্রাম করলেও প্রথম আলো নির্বিকার থেকেছে। আজ যখন বিষয়টি তাদের ঘাড়ে এসেছে এবং রোজিনা ইস্যুকে ব্যবহার করে প্রথম আলো ক্রেডিট নিতে পারবে; এটা নিশ্চিত হওয়ার পরই কেবল প্রথম আলো সক্রিয় হয়েছে। ঘটনা উল্টো হলে প্রথম আলো মুচলেকা দিয়ে রোজিনাকে ছুঁড়ে ফেলতে দ্বিধা করতো না। প্রথম আলো সবসময় নিজেদের ‘ব্রাহ্মণ’ ভাবে। অন্যদের তারা পাত্তাই দেয় না।
সাংবাদিকদের কোনো সংগঠনেই প্রথম আলোর অংশগ্রহণ নেই। প্রথম আলোর কেউই সাংবাদিকদের কোনো সংগঠনে কখনো নির্বাচন করতে পারে না। কিন্তু আজ প্রথম আলোর বিপদকে ‘নমশুদ্র সাংবাদিকরা’ নিজেদের বিপদ মনে করে এগিয়ে এসেছে। তবে এই এগিয়ে আসাটাও সম্ভব হয়েছে তারুণ্যের স্বতঃস্ফূর্ততায়। সচিবালয়ে, শাহবাগ থানায় তরুণ সাংবাদিকরাই স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদ করেছে। কারণ তাদের লাভ-ক্ষতির হিসাব নেই। তারুণ্য শুধু একজন সাংবাদিকের বিপদের কথাই ভেবেছে। তিনি রোজিনা ইমলাম, নাকি প্রথম আলো সেটা তারা ভাবেনি।
তারুণ্য আন্দোলনটা শুরু করেছে বলেই প্রথম আলো এগিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছে, সিনিয়র নেতারা মাঠে নেমেছেন। আমিও শেষ পর্যন্ত ভরসা রাখতে চাই তারুণ্যেই। রোজিনার মামলা প্রত্যাহারের দাবির পাশাপাশি পেশাগত কাজে সকল সাংবাদিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করার লড়াইটা তাদেরই চালিয়ে যেতে হবে।
লেখক: হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ
সূত্র: ঢাকা টাইমস